হঠাৎ বন্যায় তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপটি গত বৃহস্পতিবার রাতে সাগর দ্বীপ ও কেপুপাড়া উপকূলে আঘাত হানে। এর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরা, বরিশালসহ পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অতিভারী বৃষ্টিপাত ও হঠাৎ বন্যার সৃষ্টি হয়। শুক্রবার সকাল থেকে এসব অঞ্চলের হাজারো গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
ধান, শাকসবজি ও রবি শস্যের ব্যাপক ক্ষতি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুধু খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে ২ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমির ধান, বাদাম, মরিচ, পেঁয়াজ, টমেটো, করলা, শসা এবং অন্যান্য মৌসুমি সবজি পানির নিচে চলে গেছে। অনেক এলাকায় রোপা আমনের ধান পাকার মুখে ছিল, যা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
একজন কৃষক, সাতক্ষীরার তালার বাসিন্দা সাইফুল হোসেন বলেন,
“চোখের সামনে আমার দুই একরের ধান তলিয়ে গেল। বাড়ির উঠোনে রাখা ধান শুকানোর সুযোগ পর্যন্ত পেলাম না। এ বছর ঈদের পর ধার দেনায় চলতে হবে।”
ঘরবাড়ি ও অবকাঠামোতেও বিপর্যয়
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানিয়েছে, বরগুনা, ভোলা, খুলনা ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অংশে কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে অন্তত ১৬ হাজার। অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে গ্রামাঞ্চলে।
বরগুনার আমতলী উপজেলার আমড়া গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম বলেন,
“ঘরটুকু আর রইল না। দুই ঘণ্টার মধ্যে পানি এসে সব নিয়ে গেল। বাচ্চাদের কোলে নিয়ে এখন আশ্রয়কেন্দ্রে আছি।”
সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, দুর্গম এলাকা যোগাযোগহীন
চট্টগ্রাম ও বরিশালের বেশ কিছু উপজেলার গ্রামীণ সড়ক ও কাঁচা রাস্তাগুলো ভেঙে পড়েছে। রাঙ্গুনিয়া, পেকুয়া, উজিরপুর ও কলাপাড়ার প্রায় ৪৫টি পয়েন্টে পানি উঠে গেছে সড়কে, যান চলাচল বন্ধ। কক্সবাজারের পেকুয়ায় পাহাড়ি ঢলে কয়েকটি বেইলি ব্রিজ ধসে পড়েছে।
ক্ষতির আনুমানিক চিত্র
ক্ষতির ধরন | ক্ষতির পরিমাণ (প্রাথমিক হিসেবে) |
কৃষি জমি প্লাবিত | ২,৮০,০০০ হেক্টর |
কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে | ১৬,০০০+ |
স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত | ৩৫০+ |
সড়ক ও সেতু ভেঙে গেছে | ১২০+ পয়েন্ট |
আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত মানুষ | ১,৭০,০০০+ |
উদ্ধার ও সহায়তা কার্যক্রম
বিভিন্ন জেলা প্রশাসন জানায়, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ড মোতায়েন রয়েছে। তবে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন, সেসব জায়গার তথ্য এখনও সংগ্রহ করা যায়নি।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. ফখরুজ্জামান জানান,
“বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১০০ টন চাল, ৫০০০ প্যাকেট শুকনা খাবার ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আরও সহায়তা প্রক্রিয়াধীন।”
আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও আগামী দিনের শঙ্কা
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, নিম্নচাপটি এখন স্থলভাগে দুর্বল হয়ে গেলেও এর বর্ধিত অংশ এখনও বাংলাদেশজুড়ে সক্রিয় রয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা দেশজুড়ে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। পাহাড়ি এলাকায় আরও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন প্রয়োজন
এই হঠাৎ বন্যা শুধু স্বল্পমেয়াদি বিপর্যয় নয়, কৃষি, বাসস্থান ও শিক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি জেলার জন্য দ্রুত প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করে পুনর্বাসনের বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।