লনার নিম্নাঞ্চলের বুকে বর্ণাঢ্য শস্যচাষের একসময় সোনালী অধ্যায় ছিল—ধানক্ষেতের শ্যামল রেখা, কলাবাগানের ঝর্ণাধার, ভুট্টার সোনালি গ্রন্থি আর নানা রঙের শাকসবজির সারি। সেই জমিতে আজকের চিত্র যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার আভাস: লবণজলে প্রতিনিয়ত সিক্ত হয়ে উঠছে চিংড়ি পুকুর, আর পুরনো ফসলেরা পরিচ্ছন্নতা হারিয়ে অতীতের স্মৃতিতে ছায়া ফেলে।
গত দশক জুড়ে হয়ে উঠেছে চিংড়ি বিপ্লব। ঝড়ের গতিতে বেড়েছে চিংড়ি চাষের পুকুর, অর্থনৈতিক উৎসাহকেই প্রধান প্রেরণা হিসেবে নিয়েছে স্থানীয় কৃষক। কিন্তু এই লাভের সঙ্গে পিছনে ফেলে এসেছে ভাত, শাকসবজি ও মৌসুমী ফলের রসালো বৈচিত্র্য—যে ফসলগুলো একসময় বাজার এবং ঘরের খাদ্যতালিকাকে সুষম করে তুলত। ফলস্বরূপ, গৃহস্থ শিশুদের চলছে মৌসুমী ফলাবর্জনার দুঃখ—সেসব আম, লিচু, বিভিন্ন ফল এখন ইতিহাসের পাতায় রূপ নিয়েছে।
এই পাঁচ পর্বের সিরিজে আমরা অনুসন্ধান করবো: কী করে খুলনার কৃষকদের জীবিকা বদলে দিয়েছে চিংড়ির উচ্চমূল্য; হারিয়ে যাওয়া ফসলগুলো ফিরিয়ে আনতে কি কোনো পথ রয়েছে; খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সংকটের মুখে গ্রামের মানুষদের সংগ্রাম; পাশাপাশি পরিবেশগত প্রভাব, সামুদ্রিক লবণের ছোঁয়া আর সরকারের কৃষি নীতি কতটা ভূমিকা রাখছে এই পরিবর্তনে। থাকছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের গল্প এবং বাস্তবতার চিত্র, যার আলোকে আমরা তুলে ধরব চিংড়ি চাষের অজানা দিক এবং সম্ভাব্য সমাধান।
শরতের শেষে ঘূর্ণিঝড় ‘মাধব’-এর জলোচ্ছ্বাস এলে কয়রা ও দাকোপের চরাঞ্চলে প্রায় ৫ হাজার চিংড়িঘের ভেসে গিয়েছিল। মাটি-পানির লবণমাত্রা বেড়েছে ২৮ ডেসি/মি—যেখানে ধানের সহনশীলতা সর্বোচ্চ ১২ ডেসি/মি। জলবায়ু পরিবর্তনের তাপে নদীর তলদেশে বৃষ্টিপাত-ঘাটতি ও সমুদ্রস্তর বৃদ্ধির যৌথ আক্রমণে মিঠাজল পেছাচ্ছে আরও ভেতরে।
খুলনার রূপসা নদীর পাড়ে ২৯ বছর বয়সী তরুণ চাষি বিপ্লব শেখ এবার প্রথমবারের মতো ‘রাইস-শ্রিম্প-রাইস’ মডেলে নেমেছেন: বর্ষাকালে ধান, শীতকালে ভ্যানামি চিংড়ি, মাঝামাঝি শাক-সবজি। স্থানীয় এনজিও ‘খুলনা কোস্টাল রেজিলিয়েন্স’ তাঁকে লবণ-সহিষ্ণু ধানবীজ, টিউবওয়েল-ভিত্তিক সেচ ও সোলার পাম্প দিয়েছে। “একঘরে চিংড়ি নয়, তিন পণ্যেই লাভ,”—তার হিসাব।
এ ধরনের সমন্বিত পদ্ধতির সফলতা এখনো বিচ্ছিন্ন হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে লবণ ৬-১০ ডেসি/মি থাকলে ধান-চিংড়ি-সবজি একই সিস্টেমে সম্ভব। প্রকল্পভিত্তিক কৃষক প্রশিক্ষণ ও স্বল্পসুদে পুনরুদ্ধার ঋণ থাকলে পাঁচ বছরে খুলনায় এমন মডেল ৩০ শতাংশ জমিতে ছড়ানো যাবে।
সরকারও নীতিগত পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে। মৎস্য মন্ত্রণালয়ের খসড়া নীতিমালায় পরিবেশ-সমীক্ষা ছাড়া নতুন ঘেরের অনুমতি বন্ধ, পুরনো ঘেরে তিন বছর অন্তর মাটি-পরীক্ষা ও বাজেট-সহায়তায় মিঠা পানি ঢুকিয়ে জমি পুনর্জীবিত করার প্রস্তাব রয়েছে। একই সঙ্গে প্রবাল প্রযুক্তি-নির্ভর হ্যাচারি বাড়িয়ে বন্য পোস্ট-লার্ভা আহরণ বন্ধের পরিকল্পনা চলছে।
কৃষকেরা চাইছেন স্থায়ী বাঁধ-নালা সংস্কার ও চিকিৎসা-সুবিধা। কারণ জলোচ্ছ্বাস-সাইক্লোনে ঘের ভেসে গেলে কেবল ফসলের ক্ষতি নয়, পানিবাহিত রোগও বাড়ে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র দূরে হওয়ায় ক্ষুদ্রঋণ শোধের চাপের সঙ্গে চিকিৎসা-খরচ আরেক দুঃস্বপ্ন।
অবশেষে কথা ওঠে ‘মাটির ঋণ’ শোধের—লবণাক্তকারীদের মাটি ফের উর্বর করতে ৫-১০ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে মিঠাজল, সবুজ সার ও ধুনা কিউলাইট প্রয়োগ চাই। সে পথে হাঁটছেন মুক্তা রানী মণ্ডল: “আজকে চিংড়ি তুলে আগামী মৌসুমে ধান বুনবো; ছেলেমেয়েদের যেন নিজেদের ধানের ভাত খেতে পারি, সেই স্বপ্ন দেখি।”
লবণাক্ত কাঁটাভরা বাস্তবতার মাঝেও কৃষকের এই স্বপ্নই খুলনার কৃষি-অর্থনীতির নতুন পথের দিশা দেখাচ্ছে। টেকসই সমন্বয়মূলক ব্যবস্থাপনার সঠিক সহায়তা পেলে খুলনার খেত আবার সবুজ হবে—এ বিশ্বাসেই শেষ হলো আমাদের পাঁচ পর্বের অনুসন্ধান।