অনুপ্রিতা দাস, প্রগতি কে.বি., মুজিব মাশাল, কাসিম নওমান, হরি কুমার, সুহাসিনী রাজ, আলেক্স ট্রাভেল্লি, জিয়া উর‑রহমান, শন পাইক
সর্বশেষ পরিস্থিতি
শুক্রবার ভারত ও পাকিস্তান বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। উভয় দেশই কাশ্মীর সীমান্তের বহু দূরে একে অপরের ভূখণ্ডে হামলা চালানোর খবর দিয়েছে। বুধবার ভোরে ভারতের বিমান হামলা এবং পাক‑নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে আঘাত হানার পর থেকেই সংঘাত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। রাতভর গোলাবর্ষণ ও গুলি বিনিময়ের মধ্যে শুক্রবার সকালে পাকিস্তানের ড্রোন ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে ভারতের পশ্চিম সীমান্তজুড়ে আক্রমণের অভিযোগ তোলে দিল্লি; ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায়, হামলাগুলোর “কার্যকর প্রতিহত” করা হয়েছে। ইসলামাবাদ এ দাবি অস্বীকার করেছে।
ড্রোন এর আগে ভারত‑পাকিস্তান সংঘর্ষে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি। একই সঙ্গে বিভ্রান্তিকর সরকারি বিবৃতি ও ভুল খবরের স্রোত আক্রমণের প্রকৃতি ও অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করেছে।
রাতভর গোলাবর্ষণ‑গুলিবর্ষণ শুক্রবার ভোরে থেমে যায়। ভারত‑শাসিত কাশ্মীরের জম্মু শহরসহ কয়েকটি অঞ্চলে ব্ল্যাকআউট জারি ছিল; বাসিন্দারা ঘরে আশ্রয় নিয়ে মাথার ওপর দিয়ে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে যাওয়ার বর্ণনা দেন। পাকিস্তান‑শাসিত কাশ্মীরের শহরগুলোতেও গোলার আঘাতে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; দুই পক্ষই জানায়, গুলি বিনিময়ে বেসামরিক হতাহত হয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে তিনটি যুদ্ধ লড়েছে, প্রতিটিতে কাশ্মীর ইস্যু জড়িত। ১৯৭১‑এর যুদ্ধের পর স্থাপিত লাইন অফ কন্ট্রোল এখনকার সীমা নির্ধারণ করে।
সাম্প্রতিক সহিংসতা শুরু হয় ভারত‑শাসিত কাশ্মীরের পর্যটন কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহতের পর। দিল্লির দাবি, হামলার নেপথ্যে পাকিস্তানের হাত আছে; ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করেছে।
দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত
হিমালয়ের মনোরম উপত্যকা কাশ্মীরকে ঘিরে দশকজুড়ে চলা বিরোধের এটি নতুনতম অধ্যায়; কাশ্মীরিরা প্রায়ই নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অংশ নিতে পারেনি।
মিডিয়া পরিস্থিতি
দুই দেশই একে অপরের তথ্য প্রবাহে বাধা দিয়েছে। পাকিস্তানে বহু বছর ভারতীয় সংবাদ নিষিদ্ধ; এবার ভারত ৮ হাজারের বেশি এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্ট, বিদেশি সংবাদমাধ্যমসহ, তার দেশ থেকে দেখতে বাধা দিয়েছে।
আইপিএল এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত
ভারতের জনপ্রিয় ক্রিকেট লিগ আইপিএল জানিয়েছে, ম্যাচগুলো এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত থাকবে।
পারমাণবিক উদ্বেগ ও নতুন সামরিক জোট
২০১৯‑এর শেষ বড় লড়াইয়ের সময় যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের পরমাণু অস্ত্র সরণ দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিল। এবার পরিস্থিতি আরও জটিল: ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্র‑পশ্চিমা অস্ত্রে ঝুঁকছে, রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে; পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে অধিকাংশ অস্ত্র নিচ্ছে। এতে মেগা শক্তির রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম দ্বন্দ্বে প্রবেশ করেছে।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাওয়াজা মুহাম্মদ আসিফ পার্লামেন্টে জানান, সংকট প্রশমনে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও চীনের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ হচ্ছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরেও “বিভিন্ন বিকল্প” নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
স্মৃতিতে ১৯৭১
হরি কুমার লিখেছেন, ১৯৭১‑এর বড় যুদ্ধের পর এমন উত্তেজনা আর দেখেননি। সে সময় যেমন সাইরেন, ব্ল্যাকআউট ও মহড়া ছিল, এবারও উত্তর ভারতে একই চিত্র। পার্থক্য—এখন ড্রোন ও উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র সীমান্তকে অকার্যকর করে পুরো দেশকে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে, আর ভুল খবরের বন্যা পরিস্থিতি আরও বিভ্রান্তিকর করেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিমানবন্দর বন্ধ
উভয় পাশে লাখো শিক্ষার্থীর জন্য স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। উত্তর ভারতের ২৪টি বিমানবন্দর বেসামরিক ফ্লাইটের জন্য বন্ধ।
সীমান্তবর্তী পুঞ্চে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
ভারত‑শাসিত কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় প্রথম রাতের গোলায় ১৩ জন নিহত, ডজনখানেক আহত; বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পরের রাতে গোলাবর্ষণ আরও ভয়াবহ হয়।
বৈমানিক চলাচলে বিশাল ব্যাহত
ভারতীয় হামলার পর ৭ মে পাকিস্তানের উপর দিয়ে দৈনিক প্রায় ৭০০ ফ্লাইটের সংখ্যা নেমে আসে ১৮‑তে; গড়ে ২.৫ ঘণ্টা করে অতিরিক্ত সময় লাগছে।
শেয়ারবাজারে ধস
মুম্বাই সূচক শুক্রবার ১ শতাংশ পড়ে; করাচি বেঞ্চমার্ক ২২ এপ্রিল থেকে ১২ শতাংশ হারিয়েছে। তবে ভারতের বাজার মূল্য পাকিস্তানের ১২ গুণ, তাই সামান্য পতনও বড় প্রভাব ফেলছে।
ক্রিকেটও স্থবির
পাকিস্তান সুপার লিগের বাকি আট ম্যাচ নিরাপত্তা কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভারতের ধর্মশালায় আইপিএল ম্যাচ ড্রোন হামলার খবরে মাঝপথে বাতিল, স্টেডিয়াম খালি করা হয়।
সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের উৎকণ্ঠা
পাঞ্জাবের কৃষক সর্ভান সিং পন্ধের জানিয়েছেন, খাদ্য ও অর্থ‑সংকটের আশঙ্কায় গ্রামের লোকজন মজুদ বাড়াচ্ছে।
সর্বশেষ লড়াইয়ে কী ঘটছে?
ভারত জানিয়েছে, পাকিস্তান ড্রোনসহ নানা অস্ত্র দিয়ে পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ চালিয়েছে, যা তারা প্রতিহত করেছে। পাকিস্তান এই দাবিকে “অসত্য” বলেছে ও ২০‑টিরও বেশি ভারতের ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করেছে। উভয়ের বক্তব্যই স্বাধীনভাবে যাচাই সম্ভব হয়নি।
সংঘাত থামাতে কী পদক্ষেপ?
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দুই দেশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে “তাৎক্ষণিক সম্প্রীতি” আনার আহ্বান জানিয়েছেন। সৌদি আরব ও ইরানের শীর্ষ কূটনীতিকরা দিল্লি‑ইসলামাবাদে বৈঠক করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, উভয় পক্ষ প্রথম দিনের সাফল্যকে (ভারতের গভীর হামলা, পাকিস্তানের ভারতীয় জেট ভূপাতিত) বিজয় হিসেবে দেখিয়ে পিছু হটার পথ পেতে পারে।
কাশ্মীর হামলা কী?
