০৫:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

টিনের নিচে জীবন—অবিরাম বৃষ্টিতে দুর্বিষহ দিন পার করছেন ফুটপাত ব্যবসায়ীরা

পলিথিনে মোড়া স্বপ্ন: ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের জীবনে বৃষ্টির আঘাত

ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হয়তো চোখে পড়েছে—এক কোণে পলিথিনে মোড়া কিছু মালপত্র, কোনো দোকানি এক হাতে ছাতা ধরে, আরেক হাতে গামছা দিয়ে ভেজা কাপড় মুছছেন। কারও মাথার উপর ভাঙা টিন, আবার কারও দোকান পুরোপুরি ভেসে গেছে বৃষ্টির স্রোতে। দেশের বিভিন্ন শহরে লাগাতার ভারী বৃষ্টির ফলে চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন এসব ফুটপাত ব্যবসায়ীরা।

বৃষ্টি মানেই বেচাবিক্রিতে ভাটা

ঢাকার গুলিস্তান, ফার্মগেট, নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাব কিংবা চট্টগ্রামের জুবলি রোড, খুলনার শিববাড়ি মোড়, রাজশাহীর সাহেববাজার—সব জায়গায় একই চিত্র। পণ্যগুলো ঢেকে রাখতে গিয়ে কষ্টে হাঁসফাঁস করছেন দোকানিরা। অনেকেই বলছেন, দিনের অর্ধেক সময়ই এখন পলিথিন ও বালতি সামলাতে চলে যায়, বেচাবিক্রি প্রায় বন্ধ।

গুলিস্তানের ফুটপাত আবারও বেদখল | প্রথম আলো

গুলিস্তানে জুতা বিক্রেতা আব্দুল কাদের বলেন,
“বৃষ্টিতে দোকানের সামনের রাস্তায় হাঁটু পানি জমে। ক্রেতা তো আসেই না। বরং প্রতিদিন যে তিন-চারশ টাকা রোজগার হতো, এখন উল্টো মাল ভিজে নষ্ট হচ্ছে।”

পেট তো আর বৃষ্টির কথা শোনে না

পাশের ফল বিক্রেতা রওশন আরা ছাতা মাথায় বসে থাকলেও মুখে হতাশা।
“শুধু বৃষ্টি হলে কথা ছিল। কিন্তু রোজ রোজ বৃষ্টি, সেই সঙ্গে বাতাস। কলা-আম সব ভিজে যায়, পচে যায়। অথচ বাড়িতে তিনটা বাচ্চা বসে আছে—ওদের খাবার কোথা থেকে আনব?”

মালপত্র নষ্ট হচ্ছেজমানো টাকা গলছে

ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের মূল সম্পদ তাদের স্টক। আর এই স্টকই এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টির পানি ঢুকে জামা-কাপড়, প্লাস্টিক সামগ্রী, বই, খেলনা, এমনকি খাবারদ্রব্য পর্যন্ত স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, প্রতিদিন অন্তত ৩০–৪০ শতাংশ পণ্য ক্ষতির মুখে পড়ছে।

চট্টগ্রামের এক প্রসাধনী বিক্রেতা বলেন,
“সকালে পণ্য সাজাই, দুপুরে পলিথিনে মুড়িয়ে দিই। আবার সন্ধ্যায় শুকাতে বসাই। এমন করে প্রতিদিনই লোকসান হচ্ছে। এখন পুঁজি শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

অল্প বৃষ্টিতেই নিউমার্কেট এলাকায় হাঁটুপানি, মশার আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা

প্রশাসন বা সাহায্য কোথাও নেই

এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি বা পৌরসভার পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস এখনো পাওয়া যায়নি। স্থানীয়ভাবে কিছু এনজিও শুকনো খাবার বা ত্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটাও পর্যাপ্ত নয়। তার ওপর ফুটপাত ব্যবসায়ী হওয়ায় তাদের অধিকার বা নিরাপত্তা নিয়েও কেউ ভাবছে না।

নিউ মার্কেট এলাকার মো. নাসিম বলেন,
“রাস্তার ওপরে ব্যবসা করি বলে আমাদের কেউ মানুষ ভাবে না। অথচ আমরাও মানুষ, আমরাও ভোট দিই। কেউ একবার এসে জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছি!”

ঈদ সামনেকিন্তু আয় নেই

আর কয়েক সপ্তাহ পরেই ঈদুল আজহা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের বাজারের স্বপ্ন এবার ধুয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতে। ক্রেতা নেই, দোকান চালানো যাচ্ছে না, আগাম পণ্য কিনে এখন বিপাকে পড়েছেন অনেকেই।

রাজশাহীর কাপড় বিক্রেতা জামাল হোসেন বলেন,
“ঈদে অন্তত ৩০–৪০ হাজার টাকা বিক্রির আশা করেছিলাম। এখন তো যা অবস্থা, পাঁচ হাজার টাকাও উঠবে না। টাকা ধার করে মাল এনেছি, এখন কীভাবে শোধ দেব?”

May be an image of 5 people

ফুটপাত ব্যবসায়ীদের জন্য জরুরি সহায়তা প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অন্তত নগদ আর্থিক প্রণোদনা, টেকসই ছাউনি নির্মাণ বা কম খরচে বৃষ্টিনিরোধক সামগ্রী দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এনজিও ‘সিটি লাইফ ফাউন্ডেশন’-এর এক কর্মকর্তা বলেন,
“ফুটপাতের ব্যবসায়ীরাও শহরের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই জলবায়ু দুর্যোগে তাদের টিকিয়ে রাখা জরুরি।”

বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন

বৃষ্টির শব্দ অনেকের কাছে কবিতার মতো, কিন্তু এই মানুষগুলোর জন্য সেটা দুর্ভোগের আর্তনাদ। তারা দাঁড়িয়ে থাকেন, বসে থাকেন, পলিথিনে ঢেকে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখেন। অথচ রাষ্ট্র বা সমাজ তাদের দিকে তাকায় না। এবারের ঈদ হয়তো আসবে, কিন্তু তাদের ঘরে হাসি পৌঁছাবে কিনা—সেটাই প্রশ্ন।

জনপ্রিয় সংবাদ

কুষ্টিয়ায় ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়া: ভোরের হামলায় বাড়ছে উদ্বেগ

টিনের নিচে জীবন—অবিরাম বৃষ্টিতে দুর্বিষহ দিন পার করছেন ফুটপাত ব্যবসায়ীরা

০৬:৪৩:২০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

পলিথিনে মোড়া স্বপ্ন: ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের জীবনে বৃষ্টির আঘাত

ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হয়তো চোখে পড়েছে—এক কোণে পলিথিনে মোড়া কিছু মালপত্র, কোনো দোকানি এক হাতে ছাতা ধরে, আরেক হাতে গামছা দিয়ে ভেজা কাপড় মুছছেন। কারও মাথার উপর ভাঙা টিন, আবার কারও দোকান পুরোপুরি ভেসে গেছে বৃষ্টির স্রোতে। দেশের বিভিন্ন শহরে লাগাতার ভারী বৃষ্টির ফলে চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন এসব ফুটপাত ব্যবসায়ীরা।

বৃষ্টি মানেই বেচাবিক্রিতে ভাটা

ঢাকার গুলিস্তান, ফার্মগেট, নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাব কিংবা চট্টগ্রামের জুবলি রোড, খুলনার শিববাড়ি মোড়, রাজশাহীর সাহেববাজার—সব জায়গায় একই চিত্র। পণ্যগুলো ঢেকে রাখতে গিয়ে কষ্টে হাঁসফাঁস করছেন দোকানিরা। অনেকেই বলছেন, দিনের অর্ধেক সময়ই এখন পলিথিন ও বালতি সামলাতে চলে যায়, বেচাবিক্রি প্রায় বন্ধ।

গুলিস্তানের ফুটপাত আবারও বেদখল | প্রথম আলো

গুলিস্তানে জুতা বিক্রেতা আব্দুল কাদের বলেন,
“বৃষ্টিতে দোকানের সামনের রাস্তায় হাঁটু পানি জমে। ক্রেতা তো আসেই না। বরং প্রতিদিন যে তিন-চারশ টাকা রোজগার হতো, এখন উল্টো মাল ভিজে নষ্ট হচ্ছে।”

পেট তো আর বৃষ্টির কথা শোনে না

পাশের ফল বিক্রেতা রওশন আরা ছাতা মাথায় বসে থাকলেও মুখে হতাশা।
“শুধু বৃষ্টি হলে কথা ছিল। কিন্তু রোজ রোজ বৃষ্টি, সেই সঙ্গে বাতাস। কলা-আম সব ভিজে যায়, পচে যায়। অথচ বাড়িতে তিনটা বাচ্চা বসে আছে—ওদের খাবার কোথা থেকে আনব?”

মালপত্র নষ্ট হচ্ছেজমানো টাকা গলছে

ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের মূল সম্পদ তাদের স্টক। আর এই স্টকই এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টির পানি ঢুকে জামা-কাপড়, প্লাস্টিক সামগ্রী, বই, খেলনা, এমনকি খাবারদ্রব্য পর্যন্ত স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, প্রতিদিন অন্তত ৩০–৪০ শতাংশ পণ্য ক্ষতির মুখে পড়ছে।

চট্টগ্রামের এক প্রসাধনী বিক্রেতা বলেন,
“সকালে পণ্য সাজাই, দুপুরে পলিথিনে মুড়িয়ে দিই। আবার সন্ধ্যায় শুকাতে বসাই। এমন করে প্রতিদিনই লোকসান হচ্ছে। এখন পুঁজি শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

অল্প বৃষ্টিতেই নিউমার্কেট এলাকায় হাঁটুপানি, মশার আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা

প্রশাসন বা সাহায্য কোথাও নেই

এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি বা পৌরসভার পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস এখনো পাওয়া যায়নি। স্থানীয়ভাবে কিছু এনজিও শুকনো খাবার বা ত্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটাও পর্যাপ্ত নয়। তার ওপর ফুটপাত ব্যবসায়ী হওয়ায় তাদের অধিকার বা নিরাপত্তা নিয়েও কেউ ভাবছে না।

নিউ মার্কেট এলাকার মো. নাসিম বলেন,
“রাস্তার ওপরে ব্যবসা করি বলে আমাদের কেউ মানুষ ভাবে না। অথচ আমরাও মানুষ, আমরাও ভোট দিই। কেউ একবার এসে জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছি!”

ঈদ সামনেকিন্তু আয় নেই

আর কয়েক সপ্তাহ পরেই ঈদুল আজহা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের বাজারের স্বপ্ন এবার ধুয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতে। ক্রেতা নেই, দোকান চালানো যাচ্ছে না, আগাম পণ্য কিনে এখন বিপাকে পড়েছেন অনেকেই।

রাজশাহীর কাপড় বিক্রেতা জামাল হোসেন বলেন,
“ঈদে অন্তত ৩০–৪০ হাজার টাকা বিক্রির আশা করেছিলাম। এখন তো যা অবস্থা, পাঁচ হাজার টাকাও উঠবে না। টাকা ধার করে মাল এনেছি, এখন কীভাবে শোধ দেব?”

May be an image of 5 people

ফুটপাত ব্যবসায়ীদের জন্য জরুরি সহায়তা প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অন্তত নগদ আর্থিক প্রণোদনা, টেকসই ছাউনি নির্মাণ বা কম খরচে বৃষ্টিনিরোধক সামগ্রী দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এনজিও ‘সিটি লাইফ ফাউন্ডেশন’-এর এক কর্মকর্তা বলেন,
“ফুটপাতের ব্যবসায়ীরাও শহরের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই জলবায়ু দুর্যোগে তাদের টিকিয়ে রাখা জরুরি।”

বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন

বৃষ্টির শব্দ অনেকের কাছে কবিতার মতো, কিন্তু এই মানুষগুলোর জন্য সেটা দুর্ভোগের আর্তনাদ। তারা দাঁড়িয়ে থাকেন, বসে থাকেন, পলিথিনে ঢেকে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখেন। অথচ রাষ্ট্র বা সমাজ তাদের দিকে তাকায় না। এবারের ঈদ হয়তো আসবে, কিন্তু তাদের ঘরে হাসি পৌঁছাবে কিনা—সেটাই প্রশ্ন।