বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার হ্রাসে টিকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান
হাম একসময় ছিল শিশুদের জন্য সবচেয়ে সাধারণ ও প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগগুলোর একটি। মাত্র ৬০ বছর আগে, পৃথিবীর ৯০ শতাংশের বেশি শিশু এই রোগে আক্রান্ত হতো। উপসর্গ দেখা দিলে প্রতি চারজনের একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হতো। তবে ১৯৬৩ সালে জন এন্ডার্স হামের প্রথম কার্যকর টিকা উদ্ভাবন করার পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে।
শুরুতে ধনী দেশগুলোতে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় এবং ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। গত ৫০ বছরে এই টিকাদান কার্যক্রমের ফলে আনুমানিক ৯ কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে।
বিশ্লেষণ: হামের ঝুঁকি কমেছে বিশগুণ
বিশ্বজুড়ে ১০০টির বেশি গবেষণার বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, টিকা নেওয়ার ফলে হামে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২০ গুণ কমে যায়। যদিও উন্নত চিকিৎসা, পুষ্টি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে হামের মৃত্যু আগে থেকেই কিছুটা কমছিল, তবে এতে রোগের সংক্রমণ রোধ হয়নি। কারণ হাম একটি বায়ুবাহিত ভাইরাস; তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উন্নতিতে এর ছড়ানো থামে না।
ভ্যাকসিন আসার আগ পর্যন্ত, প্রায় প্রতিটি শিশুই একবার হলেও হামে আক্রান্ত হতো। সেই সময় শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর ৫০ হাজারের মতো শিশু হাসপাতালে ভর্তি হতো এবং শত শত মৃত্যু হতো।
দরিদ্র দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি
আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো দরিদ্র অঞ্চলে ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ হামে মারা যেত। এসব দেশে আক্রান্ত শিশুদের ৫ থেকে ১০ শতাংশ মারা যেত, যা ধনী দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
২০০০-এর দশকে ব্যাপক টিকাদান কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এসব অঞ্চলে হামের মৃত্যুহার নাটকীয়ভাবে কমে যায়। এই বিশ্বব্যাপী টিকাদান প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সফল জনস্বাস্থ্য কার্যক্রমগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
টিকাদান কভারেজের উন্নয়ন: এক নজরে
১৯৮০-এর দশকে এক বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রথম ডোজ হামের টিকা নেওয়ার হার ছিল খুবই কম, বিশেষ করে আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। ১৯৭০-এর দশকে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ “Expanded Programme on Immunisation” নামে একটি প্রকল্প শুরু করে, যার ফলে ২০০০ সালের শুরুতে ৯ কোটির বেশি শিশু টিকার আওতায় আসে — যা তখনকার প্রায় ৬০ শতাংশ নবজাতকের সমান।
তবুও বিপুলসংখ্যক শিশু টিকার বাইরে থেকে যায়, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর শিশুরা। এই ব্যবধান পূরণের লক্ষ্যে ২০০০ সালে গঠন করা হয় ‘গ্যাভি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স’। এর ফলে এখন বছরে ১০ কোটির বেশি শিশু হামের টিকা পাচ্ছে — যা বিশ্বজুড়ে ৮০ শতাংশেরও বেশি শিশু কভার করছে।
কোথায় কত প্রাণ বাঁচল?
আঞ্চলিকভাবে হামের টিকা সবচেয়ে বেশি প্রাণ বাঁচিয়েছে আফ্রিকায় — প্রায় ২.৯ কোটি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় — প্রায় ২ কোটি। এই দুই অঞ্চলেই হাম ছিল শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ।
এই সাফল্য প্রমাণ করে, সময়মতো ও সমানভাবে টিকা পৌঁছানো গেলে বিপুলসংখ্যক শিশু মৃত্যুরোধ সম্ভব। এখনও যেসব এলাকায় টিকার প্রাপ্যতা কম, সেগুলোতে আরও কার্যকর প্রচার ও সহযোগিতা দরকার।
উপসংহার
হামের টিকা শুধুই একটি চিকিৎসা আবিষ্কার নয়; এটি মানবজাতির জনস্বাস্থ্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সাফল্য। সারা পৃথিবীতে ৯ কোটিরও বেশি প্রাণ বাঁচিয়ে এটি দেখিয়েছে, সমন্বিত ও ন্যায্য টিকাদান কর্মসূচি কীভাবে একটি প্রাণঘাতী রোগকে কার্যত নির্মূল করতে পারে। এখন দরকার আরও বেশি জোরালো উদ্যোগ, যাতে কোনো শিশু এই প্রতিরোধযোগ্য রোগে প্রাণ না হারায়।