০৯:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ঝড়ের ঢেউ, জ্বালানির দাম: দেশজুড়ে মৎসজীবীদের ক্রান্তিকাল

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী, খাল ও সাগরতটে মাছ ধরার নৌকাগুলো এখন অনিশ্চয়তার সাগর পেরিয়ে ফের কাজে ফিরতে পারবে কিনা—এটাই মৎসজীবীরা ফিসফিস করে ভাবছে। বর্ষা মৌসুমের প্রারম্ভে আছড়ে পড়া মেঘমালা, বেড়ে যাওয়া জ্বালানির দাম, আইন-শৃঙ্খলার অস্বচ্ছতা, মাছের প্রজনন মৌসুমে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা—এসব একত্রে মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে মৎসজীবীদের জীবনযাত্রায় এক উথাল-পাথাল পরিস্থিতি। সামুদ্রিক ট্রলার থেকে নৌকা-জাল, ছোট্ট নৌকা থেকে পাঁজর ব্যান্ড নৌকা—সবই এখন থেমে আছে শিমুলতলা, চরাঞ্চল, সাগরতট, পাড়িবন্ধন হাওর, মধ্যবঙ্গের নদীপাইলট প্রভৃতিতে।

নীচে বাংলাদেশের আটটি বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মৎসজীবীদের গত কয়েক দিনের জীবনের চিত্র তুলে ধরা হলো। কেমনভাবে তারা দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয়তা মেটাচ্ছে, পরিবার-পরিজনের মুখে কীভাবে খাবার তুলে দিচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ কাজ করছে:

বৈরী আবহাওয়া ও ঝড়-ঝঞ্ঝায় নদীতটে নীরব নৌকা

মেঘমালার দখলে। রাজধানী ঢাকার মতো খ্যাতনামা জায়গা না হলেও বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর—এসব বরিশাল বিভাগের জেলায় মৎস্যজীবীরা গত কয়েক দিনে ঝড়ো বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার কারণে নদীতে নামতে পারেনি। দুর্গম চরাঞ্চলে ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা মোটেই নিরাপদ নয়; নদীর ঢেউ যখন পাঁচ থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত তুঙ্গে ওঠে, তখন নৌকাই ঝাঁকুনি দেয়।

চরাঞ্চলের মাঝিপাড়া নামক এলাকায় ৩৫ বছর বয়সী মৎস্যজীবী কামরুল ইসলাম বলেন, “গত সোমবার থেকে এখানে এতোই বৃষ্টি হচ্ছে যে, রোববার মাছ ধরতে যাওয়ার ইচ্ছে করেছিলাম, কিন্তু নদীর ঢেউ দেখে মনে হলো ডিঙিই যাওয়ার উপযোগী নয়। এখনই যদি মাছ ধরতে যাই, জীবন ঝুঁকিতে ফেলা স্বত্বেও সামান্য লাভের সুযোগ থাকলেও কী আর লাভ থাকে? স্বামীর একমাত্র উপার্জন ছিল মাছ, এখন সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে।” তার স্ত্রী শীলা আক্তার যোগ করেন, “বাচ্চাদের ভাত-ডাল এখন ঋণ করে আনতে হচ্ছে; দোকানে গিয়ে বলছি—দেখো, রুই-কাতলা মাছ ধরে আসব এবার। কিন্তু মাছই তো ধরতে পারছি না।”

বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সিভিল) অনিমেষ চন্দ্র দাশ জানান, “নদী-খালগুলোতে রক্ষা বাঁধের সংস্কার কাজ চলছে; বন্যার পূর্বাভাসে সামান্য কিছু জায়গায় কাজ থেমেছিল বলে নিরাপত্তার কারণে মাছ ধরায় বাধা এসেছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত কাজ শেষ করে দিন–রাত নৌকাচালকদের জন্য চলাচলের পথ খুলে দিতে।” তবে আমন মৌসুমের প্রারম্ভে অর্থনৈতিক সাহায্যের কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে মৎসজীবীদের জীবনযাত্রার ছন্দ ছিঁড়ে গেছে এখানে।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি: সমুদ্রপথে সংকট

খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া—এসব জেলায় সমুদ্রপথে মাছ ধরা কতটা ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা এখন আর কেউ অগ্রাহ্য করে না। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম যখন ১০৪ টাকা থেকে কমিয়ে ১০২ টাকা (১ জুন থেকে কার্যকর), আবার একই সঙ্গে পেট্রোল ১২১ থেকে ১১৮ টাকা—এই পরিবর্তনের ফলে নৌকাপালেরা ভুগছে। গত কয়েক দিনে সমুদ্রপারে দুটো ছোট জেটি ঘাটে দেখা গেছে—অনেক নৌকা ইঞ্জিন বন্ধ রেখে দাঁড়িয়ে আছে, কারণ জ্বালানির ওপর ভরসা আর সুবিধা নেই।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, জ্বালানি ব্যয় কমলেও ঠান্ডা বাতাসে সমুদ্রের ঢেউ তখনও উত্তাল। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কার্তিকের বাতাসের দাপট দিন দিন বাড়ছে—শাহাজালালে ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫৫ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বইছে, আর শেষ কয়েক দিন ধরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরেও একই অবস্থা। ফলে মৎসজীবীরা একমাত্র আউট-বোর্ড ইঞ্জিন নিয়ে খোলা সমুদ্রপারে মাছ ধরতে পারেননি।

ঝালকাঠির শেখ শেখ পরিবার—তিনজনেই ইঞ্জিন চালানোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের নৌকার নাম ‘নূরজাহান ৭’। গত মঙ্গলবার তারা ইঞ্জিন চালানোর চেষ্টা করেছিল; আট ঘণ্টা চেষ্টা করেও মাত্র এক হাঁড়ি (প্রায় ১০ কেজি) ইলিশ ধরতে পেরেছে। তাও বেশির ভাগ মাছটা তো জীবন ঝুঁকি নিয়ে ধরে আনা। জ্বালানির ২০ লিটার খরচ করেই বাজারে মাছ বিক্রি করার সুযোগ পেয়েছে তেমন কিছুই না বলে মনে করেন কামরুল শেখ (৪২), “আজকাল বাজারে ইলিশের দাম খুব ভালো—কয়টা যে তবু লাভ! কিন্তু নদী বা সমুদ্রপারে জীবন ঝুঁকি তো বাদই দিলাম, যে দাম চুক্তি হচ্ছে, তার থেকেও ক্ষতি কম!”

তৃতীয় সারির নৌকা চালক হাকিম আলী বলেন, “আমরা সাধারণ নৌকা চালিয়ে নদীতে নামলে ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার গতিতে যাই; কিন্তু জ্বালানির দাম এত বেড়ে যাওয়ার কারণে এক দিন কাজ করলে ৪০,০০০ টাকা ব্যয় হয়, আর আমরা যে মজুরি পাই, তার সিংহভাগ পারিবারিক খরচে চলে যায়। এখন পরিস্থিতি এমন, নদীতে নামার আগেই জানি দিনের পরিশ্রম মানে মাইনাস।”

ইলিশ কারেন্ট ও প্রজনন মৌসুম: আইনি নিষেধাজ্ঞার ছায়া

বাংলাদেশে ইলিশ আয়ের অপর নাম। ফ্রাই-এর মৌলিক পর্যায়ে কয়েক দিন মাছ ধরতে না পারলেই বাজারে সরবরাহ কমে যায়; দাম দ্রুত বাড়ে। কিন্তু ইলিশ কারেন্ট জাল ব্যবহার এবং মা-ইলিশের প্রজনন মৌসুমের কারণে মৎস্য মন্ত্রণালয় গত ১৫ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত এক মাস নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই সময়ে শ্রেণিভুক্ত স্থানীয় ট্রলার ও নৌকা যাতে মাছ না ধরতে পারে, সেই জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে।

