১১:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫
ট্রাম্প রাশিয়ার উত্তেজক বিবৃতির পর দুইটি পারমাণবিক সাবমেরিন স্থানান্তরের নির্দেশ দিলেন হিউএনচাঙ (পর্ব-১৬১) ড্রাগ বা ডায়েট ছাড়া কীভাবে চীনে এক ইনফ্লুয়েন্সার পাঁচ বছরে ৬০ কেজি ওজন কমিয়েছেন ট্রাম্পের ট্যারিফে আফ্রিকা চীনের কোলে মাশরাফি বিন মর্তুজা: বাংলাদেশের এক মহান ক্রিকেটারের জীবনগাথা ট্রাম্পের শুল্ক ভারতের ৪০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে ফেডারেল তহবিল কাটা যাওয়ায় পাবলিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বন্ধ, স্থানীয় গণমাধ্যমে বড় ধাক্কা ট্রেড আলোচনা স্থবির, শুল্ক হুমকি বাড়ছে: যুক্তরাষ্ট্র–ভারত অংশীদারিত্বে টানাপোড়ন  বাংলাদেশে দুই কোটি হিন্দুর ও প্রগতিশীল মুসলিমদের ভবিষ্যত কি? জলঢাকা নদী: ইতিহাস, পথচলা ও বর্তমান বাস্তবতা

দুই মাসের মধ্যে নেতা-কর্মীদের মামলা প্রত্যাহার চায় হেফাজতে ইসলাম, নতুন কর্মসূচি

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:০৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫
  • 80

একযুগ পরে ঢাকায় পালন করা মহাসমাবেশ থেকে হেফাজতে ইসলাম দাবি জানিয়েছে, দুই মাসের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সেই সাথে আরো কিছু দাবিতে দুইটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামী ২৩শে সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও পরবর্তী তিন মাসের বিভিন্ন বিভাগে সম্মেলন।

শনিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজিদুর রহমান।

২০১৩ সালের পাঁচই মে ঢাকার শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের পর এবারই ঢাকায় আবারো বড় আকারের জমায়েত করলো কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক এই সংগঠনটি।

দলটির নেতারা শাপলা চত্বরে ঘটনার পর সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা বাতিল, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়েছে।

এই মহাসমাবেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বক্তব্য দেন হেফাজত নেতারা।

সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের সময় দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। যদি মনে হয় সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না, তাহলে আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে”।

সকাল নয়টায় কর্মসূচি শুরুর সময় থাকলেও ভোর থেকেই ঢাকার বাইরে থেকে মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যোগ দিতে আসেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা।

সমাবেশে যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ছিল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শিশু-কিশোর, যাদের বয়স ১২ থেকে ১৫ বছর। পুরো সমাবেশে কোনো নারীর উপস্থিতি দেখা যায়নি।

সকাল দশটার আগেই অনেকটা পূর্ণ হয়ে যায় সমাবেশ প্রাঙ্গণ। যদিও অনেকেই পাশের রমনা পার্ক, মৎস্য ভবন মোড় ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের পাশে অবস্থান করেন।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমাবেশে যোগ দিতে আসা নেতাকর্মীরা বলেন, সরকার কোরআন সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করলে তারা সেটা যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করবেন।

কওমিমাদ্রাসা ভিত্তিক এই সংগঠনের সমাবেশে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ অংশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি অতি দ্রুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে অংশ নেন নেতাকর্মীরা
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে অংশ নেন নেতাকর্মীরা

হেফাজত নেতাদের হুশিয়ারি

হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের নেতারা তাদের চারদফা দাবির পাশাপাশি সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেও বক্তব্য রাখেন।

হেফাজতের আমির মহিবুল্লাহ বাবুনগরীর লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয় সমাবেশে।

