গত তিন মাসে বাংলাদেশে ওষুধের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে, যা ২০ শতাংশ থেকে শুরু করে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই মূল্যবৃদ্ধি জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, ইনসুলিন, ব্যথানাশক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধে প্রভাব ফেলেছে—যেমন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। উদাহরণস্বরূপ, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ‘টেরাক্স-১০’ ট্যাবলেটের দাম বেড়ে হয়েছে ১২ টাকা থেকে ২০ টাকা, যা ৬৬.৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি। একইভাবে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ‘ক্যামলোসার্ট’ ট্যাবলেটের একটি প্যাকেটের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা, যা ২০ শতাংশ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
এই হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির ফলে গড় চিকিৎসা ব্যয়ের পরিমাণ খুব অল্প সময়েই প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে, যা রোগীদের জন্য বড় ধরনের আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।
ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব
নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার
যেসব পরিবার ইতিমধ্যেই দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে লড়াই করছে, তাদের জন্য এই অতিরিক্ত ওষুধের খরচ মারাত্মক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। ওষুধের ক্ষেত্রে দরদাম করার সুযোগ না থাকায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, কারণ এগুলো জীবনরক্ষাকারী ও বাধ্যতামূলক।
সীমিত আয়ের প্রবীণ জনগোষ্ঠী
যেসব বয়স্ক মানুষ পেনশন বা স্বাস্থ্যবীমা সুবিধা ছাড়া দিন কাটান, তাদের ওপর এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব আরও বেশি। তাদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি রোগের জন্য নিয়মিত ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। এখন অতিরিক্ত খরচ বহন করতে গিয়ে তারা অনেক সময় চিকিৎসা বন্ধ করে দিচ্ছেন বা নিয়ম মেনে ওষুধ নিচ্ছেন না, যার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। একই সঙ্গে এটি পরিবারগুলোর ওপর মানসিক ও আর্থিক চাপ তৈরি করছে।
মূল্যবৃদ্ধির কারণসমূহ
ওষুধের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:
- আন্তর্জাতিক কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি:বিশ্ববাজারে ওষুধ তৈরির কাঁচামালের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
- মুদ্রার অবমূল্যায়ন:ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানির খরচ বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে ওষুধ উৎপাদনে।
- নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা:ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর (DGDA) ১১৭টি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করলেও দেশে ২৭,০০০টির বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হয়, যার বেশিরভাগই কঠোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই সুযোগে অনেক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
নিয়ন্ত্রণহীন ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করছে:
- চিকিৎসা বন্ধ বা অনিয়মিত গ্রহণ:অনেকে খরচের কারণে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন বা ডোজ মিস করছেন, যার ফলে রোগ জটিল আকার নিচ্ছে।
- স্বাস্থ্য খরচ বৃদ্ধি:চিকিৎসা অব্যাহত না রাখার কারণে অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বা জটিল চিকিৎসার মুখোমুখি হচ্ছেন, যা স্বাস্থ্যব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।
- মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা:ওষুধ কেনার চাপ থেকে রোগী ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা তৈরি হচ্ছে।
করণীয় সুপারিশ
ওষুধের দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব কমাতে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি:
- নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি: DGDA-এর সক্ষমতা বাড়িয়ে ওষুধের দামের উপর কঠোর নজরদারি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
- মূল্যনিয়ন্ত্রণের আওতা বাড়ানো: আরও বেশি ওষুধকে সরকারি মূল্যের নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত যাতে ইচ্ছেমতো দাম বৃদ্ধি বন্ধ হয়।
- জেনেরিক ওষুধের প্রসার: চিকিৎসকদের মাধ্যমে ও জনসচেতনতায় জেনেরিক ও সাশ্রয়ী ওষুধ ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া দরকার।
- সহায়তা কর্মসূচি: দরিদ্র ও প্রবীণ জনগণের জন্য ওষুধে ভর্তুকি বা সরকারি সহায়তা কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন।
- স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি: কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে মূল্য স্থিতিশীল রাখা যায়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ওষুধের দাম বৃদ্ধির ফলে নিম্নআয়ের পরিবার ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এতে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে এবং সামাজিক বৈষম্য আরও তীব্রতর হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যাতে সবার জন্য ওষুধের ন্যায্য ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা যায়।