বরগুনার মৎস্যজীবী মনিরুজ্জামান (৩৮) বলেন, “গত সোমবার থেকে এতটা নিষেধাজ্ঞা আমি আগে দেখিনি। রোববার এপার থেকে ওপার পার হওয়া প্রতিটি নৌকায় পুলিশ চেক করছে। আমাদের এলাকায় অন্তত ৫০টি ছোট নৌকা আছে, প্রতিটি নৌকা রোজগার করে গিয়ে ২০০০–৩০০০ টাকা আয় করে। এখন আর নদীতে নামার প্রশ্নই নেই।” তার স্ত্রী রিনা (৩৫) যোগ করেন, “বাবা আগে কখনোই ব্যাংক-বিবিএলের ঋণে ছিল না; কিন্তু এখন আমাদের একমাত্র ছেলে স্কুলে যাওয়ার উপযোগী খাবার পাচ্ছে না—বাবা তো মাছ ধরেই পরিবারের খরচ চালাত। সংসারে একঝাঁকটা স্কুল ফি, বইপত্রের টাকা কোথা থেকে হবে?”

নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জের নদীতটে এখন এক তীব্র সংকটের ছায়া—লোকাল যাত্রীনৌকার ভাড়া উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ায় চাল ও ডালবাটি মজুদ করছে যাত্রীরা। যাত্রীরা আবার লোকাল নৌকায় ডিঙি ভাড়া দিতে এসে হতাশ হয়েছেন। এর ফলে মাছের সরবরাহ লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে; বাজারে বিক্রির মতো মাছই নেই।

ক্ষয়িষ্ণু মাছের সংখ্যা

সরকারি তথ্য মতে, প্রতি বছর ১০% করে চাষ করেও নদী-খাল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে আবহাওয়ার পরিবর্তন, অবৈধ জাটকা শিকার, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাছের আয়তন ক্রমাগত কমছে। সাম্প্রতিক মৎস্য অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত মার্চে মেঘনা নদীতে মাছের সংখ্যা ১৫% হ্রাস পেয়েছে। মলদহ, বৈরুটি, পদ্মা, যমুনা—সব নদীই এখন আগের তুলনায় মাছের মজুদ কম বলেই দেখা যাচ্ছে।

বরিশাল ঋদ্ধপুরের মৎস্য গবেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হানিফ বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে গবেষণা পর্যালোচনায় আশা করেছিলাম ২০২৫ সালের এই সময়ে মাছের মজুদ বাড়বে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা যেটা দেখছি, পরিবেশগত পরিবর্তনের পাশাপাশি অবৈধ জাটকা শিকার প্রতিহত করতে না পারায় পরের বছরগুলোতেও চ্যালেঞ্জ বেড়ে যাবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়—অর্থাৎ জাটকা শিকার নিয়ন্ত্রণ করা না হয়—নদীতে মৃত মাছ ভাসতে দেখা দেবে। মাত্র একজন–দুইজন ইঞ্জিনচালক মাছ ধরে ফেললে পরের দিন একই জালে কোনও মাছই ধরে না।”

জীবনযাত্রা: পরিবার-হুমকির মধ্যে

বরগুনা থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত—একই পৃথিবীতে অবিরাম ক্লান্তির মধ্যে দিন পার করছে কম্পনপুরের মাছ ধরা পরিবার। মাছ ধরার কাজ বন্ধ থাকায় প্রান্তিকরা মুন্সিগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নরসিংদী—এসব জেলা থেকে শহর-বন্দর পাড়ে দিনমজুরি খুঁজছে। অনেকেই একরোদা হয়ে ছাদ-মেঝে পাতার কাজ করছেন, আবার কেউ রাস্তা মেরামতিতে হাত দিচ্ছে।

ঝিনাইদহের শ্যামগঞ্জ উপজেলার মৎস্যজীবী খালেদ মাস্টার (৪৫) গত পাঁচ দিন ধরে মাছ ধরতে যাননি। তিনি বলেন, “লেখাপড়া খুব কম, তাই ঢাকায় কোনো কাজই আমার হাতে গোনা। তাই এক গাড়ির চালক হয়ে ভিক্ষা করে জীবন চালানোই সম্ভব নয়। পরিবার তো দেখতে হবে—স্ত্রী, দুই মেয়ে, আরেক ছেলে। সে ছোট, পড়াশোনা করছে। এখন নৌকা-ইঞ্জিন বন্ধ, আমি চলে গিয়েছি মুন্সিগঞ্জে কাজ করতে। প্রতিদিন চারশত টাকা পাই, কিন্তু তাতে তো চালই জোটেনা , ভাতের কষ্টও কমানোর পথ পাই না।”