মহাসমাবেশ থেকে নারী সংস্কারের নামে ইসলাম বিদ্বেষী প্রস্তাবনা বাতিল, জাতীয় নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার বিচার, তার আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা, ইসরাইলি ও ভারতের পণ্য বর্জন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ভিনদেশিদের অপতৎপরতা বন্ধ ও কাদিয়ানীদের তৎপরতা নিষিদ্ধ করা সহ ১২দফা ঘোষণা পত্র দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। মহাসমাবেশে যুগ্ম মহাসচিব হারুন ইজহার, খালেদ সাইফুল্লাহসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক হিউম্যানিটরিয়ান করিডরের নামে বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হরণ করার জন্য অপতৎপরতা চালানো হলে তা প্রতিহতের ঘোষণা দেন।

তিনি বলেন, “বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে চাই, নারী সংস্কারের নামে আল্লাহর কোরআনকে, ইসলামকে কটাক্ষ করা হয়েছে। ধর্মীয় উত্তরাধিকার বিধান, পারিবারিক বিধানকে নারী-পুরুষের বৈষম্যের প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করে নারী বিষয়ক কমিশন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রদান করেছে”।

প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে মামুনুল হক বলেন, “ড. ইউনূসের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অনেকবার সাক্ষাৎ করে বিনয়ের সঙ্গে আবেদন করেছে, আমাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী আমলে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করেন। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের, সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না।”

”প্রফেসর ড. ইউনূস আপনি কি সেই কথা ভুলে গিয়েছেন, এই দুইমাস আগেও আমাদের সামনে আদালতের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতেন। আগামী দুই মাসের মধ্যে যদি হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের নামে মামলা প্রত্যাহার না হয় তাহলে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের যা করতে হয় তাই করবে,” ঘোষণা করেন মামুনুল হক।

তিনি বলেন, ”চব্বিশের জুলাইয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর আমি বলতে চাই, আমরা দিল্লির দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছি নিউ ইউর্কের গোলামী করবার জন্য নয়।”

পরে আগামী ২৩শে মে শুক্রবার জুমার নামাজের পর সারাদেশে বিক্ষোভসহ দুই দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব সাজিদুর রহমান।

মহাসমাবেশে সংহতি জানাতে আসেন দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহও।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “এই সংস্কার আমাদের দেশের বড় সংস্কার, আওয়ামী লীগগে নিষিদ্ধ করতে হবে। কোন কিন্তু অথবা নেই। আচ্ছা দেখছি এরকম কিছুও নেই। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতেই হবে”।

”একই সাথে নারী সংস্কার নিয়ে যেই কনসার্ন আপনাদের কাছ থেকে এসেছে আমরা চাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই কনসার্নগুলোকে আপনি অতিসত্তর অ্যাড্রেস করুন। এবং অপ্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোকে পাশ কাটিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার রয়েছে সেটির মধ্য দিয়ে নারীদের অধিকার নিশ্চিত করুন,” বলেন হাসনাত আবদুল্লাহ।

সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীরা জড়ো হন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীরা জড়ো হন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

সকাল থেকে নেতাকর্মীদের ঢল

নরসিংদী সদর থেকে মহাসমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন একটি মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক নাসির উদ্দিন।

বিবিসি বাংলাকে মি. উদ্দিন জানান, নরসিংদী সদর থেকে ১৫ থেকে ২০টি গাড়িতে করে সকাল সাড়ে ছয়টায় তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ নেতাকর্মীরা পৌঁছান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশস্থলে।

তার দেয়া তথ্য মতে শুধুমাত্র নরসিংদী জেলা থেকেই এই সমাবেশে যোগ দিতে শতাধিক বাস নিয়ে আসা হয়েছিল।

সকাল আটটার দিকে ঢাকার মৎস্য ভবন মোড়ে গিয়ে দেখা যায় সেখান থেকে একে একে মিছিল নিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে প্রবেশ করতে শুরু করেন।

এই সমাবেশে যোগ দিতে আসা যাদের সাথে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে, তাদের সবাই এসেছিলেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মাদ্রাসা থেকে।

মূলত মাদ্রাসা শিক্ষকরাই তাদের ছাত্রদের নিয়ে এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন।

ময়মনসিংহ থেকে দশ হাজার নেতাকর্মীদের সাথে এসেছিলেন হেফাজত ইসলামের কর্মী ও স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক সাব্বির আহমেদ।

তিনি জানান, সকালের মধ্যে সমাবেশে যোগ দিতে তারা ভোররাতেই রওনা দেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছান সমাবেশ স্থলে।

এই সমাবেশে যোগ দিতে আসা শিক্ষকদের সাথে ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ। যাদের অনেকের বয়সই ছিল ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে।

বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সমাবেশে যোগ দিতে যারা এসেছিলেন, তারা অনেকেই সকালে এসে বিশ্রাম নেন আশপাশের বিভিন্ন মসজিদে।

অনেককে আবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অপর পাশে রমনা পার্কে বিশ্রাম নিতে ও ঘোরাঘুরি করতেও দেখা যায়।

সমাবেশ ঘিরে মৎসভবন, শাহবাগ মোড়সহ বিভিন্ন জায়গায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল। কাকরাইল মোড়ে প্রস্তুত ছিল পুলিশের এপিসি ও জলকামানের গাড়ি।

হেফাজত নেতা মামুনুল হক
হেফাজত নেতা মামুনুল হক

আগত নেতাকর্মীরা যা বললেন

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবেদন বাতিল, সংবিধানে বহুত্বদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডসহ সব গণহত্যার বিচার ও ফিলিস্তিন ও ভারতে ‘মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে’ সরকারকে ভূমিকা রাখা, এই চার দফা দাবিতে ছিল হেফাজতে ইসলামের এই সমাবেশ।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নেতাকর্মীরা এই মহাসমাবেশে অংশ নিয়ে এই দাবির পক্ষে শ্লোগান দিতে থাকেন।

নরসিংদী থেকে আসা মাদ্রাসা শিক্ষক মো. নাসিরউদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কোরআন শরীফেই নারী পুরুষের সম্পত্তির বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা আছে। তারপরও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব করেছে সেটি একেবারেই ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক”।

তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের এই চার দফা দাবি যদি সরকার মেনে না নেয় তাহলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে আগামীতে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হলে তা মাঠে বাস্তবায়ন করবে নেতাকর্মীরা।

ঢাকার মানিকনগর থেকে মিছিল নিয়ে এই সমাবেশে যোগ দেন যোবায়ের আহমেদ নামে একজন হেফাজতে ইসলামের কর্মী।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন”।

আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে দলটি নিষিদ্ধেরও দাবি জানান হেফাজত কর্মী যোবায়ের আহমেদ।

ময়মনসিংহের সাব্বির আহমেদ, শাপলা চত্বর ও জুলাই গণহত্যার বিচার ও সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে বলেন, এই দাবির পক্ষে সংগঠন থেকে যেকোনো কর্মসূচি দিলে তারা মাঠে থাকবেন।

বিবিসি বাংলা

জনপ্রিয় সংবাদ

ট্রাম্প রাশিয়ার উত্তেজক বিবৃতির পর দুইটি পারমাণবিক সাবমেরিন স্থানান্তরের নির্দেশ দিলেন

দুই মাসের মধ্যে নেতা-কর্মীদের মামলা প্রত্যাহার চায় হেফাজতে ইসলাম, নতুন কর্মসূচি

১২:০০:০৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫

একযুগ পরে ঢাকায় পালন করা মহাসমাবেশ থেকে হেফাজতে ইসলাম দাবি জানিয়েছে, দুই মাসের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সেই সাথে আরো কিছু দাবিতে দুইটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামী ২৩শে সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও পরবর্তী তিন মাসের বিভিন্ন বিভাগে সম্মেলন।

শনিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজিদুর রহমান।

২০১৩ সালের পাঁচই মে ঢাকার শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের পর এবারই ঢাকায় আবারো বড় আকারের জমায়েত করলো কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক এই সংগঠনটি।

দলটির নেতারা শাপলা চত্বরে ঘটনার পর সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা বাতিল, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়েছে।

এই মহাসমাবেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বক্তব্য দেন হেফাজত নেতারা।

সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের সময় দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। যদি মনে হয় সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না, তাহলে আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে”।

সকাল নয়টায় কর্মসূচি শুরুর সময় থাকলেও ভোর থেকেই ঢাকার বাইরে থেকে মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যোগ দিতে আসেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা।

