সারাক্ষণ রিপোর্ট
বুড়িগঙ্গা নদী এক সময় ঢাকা নগরের প্রাণ ছিল। রাজধানীর অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জনজীবন এই নদীকেন্দ্রিকভাবে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু গত ৫০ বছরের উন্নয়ন, অব্যবস্থাপনা ও দূষণের কারণে আজ এই নদী অস্তিত্ব সংকটে। এই প্রতিবেদনে আমরা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রেক্ষিতে বুড়িগঙ্গার বাস্তবতা বিশ্লেষণ করেছি।
অতীতের বুড়িগঙ্গা: ঢাকাবাসীর জীবনরেখা
১৭শ ও ১৮শ শতকে, ঢাকা শহর গড়ে উঠেছিল বুড়িগঙ্গার তীরে। মোগল আমলে নদীটি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। বিশাল বন্দর এলাকায় ঘাটে ঘাটে ভিড় করত বড় বড় নৌকা ও জাহাজ।
১৯৭০-এর দশকেও বুড়িগঙ্গা ছিল পরিষ্কার, টলটলে পানির একটি প্রবাহ। নদীর পানি ব্যবহৃত হতো গোসল, কাপড় ধোয়া, এমনকি পান করার জন্যও। পুরান ঢাকার মানুষজন প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় এই নদীর উপর নির্ভর করতেন।
নৌযান চলাচল ছিল ব্যাপক—ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে পণ্য পরিবহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল বুড়িগঙ্গা।
নদীর অবক্ষয়ের শুরু: উন্নয়নের ছায়ায় বিনাশ
১৯৮০-এর দশকে ঢাকা দ্রুত নগরায়নের পথে এগোয়। শিল্পকারখানা, বিশেষ করে হাজারিবাগের চামড়া শিল্প এবং কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টস, তাদের বর্জ্য ফেলার জন্য বুড়িগঙ্গাকেই ব্যবহার করতে থাকে।
১৯৯০-এর দশকে নদীতে বাড়তে থাকে বিষাক্ত রাসায়নিক ও অপরিশোধিত বর্জ্যের প্রবাহ। একই সময়ে, হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও বাজার বসে নদীর পাড়ে। ঢাকা শহরের নিকাশী ব্যবস্থার অভাবের কারণে বহু নালা সরাসরি নদীতে মিলিত হতে শুরু করে।
এই সময় থেকে বুড়িগঙ্গার পানি ধীরে ধীরে কালচে রঙ ধারণ করে এবং দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে।
বর্তমানের বাস্তবতা: এক মৃত্যুপথে চলা নদী
২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গার অবস্থা উদ্বেগজনক:
- পানির অবস্থা: নদীর পানি এখন এতটাই দূষিত যে তাতে মাছ বাঁচে না। ৬০,০০০ ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য প্রতিদিন নদীতে ফেলা হয়।
- নর্দমা সংযোগ: রাজধানীর অন্তত ২৫০টি স্যুয়ারেজ লাইন সরাসরি নদীতে মিলিত হচ্ছে।
- সামাজিক প্রভাব: আশেপাশে বসবাসকারী মানুষরা চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছেন।
- প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বিলুপ্ত: আগে যেখানে ডলফিন, নানা প্রজাতির মাছ ও জলজ উদ্ভিদ ছিল, এখন সেগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও সীমাবদ্ধতা
সরকার বিভিন্ন সময় নদী উদ্ধারে অভিযান চালালেও তা ধারাবাহিক নয়। যেমন—নদীর তীরে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, হাঁটার পথ নির্মাণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণ ইত্যাদি।
কিন্তু বর্জ্য পরিশোধনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় মূল সমস্যাগুলো এখনো অটুট রয়ে গেছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও সুপারিশ
বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হলে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কিছু সুপারিশ:
বর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা: শিল্পাঞ্চলের জন্য কমন ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (CETP) কার্যকরভাবে চালু করতে হবে।
নর্দমা বিচ্ছিন্নকরণ: শহরের স্যুয়ারেজ সিস্টেমকে নদী থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
নদীর তীরভূমি পুনর্দখল: জনসচেতনতা ও কঠোর আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে নদীর পাড়ের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে।
নিয়মিত পানি বিশ্লেষণ ও জরিপ: নদীর পানির গুণগত মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।
শিক্ষা ও সচেতনতা: তরুণ প্রজন্মকে নদীর গুরুত্ব ও পরিবেশবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে স্কুল-কলেজে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন দরকার।
বুড়িগঙ্গা শুধু একটি নদী নয়; এটি ঢাকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতীক। এই নদীকে বাঁচানো মানেই ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই ও স্বাস্থ্যকর নগর গড়ে তোলা। ৫০ বছর আগের যে নদী মানুষকে জীবনের স্বস্তি দিত, আজ সে মানুষদের রোগ দিচ্ছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বুড়িগঙ্গা শুধুই হয়ে থাকবে ইতিহাসের একটি করুণ অধ্যায়।