২২ এপ্রিল, পহেলগামে সশস্ত্র হামলায় ২৬ জন নিহত, ১৭ জন আহত হন; অধিকাংশই হিন্দু পর্যটক। “রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট” নামে একটি দল দায় স্বীকার করে, যা ভারতের মতে পাকিস্তান‑ভিত্তিক লস্কর‑ই‑তৈবার ছদ্মবেশী সংগঠন। এরপর ভারত কাশ্মীরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে।
‘অপারেশন সিন্দুর’
ভারতের সামরিক অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিন্দুর’—হিন্দু বিবাহিত নারীর সিঁদুর থেকে অনুপ্রাণিত; হামলায় বিধবা হওয়া নারীদের ‘বদলা’র বার্তা সরকারের। নারীবাদীদের সমালোচনা—এ নাম পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।
কাশ্মীর বিরোধের উৎপত্তি
১৯৪৭‑এর দেশভাগের পর হিন্দু শাসিত কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে পাকিস্তান সামরিকভাবে দখল করতে চায়। ১৯৪৯‑এর জাতিসংঘ‑বন্দোবস্ত সীমান্তরেখা স্থির করে। ১৯৬৫ ও ১৯৭১‑এর যুদ্ধের পর সীমান্তটি লাইন অফ কন্ট্রোলে রূপ নেয়। বিরোধ আজও মেটেনি।
পাকিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো
৮০‑এর দশকে স্থানীয় ক্ষোভ থেকে কাশ্মীরে বিদ্রোহ শুরু; পরবর্তীতে পাকিস্তান কয়েকটি গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ‑সহায়তা দেয়। ২০০৮‑এর মুম্বাই হামলার পর শান্তি প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে।
বর্তমানে কাশ্মীরের অবস্থা
১৯৯৯‑এর পর অঞ্চলটি বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকৃত এলাকা। ২০১৯‑এ মোদি সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু‑কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন তুলে নেয়; ভারতের কঠোর নিরাপত্তা নীতি‑সত্ত্বেও অসন্তোষ রয়ে গেছে। পাকিস্তান‑শাসিত অংশেও বিক্ষোভ হয়েছে।
জলবণ্টন চুক্তি থেকে ভারতের সরে দাঁড়ানোর হুমকি
ইন্দাস জলচুক্তি কী?
১৯৬০‑এর চুক্তি ছয়টি নদীর পানি বণ্টন নির্দিষ্ট করে; বিশ্বব্যাঙ্ক মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তি আন্তর্জাতিক জলবণ্টন বিরোধ মীমাংসার আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত। পূর্বের রবি, বেয়াস, শতদ্রু নদীর ওপর ভারতের পূর্ণ অধিকার; পশ্চিমের সিন্ধু, ঝেলাম, চেনাব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে, তবে উৎস ভারতে।
পাকিস্তানের জন্য বিপদ
পানি সংকটে থাকা পাকিস্তান কৃষি ও মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাবের শঙ্কা দেখছে; অতিবৃষ্টির মৌসুমে ভারত পূর্বের নদীগুলোর অতিরিক্ত পানি হঠাৎ ছেড়ে দিলে বন্যা হতে পারে।
ভারতের লাভ‑ক্ষতি
বিশেষজ্ঞদের মতে, অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা পাবে দিল্লি; আন্তর্জাতিক মহল মূলত সীমান্ত সংঘাতে নজর দেবে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে গেলে নতুন সমঝোতার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
পাকিস্তানে দ্রুতই ভারত‑বিরোধী ক্ষোভ বেড়েছে; লাহোরে প্রতিবাদ সমাবেশে উগ্রপন্থি নেতা বলেছেন, “এটি ভারতের জল‑সন্ত্রাস।”
রিপোর্টিংয়ে সহায়তা করেছেন হরি কুমার, শওকত নন্দা, জিয়া উর‑রহমান ও সালমান মাসুদ।