০৫:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

প্রথম পর্ব: ঈদ আসছে আর আমি ভাত জোটাতে পারছি না

আশা ভরসাহীন ঈদ

গত ছয় মাসে দেশের পোশাক খাত ভয়াবহ ধাক্কা খেয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈদেশিক ক্রেতাদের অর্ডার বাতিল, উৎপাদন খরচের ঊর্ধ্বগতি, শ্রমিক অসন্তোষ ও বিদ্যুৎ–জ্বালানি সংকটের মতো একাধিক কারণ মিলে বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক কারখানা। গাজীপুর, সাভার, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ—এই সব পোশাকশিল্পকেন্দ্রিক এলাকায় চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক।

এই শ্রমিকদের অনেকেই এখনও শেষ মাসের বেতন পাননি, পাওনা গ্র্যাচুইটি বা উৎসব ভাতা তো বহু দূরের কথা। সেই বাস্তবতায়, ২০২৫ সালের ঈদুল আজহা এই বিশাল সংখ্যক পরিবারের কাছে শুধু এক ‘অন্যের আনন্দ’ হয়ে এসেছে।

ঈদ আসছেআর আমি ভাতই জোটাতে পারছি না

গাজীপুর চৌরাস্তার পাশে একটা ছোট ঘরে থাকেন রেশমা আক্তার (২৯)। তিন সন্তানের মা। জানুয়ারিতে তার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ মাস ধরে বেকার। স্বামীও অস্থায়ী শ্রমিক, দিনে যেদিন কাজ পায়, সেদিন ৩০০–৪০০ টাকা আসে।

রেশমা বললেন, “ঈদ আসছে, আর আমি এখনো বুঝতে পারছি না ওইদিন ভাত রান্না হবে কিনা। ছোট ছেলেটা তো কোরবানির মাংসের জন্য কান্নাকাটি করছে। ওর কি দোষ?”

তার কণ্ঠে কোনো ক্ষোভ নেই, আছে হাল ছেড়ে দেওয়া এক ধরনের ক্লান্তি। ঈদ মানে যেখানে নতুন জামা, খুশির রান্না আর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটানো—সেখানে তাদের জন্য ঈদ মানে হচ্ছে বেঁচে থাকার যুদ্ধ।

কারখানা বন্ধস্বপ্নও বন্ধ

ঢাকার আশুলিয়ায় কাজ করতেন আনোয়ার হোসেন (৩৫)। মার্চ মাসে হঠাৎ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আনোয়ার কোনো বকেয়া পাননি। ঈদের আগে অন্তত কিছু পেলেও তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়ি যেতেন।

“আমি কারখানায় ৮ বছর কাজ করেছি। একদিনও অনুপস্থিত হইনি। এখন ঈদের আগেই ঘরভাড়া দিতে পারি না, চাল কিনতে পারি না। ঈদ কি শুধু বড়লোকদের জন্য?”—বলছিলেন আনোয়ার।

তার গলায় অভিমান মেশানো কষ্ট—‘শ্রমিক’ শব্দটি যতটা গর্বের ছিল, এখন তা যেন দয়া করে বাঁচিয়ে রাখা একটি শ্রেণির পরিচয়।

ঈদের আগে ঝাঁপ বন্ধ

অনেক নারী শ্রমিক বলছেন, তারা ঈদের আগে অন্তত একটি বেতন বা বোনাস আশা করেছিলেন, যেন একটি জামা কিনে সন্তানকে খুশি করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা—বাড়িওয়ালা ঈদের আগেই ভাড়া চাচ্ছে, দোকানি বাকিতে চাল দিতে নারাজ, আর সন্তান প্রশ্ন করছে, “আমরা কি গরিব?”

ফারজানা নামের এক নারী শ্রমিক বলেন, “আমার মেয়ে স্কুলে ঈদের নতুন জামার কথা বলছে। আমি তাকে কী বলব? আমি তো এখন টং দোকানে চা বিক্রি করছি।”

রাষ্ট্র কোথায়?

যে পোশাক খাত দেশে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখে, সেই খাতের শ্রমিকদের জন্য ঈদের আগে সরকার কোনো জরুরি সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেনি। কিছু বেসরকারি সংগঠন খাবারের প্যাকেট দিচ্ছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, “ঈদের আগেই প্রত্যেক শ্রমিককে তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং একটি নগদ সহায়তা দেওয়া উচিত ছিল। শ্রমিক বাঁচলে তবেই শিল্প টিকবে।”

কোরবানি নয়টিকে থাকার চেষ্টা

চাকরি হারানো শ্রমিকদের জন্য কোরবানি এখন বিলাসিতা। অনেকেই ঈদের দিন হয়তো কোনো আত্মীয় বা এলাকার বিত্তবানদের দেওয়া সামান্য মাংসে সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করবেন। কিছু পরিবার পুরো ঈদে একবেলার বেশি ভালো খাবারও জোগাড় করতে পারবে না।

তবুও কিছু শ্রমিক বলছেন, “হয়তো একদিন আবার কাজ পাবো। ঈদের পরই নতুন চেষ্টা করব।” এই আশা নিয়েই তারা ঈদের দিনটিকে কাটিয়ে দিতে চান—চোখের পানি লুকিয়ে।

প্রথম পর্ব: ঈদ আসছে আর আমি ভাত জোটাতে পারছি না

০৬:১৯:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫

আশা ভরসাহীন ঈদ

গত ছয় মাসে দেশের পোশাক খাত ভয়াবহ ধাক্কা খেয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈদেশিক ক্রেতাদের অর্ডার বাতিল, উৎপাদন খরচের ঊর্ধ্বগতি, শ্রমিক অসন্তোষ ও বিদ্যুৎ–জ্বালানি সংকটের মতো একাধিক কারণ মিলে বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক কারখানা। গাজীপুর, সাভার, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ—এই সব পোশাকশিল্পকেন্দ্রিক এলাকায় চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক।

এই শ্রমিকদের অনেকেই এখনও শেষ মাসের বেতন পাননি, পাওনা গ্র্যাচুইটি বা উৎসব ভাতা তো বহু দূরের কথা। সেই বাস্তবতায়, ২০২৫ সালের ঈদুল আজহা এই বিশাল সংখ্যক পরিবারের কাছে শুধু এক ‘অন্যের আনন্দ’ হয়ে এসেছে।

ঈদ আসছেআর আমি ভাতই জোটাতে পারছি না

গাজীপুর চৌরাস্তার পাশে একটা ছোট ঘরে থাকেন রেশমা আক্তার (২৯)। তিন সন্তানের মা। জানুয়ারিতে তার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ মাস ধরে বেকার। স্বামীও অস্থায়ী শ্রমিক, দিনে যেদিন কাজ পায়, সেদিন ৩০০–৪০০ টাকা আসে।

রেশমা বললেন, “ঈদ আসছে, আর আমি এখনো বুঝতে পারছি না ওইদিন ভাত রান্না হবে কিনা। ছোট ছেলেটা তো কোরবানির মাংসের জন্য কান্নাকাটি করছে। ওর কি দোষ?”

তার কণ্ঠে কোনো ক্ষোভ নেই, আছে হাল ছেড়ে দেওয়া এক ধরনের ক্লান্তি। ঈদ মানে যেখানে নতুন জামা, খুশির রান্না আর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটানো—সেখানে তাদের জন্য ঈদ মানে হচ্ছে বেঁচে থাকার যুদ্ধ।

কারখানা বন্ধস্বপ্নও বন্ধ

ঢাকার আশুলিয়ায় কাজ করতেন আনোয়ার হোসেন (৩৫)। মার্চ মাসে হঠাৎ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আনোয়ার কোনো বকেয়া পাননি। ঈদের আগে অন্তত কিছু পেলেও তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়ি যেতেন।

“আমি কারখানায় ৮ বছর কাজ করেছি। একদিনও অনুপস্থিত হইনি। এখন ঈদের আগেই ঘরভাড়া দিতে পারি না, চাল কিনতে পারি না। ঈদ কি শুধু বড়লোকদের জন্য?”—বলছিলেন আনোয়ার।

তার গলায় অভিমান মেশানো কষ্ট—‘শ্রমিক’ শব্দটি যতটা গর্বের ছিল, এখন তা যেন দয়া করে বাঁচিয়ে রাখা একটি শ্রেণির পরিচয়।

ঈদের আগে ঝাঁপ বন্ধ

অনেক নারী শ্রমিক বলছেন, তারা ঈদের আগে অন্তত একটি বেতন বা বোনাস আশা করেছিলেন, যেন একটি জামা কিনে সন্তানকে খুশি করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা—বাড়িওয়ালা ঈদের আগেই ভাড়া চাচ্ছে, দোকানি বাকিতে চাল দিতে নারাজ, আর সন্তান প্রশ্ন করছে, “আমরা কি গরিব?”

ফারজানা নামের এক নারী শ্রমিক বলেন, “আমার মেয়ে স্কুলে ঈদের নতুন জামার কথা বলছে। আমি তাকে কী বলব? আমি তো এখন টং দোকানে চা বিক্রি করছি।”

রাষ্ট্র কোথায়?

যে পোশাক খাত দেশে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখে, সেই খাতের শ্রমিকদের জন্য ঈদের আগে সরকার কোনো জরুরি সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেনি। কিছু বেসরকারি সংগঠন খাবারের প্যাকেট দিচ্ছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, “ঈদের আগেই প্রত্যেক শ্রমিককে তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং একটি নগদ সহায়তা দেওয়া উচিত ছিল। শ্রমিক বাঁচলে তবেই শিল্প টিকবে।”

কোরবানি নয়টিকে থাকার চেষ্টা

চাকরি হারানো শ্রমিকদের জন্য কোরবানি এখন বিলাসিতা। অনেকেই ঈদের দিন হয়তো কোনো আত্মীয় বা এলাকার বিত্তবানদের দেওয়া সামান্য মাংসে সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করবেন। কিছু পরিবার পুরো ঈদে একবেলার বেশি ভালো খাবারও জোগাড় করতে পারবে না।

তবুও কিছু শ্রমিক বলছেন, “হয়তো একদিন আবার কাজ পাবো। ঈদের পরই নতুন চেষ্টা করব।” এই আশা নিয়েই তারা ঈদের দিনটিকে কাটিয়ে দিতে চান—চোখের পানি লুকিয়ে।