সমাবেশে যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ছিল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শিশু-কিশোর, যাদের বয়স ১২ থেকে ১৫ বছর। পুরো সমাবেশে কোনো নারীর উপস্থিতি দেখা যায়নি।

সকাল দশটার আগেই অনেকটা পূর্ণ হয়ে যায় সমাবেশ প্রাঙ্গণ। যদিও অনেকেই পাশের রমনা পার্ক, মৎস্য ভবন মোড় ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের পাশে অবস্থান করেন।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমাবেশে যোগ দিতে আসা নেতাকর্মীরা বলেন, সরকার কোরআন সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করলে তারা সেটা যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করবেন।

কওমিমাদ্রাসা ভিত্তিক এই সংগঠনের সমাবেশে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ অংশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি অতি দ্রুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে অংশ নেন নেতাকর্মীরা
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে অংশ নেন নেতাকর্মীরা

হেফাজত নেতাদের হুশিয়ারি

হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের নেতারা তাদের চারদফা দাবির পাশাপাশি সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেও বক্তব্য রাখেন।

হেফাজতের আমির মহিবুল্লাহ বাবুনগরীর লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয় সমাবেশে।

মহাসমাবেশ থেকে নারী সংস্কারের নামে ইসলাম বিদ্বেষী প্রস্তাবনা বাতিল, জাতীয় নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার বিচার, তার আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা, ইসরাইলি ও ভারতের পণ্য বর্জন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ভিনদেশিদের অপতৎপরতা বন্ধ ও কাদিয়ানীদের তৎপরতা নিষিদ্ধ করা সহ ১২দফা ঘোষণা পত্র দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। মহাসমাবেশে যুগ্ম মহাসচিব হারুন ইজহার, খালেদ সাইফুল্লাহসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক হিউম্যানিটরিয়ান করিডরের নামে বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হরণ করার জন্য অপতৎপরতা চালানো হলে তা প্রতিহতের ঘোষণা দেন।

তিনি বলেন, “বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে চাই, নারী সংস্কারের নামে আল্লাহর কোরআনকে, ইসলামকে কটাক্ষ করা হয়েছে। ধর্মীয় উত্তরাধিকার বিধান, পারিবারিক বিধানকে নারী-পুরুষের বৈষম্যের প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করে নারী বিষয়ক কমিশন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রদান করেছে”।

প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে মামুনুল হক বলেন, “ড. ইউনূসের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অনেকবার সাক্ষাৎ করে বিনয়ের সঙ্গে আবেদন করেছে, আমাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী আমলে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করেন। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের, সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না।”

”প্রফেসর ড. ইউনূস আপনি কি সেই কথা ভুলে গিয়েছেন, এই দুইমাস আগেও আমাদের সামনে আদালতের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতেন। আগামী দুই মাসের মধ্যে যদি হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের নামে মামলা প্রত্যাহার না হয় তাহলে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের যা করতে হয় তাই করবে,” ঘোষণা করেন মামুনুল হক।

তিনি বলেন, ”চব্বিশের জুলাইয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর আমি বলতে চাই, আমরা দিল্লির দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছি নিউ ইউর্কের গোলামী করবার জন্য নয়।”

পরে আগামী ২৩শে মে শুক্রবার জুমার নামাজের পর সারাদেশে বিক্ষোভসহ দুই দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব সাজিদুর রহমান।

মহাসমাবেশে সংহতি জানাতে আসেন দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহও।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “এই সংস্কার আমাদের দেশের বড় সংস্কার, আওয়ামী লীগগে নিষিদ্ধ করতে হবে। কোন কিন্তু অথবা নেই। আচ্ছা দেখছি এরকম কিছুও নেই। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতেই হবে”।

”একই সাথে নারী সংস্কার নিয়ে যেই কনসার্ন আপনাদের কাছ থেকে এসেছে আমরা চাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই কনসার্নগুলোকে আপনি অতিসত্তর অ্যাড্রেস করুন। এবং অপ্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোকে পাশ কাটিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার রয়েছে সেটির মধ্য দিয়ে নারীদের অধিকার নিশ্চিত করুন,” বলেন হাসনাত আবদুল্লাহ।

সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীরা জড়ো হন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীরা জড়ো হন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

সকাল থেকে নেতাকর্মীদের ঢল

নরসিংদী সদর থেকে মহাসমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন একটি মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক নাসির উদ্দিন।

বিবিসি বাংলাকে মি. উদ্দিন জানান, নরসিংদী সদর থেকে ১৫ থেকে ২০টি গাড়িতে করে সকাল সাড়ে ছয়টায় তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ নেতাকর্মীরা পৌঁছান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশস্থলে।

তার দেয়া তথ্য মতে শুধুমাত্র নরসিংদী জেলা থেকেই এই সমাবেশে যোগ দিতে শতাধিক বাস নিয়ে আসা হয়েছিল।

সকাল আটটার দিকে ঢাকার মৎস্য ভবন মোড়ে গিয়ে দেখা যায় সেখান থেকে একে একে মিছিল নিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে প্রবেশ করতে শুরু করেন।

এই সমাবেশে যোগ দিতে আসা যাদের সাথে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে, তাদের সবাই এসেছিলেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মাদ্রাসা থেকে।

মূলত মাদ্রাসা শিক্ষকরাই তাদের ছাত্রদের নিয়ে এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন।

ময়মনসিংহ থেকে দশ হাজার নেতাকর্মীদের সাথে এসেছিলেন হেফাজত ইসলামের কর্মী ও স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক সাব্বির আহমেদ।

তিনি জানান, সকালের মধ্যে সমাবেশে যোগ দিতে তারা ভোররাতেই রওনা দেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছান সমাবেশ স্থলে।

এই সমাবেশে যোগ দিতে আসা শিক্ষকদের সাথে ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ। যাদের অনেকের বয়সই ছিল ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে।

বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সমাবেশে যোগ দিতে যারা এসেছিলেন, তারা অনেকেই সকালে এসে বিশ্রাম নেন আশপাশের বিভিন্ন মসজিদে।

অনেককে আবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অপর পাশে রমনা পার্কে বিশ্রাম নিতে ও ঘোরাঘুরি করতেও দেখা যায়।

সমাবেশ ঘিরে মৎসভবন, শাহবাগ মোড়সহ বিভিন্ন জায়গায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল। কাকরাইল মোড়ে প্রস্তুত ছিল পুলিশের এপিসি ও জলকামানের গাড়ি।

হেফাজত নেতা মামুনুল হক
হেফাজত নেতা মামুনুল হক

আগত নেতাকর্মীরা যা বললেন

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবেদন বাতিল, সংবিধানে বহুত্বদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডসহ সব গণহত্যার বিচার ও ফিলিস্তিন ও ভারতে ‘মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে’ সরকারকে ভূমিকা রাখা, এই চার দফা দাবিতে ছিল হেফাজতে ইসলামের এই সমাবেশ।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নেতাকর্মীরা এই মহাসমাবেশে অংশ নিয়ে এই দাবির পক্ষে শ্লোগান দিতে থাকেন।

নরসিংদী থেকে আসা মাদ্রাসা শিক্ষক মো. নাসিরউদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কোরআন শরীফেই নারী পুরুষের সম্পত্তির বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা আছে। তারপরও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব করেছে সেটি একেবারেই ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক”।

তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের এই চার দফা দাবি যদি সরকার মেনে না নেয় তাহলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে আগামীতে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হলে তা মাঠে বাস্তবায়ন করবে নেতাকর্মীরা।

ঢাকার মানিকনগর থেকে মিছিল নিয়ে এই সমাবেশে যোগ দেন যোবায়ের আহমেদ নামে একজন হেফাজতে ইসলামের কর্মী।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন”।

আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে দলটি নিষিদ্ধেরও দাবি জানান হেফাজত কর্মী যোবায়ের আহমেদ।

ময়মনসিংহের সাব্বির আহমেদ, শাপলা চত্বর ও জুলাই গণহত্যার বিচার ও সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে বলেন, এই দাবির পক্ষে সংগঠন থেকে যেকোনো কর্মসূচি দিলে তারা মাঠে থাকবেন।

বিবিসি বাংলা