সারাক্ষণ রিপোর্ট
চীনের গার্মেন্ট খাত বহু বছর ধরে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এসেছে। বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে চীন তার উৎপাদন দক্ষতা, সস্তা শ্রম, এবং করমুক্ত বাণিজ্য সুবিধার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের খুচরা বিক্রেতাদের নির্ভরযোগ্য যোগানদাতা হয়ে উঠেছিল।
তবে সাম্প্রতিক বাণিজ্য নীতিগত পরিবর্তন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা চীনের এই প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এর ফলে:
চীনের শিল্পনীতি নিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ
চীন এখন ‘অ্যাডভান্সড টেকনোলজি’ভিত্তিক উৎপাদনে জোর দিচ্ছে (যেমন: চিপ, ইভি, ড্রোন), কিন্তু গার্মেন্টের মতো ঐতিহ্যবাহী শ্রমনির্ভর খাতগুলো অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে উৎসাহ দিলেও, বাস্তবতা হলো, জনগণের ব্যয়ক্ষমতা ও আস্থা কম থাকায় এ উদ্যোগ খুব বেশি সফল হচ্ছে না।
আঞ্চলিক স্থানান্তরের গতি বাড়ছে
চীনা শিল্পকারখানাগুলো খরচ কমাতে ভিয়েতনাম, কেম্বোডিয়া, এমনকি চীনের ভেতরের সস্তা প্রদেশগুলোতে স্থানান্তরের কথা ভাবছে। এর ফলে চীনের গার্মেন্ট খাত ধীরে ধীরে ‘কেন্দ্র’ থেকে ‘সরবরাহকারীর’ ভূমিকায় পরিণত হতে পারে—যেখানে তারা নকশা ও প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দেবে, উৎপাদন ছড়িয়ে পড়বে অন্যত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের করনীতি বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলছে
এক সময় করমুক্ত সুবিধা থাকায় মার্কিন প্ল্যাটফর্মগুলো চীনের কারখানাগুলোর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করত। এখন সেই সম্পর্ক ছিন্ন হচ্ছে। এতে শুধু চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ছোট ও মাঝারি ব্যবসার ওপরও প্রভাব পড়ছে যারা এসব প্ল্যাটফর্মে চীনা পণ্য বিক্রি করত।
ভোক্তার চাহিদা কোথায় যাবে?
যদিও শুল্ক বেড়েছে, অনেক ভোক্তা এখনো সস্তা চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে তারা হয়তো বিকল্প বাজার খুঁজবে, অথবা অবশেষে চীনের ওপর নির্ভরতা বজায় রাখবে—শর্তসাপেক্ষে।
নতুন বিশ্ববাণিজ্য বাস্তবতা
চীনের তৈরি পোশাক খাত বিশ্ববাজারে সস্তা শ্রম ও উৎপাদন সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে বহু বছর ধরে টিকে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা বাজার ছিল এর প্রধান গন্তব্য। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধ এখনো পুরোমাত্রায় চলছে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও শুল্ক বেড়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর শতভাগের বেশি হারে শুল্ক আরোপ করছে কিছু কিছু পণ্যে, যার নেতিবাচক প্রভাব চীনের রপ্তানিনির্ভর শিল্পে পড়েছে।
বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম পোজেন (প্রেসিডেন্ট, Peterson Institute for International Economics) বলেন,
“চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বিচ্ছিন্নতা যদি ঘটে, তাহলে গার্মেন্ট এবং ইলেকট্রনিকস খাতে বড় ধরনের রদবদল আসবে। এটি কেবল উৎপাদনে নয়, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনেই কাঠামোগত পরিবর্তন আনবে।”
কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে, সামাজিক প্রভাব স্পষ্ট
গার্মেন্ট শিল্প চীনে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করে। গুয়াংজু, চেংডু ও হুবেইয়ের মতো অঞ্চলে এই খাত মূলত নিম্নশ্রেণির শ্রমিকদের জন্য একমাত্র জীবিকার উৎস। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ হওয়া, অর্ডার কমে যাওয়া, আর নতুন শুল্ক বাধার কারণে এখন এই খাত হুমকির মুখে।
বেইজিং ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী লিন চাও বলেন,
“গার্মেন্ট সেক্টরের পতনের অর্থ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি চীনের অভ্যন্তরীণ বেকারত্বের হারকে বাড়াবে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়াবে।”
সরবরাহ চেইন বৈচিত্র্যকরণ: চীন কি পিছিয়ে পড়ছে?
বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন “চীন প্লাস ওয়ান” নীতিতে চলতে শুরু করেছে—অর্থাৎ চীনের পাশাপাশি অন্য একটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি করা। এই কারণে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ভারত ও মেক্সিকোর মতো দেশ চীনের বাজার হারানোর সম্ভাবনায় নতুন সম্ভাবনার মুখোমুখি হচ্ছে।
দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (EIU)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:
“২০২৪-২৫ সালের মধ্যে চীন থেকে পোশাক উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ কমে যেতে পারে, যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পক্ষে যাবে।”
তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীনের অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমশক্তি ও উৎপাদন দক্ষতা এখনো অতুলনীয়—তাই পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া সহজ হবে না।
আমেরিকার করনীতির ভবিষ্যৎ: স্বল্পমূল্যের পণ্যের গন্তব্য কোথায়?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদিন প্রায় ৪ মিলিয়ন কমদামি পণ্য শুল্কছাড়ে আমদানি হচ্ছিল—এর বড় অংশই চীন থেকে। এখন এই কর সুবিধা বাতিল হলে প্রশ্ন উঠছে: আমেরিকানরা এই সস্তা পণ্য কোথা থেকে কিনবে?
বিশ্বের অন্যতম বড় ই-কমার্স বিশেষজ্ঞ বেঞ্জামিন ক্যাভেন্ডার (China Market Research Group) বলেন,
“যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা অভ্যাস এক রাতেই বদলাবে না। তারা এখনো ১ ডলারের মোজা, ৫ ডলারের পোশাক খোঁজে। ফলে, পুরো কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাস না হলে চীনকে বাদ দিয়ে নতুন সাপ্লাই চেইন গড়া কঠিন।”
ভবিষ্যতের পথে: চীনের জন্য তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ
১. বাণিজ্য কূটনীতি: যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করা না গেলে রপ্তানি আরও কমবে।
২. অভ্যন্তরীণ চাহিদা: জনগণের খরচ করার ক্ষমতা না বাড়লে দেশীয় বিক্রি দিয়ে রপ্তানির ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
৩. নতুন উৎপাদন কাঠামো: কারখানা স্থানান্তর বা প্রযুক্তি সংহতকরণের মাধ্যমে গার্মেন্ট খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে হবে।
চীনের গার্মেন্ট খাত এখন বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়—বরং শ্রম, সামাজিক স্থিতি ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত বহন করছে। চীন যদি কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তি অভিযোজনের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতেও তাদের প্রভাব বজায় থাকবে। নতুবা, ধীরে ধীরে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন গন্তব্যদের কাছে বাজার হারাবে।
বাস্তবে চীনের গার্মেন্ট খাত এখন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে তাদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা নয়, আন্তর্জাতিক নীতি ও প্রযুক্তি অভিযোজনেও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায়, চীনের বহু কারখানা হয় স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, নয়তো ধীরে ধীরে চীনের বাইরে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে।