০১:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

তৃতীয় পর্ব: অভিজাত দুনিয়া থেকে বেকার বাস্তবতায়

সুপরিচিত পরিচয়ে ছেদনতুন পরিচয়: বেকার

দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বনানীর একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন ফারহানা হক। অফিস ছিল গ্লাসঘেরা, ক্লায়েন্ট মিটিং, টিম প্রেজেন্টেশন, আর মাসশেষে নির্ভরযোগ্য বেতন। কিন্তু এপ্রিলের এক সকালে একটি ইমেইল বদলে দিল সব কিছু—“Due to financial restructuring, your position has been made redundant.”

ঈদুল আজহা সামনে। আগে ঈদের সময়টা মানেই ছিল বোনাস, পরিবার নিয়ে বিদেশ সফরের পরিকল্পনা, নতুন পোশাক, উপহার, গরুর কোরবানি। এখন? ফারহানা বলেন, “নতুন জামা কেনা তো দূরের কথা, আমি বাসার খরচ কমাতে বাসার হেল্পিং হ্যান্ডকেও বিদায় করে দিয়েছি।”

একদিন যাদের চাকরি দিতামআজ তাদের সঙ্গে বসে চাকরি খুঁজি

তানভীর রহমান ছিলেন একটি টেলিকম কোম্পানির রিক্রুটমেন্ট হেড। তিনিই একসময় অন্যদের ইন্টারভিউ করতেন, প্রস্তাবনা দিতেন, সিভি যাচাই করতেন। কিন্তু এখন, তিনি নিজেই চাকরির জন্য সিভি পাঠাচ্ছেন, পরিচিতদের ফোন করছেন—“ভাই, কিছু আছে কি?”

“আমি অফিসে বসে একসময় অনেক ক্যান্ডিডেটকে ফিরিয়ে দিয়েছি, আজ আমি নিজেই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছি,”—বললেন তানভীর।

এই অবস্থাকে তিনি বলছেন “পোস্ট-পজিশন ট্রমা”—যেখানে মানুষ নিজের পরিচয়ের সঙ্গে কর্মসংস্থানের এতটাই সম্পর্ক তৈরি করে ফেলে যে চাকরি চলে গেলে পুরো আত্মবিশ্বাসটা ভেঙে পড়ে।

অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় ছন্দপতন

করপোরেট চাকরিজীবীরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট রুটিনে অভ্যস্ত থাকেন—সকাল ৯টার মিটিং, দুপুরের অফিস ক্যাফেটেরিয়া, ছুটির দিনের শপিং, গেট টুগেদার। সেই জীবনে হঠাৎ ছেদ পড়ে গেলে মানসিক একাকীত্ব দেখা দেয়। তার সঙ্গে যোগ হয় পারিবারিক চাপ।

মোহাম্মদপুরের সাবিনা কবির আগে ছিলেন একটি প্রাইভেট ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক। এখন তিনি দুই সন্তান নিয়ে ঘরে বসে আছেন। “ঈদের দিনটাতে একসময় গরু কাটতাম ড্রাইভার, হেল্পারের সঙ্গে। এখন গরু দূরে থাক, বাচ্চাদের ঈদের জামা কিনতে পারিনি।”

আত্মীয়ের চোখে প্রশ্নপ্রতিবেশীর মুখে কৌতূহল

চাকরি হারানোর পর করপোরেট পেশাজীবীরা চাইলেও সেটা দীর্ঘদিন গোপন রাখতে পারেন না। ঈদে বাড়ি গেলে আত্মীয়স্বজন জানতে চায়—“কি খবর, এখন কোথায় কাজ করো?” অনেকেই সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে গ্রামে না গিয়ে ঢাকায় থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

একজন সাবেক করপোরেট কর্মী বলেন, “ঈদে নিজের শো-কেস বানানো জীবনে এখন একটা ফাঁকা জায়গা। কিছু নেই দেখানোর মতো।”

কোরবানিনানিজের সম্মানটাই টিকিয়ে রাখা মুশকিল

আগে করপোরেট কর্মীরা ঈদের আগে যে গরুর খামারগুলোতে প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের গরু বুক করতেন, এখন সেই একই মানুষরা দোকানে গিয়ে দর কষাকষি করছেন চাল আর ডালের দামে। কোরবানির কথা ভাবারই সুযোগ নেই।

কেউ কেউ বলছেন, তারা হয়তো অন্যের বাসায় নিমন্ত্রণে যাবেন, তাও যদি নিমন্ত্রণ আসে। কিন্তু অধিকাংশই বলছেন, “চেহারায় হাসি রেখে ভিতরে কান্না চাপা দিতে হবে।”

বিকল্প খোঁজকিন্তু সহজ নয়

অনেক করপোরেট পেশাজীবী এখন ফ্রিল্যান্স, পরামর্শমূলক কাজ, অনলাইন মার্কেটিং কিংবা টিউশনির দিকে ঝুঁকছেন। তবে এই রূপান্তর সহজ নয়। একসময় যাঁরা করপোরেট গ্ল্যামারে অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁদের জন্য হঠাৎ করে অনিশ্চিত আয় আর অনির্ধারিত রুটিন এক ধরনের মানসিক স্নায়ুচাপে পরিণত হয়।

তবুও কেউ কেউ বলছেন, “আমরা ঘুরে দাঁড়াব। হয়তো আগামী ঈদটা আগের মতো হবে না, কিন্তু জীবনে সব ঈদ এক রকম হয় না।”

তৃতীয় পর্ব: অভিজাত দুনিয়া থেকে বেকার বাস্তবতায়

০৬:০০:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫

সুপরিচিত পরিচয়ে ছেদনতুন পরিচয়: বেকার

দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বনানীর একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন ফারহানা হক। অফিস ছিল গ্লাসঘেরা, ক্লায়েন্ট মিটিং, টিম প্রেজেন্টেশন, আর মাসশেষে নির্ভরযোগ্য বেতন। কিন্তু এপ্রিলের এক সকালে একটি ইমেইল বদলে দিল সব কিছু—“Due to financial restructuring, your position has been made redundant.”

ঈদুল আজহা সামনে। আগে ঈদের সময়টা মানেই ছিল বোনাস, পরিবার নিয়ে বিদেশ সফরের পরিকল্পনা, নতুন পোশাক, উপহার, গরুর কোরবানি। এখন? ফারহানা বলেন, “নতুন জামা কেনা তো দূরের কথা, আমি বাসার খরচ কমাতে বাসার হেল্পিং হ্যান্ডকেও বিদায় করে দিয়েছি।”

একদিন যাদের চাকরি দিতামআজ তাদের সঙ্গে বসে চাকরি খুঁজি

তানভীর রহমান ছিলেন একটি টেলিকম কোম্পানির রিক্রুটমেন্ট হেড। তিনিই একসময় অন্যদের ইন্টারভিউ করতেন, প্রস্তাবনা দিতেন, সিভি যাচাই করতেন। কিন্তু এখন, তিনি নিজেই চাকরির জন্য সিভি পাঠাচ্ছেন, পরিচিতদের ফোন করছেন—“ভাই, কিছু আছে কি?”

“আমি অফিসে বসে একসময় অনেক ক্যান্ডিডেটকে ফিরিয়ে দিয়েছি, আজ আমি নিজেই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছি,”—বললেন তানভীর।

এই অবস্থাকে তিনি বলছেন “পোস্ট-পজিশন ট্রমা”—যেখানে মানুষ নিজের পরিচয়ের সঙ্গে কর্মসংস্থানের এতটাই সম্পর্ক তৈরি করে ফেলে যে চাকরি চলে গেলে পুরো আত্মবিশ্বাসটা ভেঙে পড়ে।

অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় ছন্দপতন

করপোরেট চাকরিজীবীরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট রুটিনে অভ্যস্ত থাকেন—সকাল ৯টার মিটিং, দুপুরের অফিস ক্যাফেটেরিয়া, ছুটির দিনের শপিং, গেট টুগেদার। সেই জীবনে হঠাৎ ছেদ পড়ে গেলে মানসিক একাকীত্ব দেখা দেয়। তার সঙ্গে যোগ হয় পারিবারিক চাপ।

মোহাম্মদপুরের সাবিনা কবির আগে ছিলেন একটি প্রাইভেট ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক। এখন তিনি দুই সন্তান নিয়ে ঘরে বসে আছেন। “ঈদের দিনটাতে একসময় গরু কাটতাম ড্রাইভার, হেল্পারের সঙ্গে। এখন গরু দূরে থাক, বাচ্চাদের ঈদের জামা কিনতে পারিনি।”

আত্মীয়ের চোখে প্রশ্নপ্রতিবেশীর মুখে কৌতূহল

চাকরি হারানোর পর করপোরেট পেশাজীবীরা চাইলেও সেটা দীর্ঘদিন গোপন রাখতে পারেন না। ঈদে বাড়ি গেলে আত্মীয়স্বজন জানতে চায়—“কি খবর, এখন কোথায় কাজ করো?” অনেকেই সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে গ্রামে না গিয়ে ঢাকায় থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

একজন সাবেক করপোরেট কর্মী বলেন, “ঈদে নিজের শো-কেস বানানো জীবনে এখন একটা ফাঁকা জায়গা। কিছু নেই দেখানোর মতো।”

কোরবানিনানিজের সম্মানটাই টিকিয়ে রাখা মুশকিল

আগে করপোরেট কর্মীরা ঈদের আগে যে গরুর খামারগুলোতে প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের গরু বুক করতেন, এখন সেই একই মানুষরা দোকানে গিয়ে দর কষাকষি করছেন চাল আর ডালের দামে। কোরবানির কথা ভাবারই সুযোগ নেই।

কেউ কেউ বলছেন, তারা হয়তো অন্যের বাসায় নিমন্ত্রণে যাবেন, তাও যদি নিমন্ত্রণ আসে। কিন্তু অধিকাংশই বলছেন, “চেহারায় হাসি রেখে ভিতরে কান্না চাপা দিতে হবে।”

বিকল্প খোঁজকিন্তু সহজ নয়

অনেক করপোরেট পেশাজীবী এখন ফ্রিল্যান্স, পরামর্শমূলক কাজ, অনলাইন মার্কেটিং কিংবা টিউশনির দিকে ঝুঁকছেন। তবে এই রূপান্তর সহজ নয়। একসময় যাঁরা করপোরেট গ্ল্যামারে অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁদের জন্য হঠাৎ করে অনিশ্চিত আয় আর অনির্ধারিত রুটিন এক ধরনের মানসিক স্নায়ুচাপে পরিণত হয়।

তবুও কেউ কেউ বলছেন, “আমরা ঘুরে দাঁড়াব। হয়তো আগামী ঈদটা আগের মতো হবে না, কিন্তু জীবনে সব ঈদ এক রকম হয় না।”