নেত্রকোণার সন্দ্বীপে এখন নৌকা থেকে নেমে ছোট্ট দোকান নিয়ে ব্যবসা করছে সালাম (৩৮)। তিনি জানালেন, “নৌকা চালিয়ে বছরে আমরাই সারা বছর খরচের টাকা তুলতাম। কিন্তু কয়েক দিন মাছ ধরতে না পারায় দেখলাম—শুধু নৌকা মেরামত, জ্বালানির টাকা ছাড়া সংসারে অন্য কিছুই রাখার অবস্থা নেই। তাই এখন দোকান খুলেছি—শুধু শুকনো মাছ, খেজুর, নিম্বুর পানি বিক্রি করছি। যেটুকু ইনভেস্টমেন্ট করা হয়েছিল, সেটা ক্যাশ-ই আটকে আছে।”

নারী মৎসজীবীরা: ইলিশ কাঁধে সংসার

ঢালার হাট হাওড়ার বইমেলায় এবার দেখা যাচ্ছে শিশু-ফ্যাশনের পাশপাশি নদীর ধারে সাইকেলে কাঁধে ভারি মাছের বাক্স নিয়ে আসা মায়েদেরও হিড়িক। এই নারীরা মৎস্যজীবী পরিবারে আয়ের সহায়তা করেন। বিশেষ করে সন্তোষপুর (চট্টগ্রাম), মামুনিয়া (বরগুনা), মেঘনার পাড় (লক্ষ্মীপুর) প্রভৃতি অঞ্চলে নারী মৎস বিক্রেতাদের নানা সংগ্রাম।

বান্দরবানের পথেঘাটাতেও দেখা যায়—গাছঢাকায় ইলিশ বিক্রেতা রেহানা (৪২) গত তিন দিন ইলিশ ধরতে পারেননি তাঁর স্বামী। এখন সে দুপুরবেলা সাইকেলে বসে দুই বস্তায় ইলিশ নিয়ে পটুয়াখালীর বাজারে যাচ্ছেন। “এক বস্তায় ইলিশ আসে ২০–২৫ কেজি; দাম ৫৫০–৬০০ টাকা প্রতি কেজিতে ধরে বিক্রি করি। সকালে বাজারে মাছ কিনতে আসি, বিকেল পাঁচটায় ফেরার পথে মাঝখানে টাকা নষ্ট হয়—কিছুই বাঁচে না,” বললেন রেহানা। তার তিন মেয়ে, এক ছেলে—তাদের স্কুলফি আর বইপত্রের টাকা আগে থেকেই মাছ বিক্রির টাকায় জুটতো। এখন তার উপার্জন কম, তাতে হয়তো খাওয়া-দাওয়াও নষ্ট।

সিলেটের হাওরাঞ্চলে বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গরিব নারী-পুরুষরা নৌকা চালিয়ে মাছ ধরেই সংসারের চালিকা শক্তি জোগাতেন। “আজকাল বাঁশ প্লাই নৌকা চালানো ঠিক আসছে না—তার ফলে মাছ ধরে বেচার মতো কোনো স্টক নেই,” বললেন সিলেটের জালালাবাদ এলাকার মৎস্যজীবী নারী সুলতানা বেগম (৩৮)। একই এলাকায় সরকারি পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ সহায়তা বা ভর্তুকির কথা এখন পর্যন্ত তার জানা হয়নি।

ঋণের বোঝা ও সুদের চক্র: দিশেহারা মৎসজীবীরা

মৎসজীবীরা অধিকাংশই ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে নৌকা ও ইঞ্জিন চালান, ভেঞ্চার উৎপাদন করে। এই ঋণগুলো সাধারণত পাঞ্চার্স বা স্পট থেকে নেওয়া হয়। এখন যেহেতু মাছ ধরতে পারছি না, মজুরি নেই, ঋণ শোধের উপায় বন্ধ—সুদের বোঝা সামনে থেকেই ছায়া ফেলেছে। জালালপুর (রাজশাহী) অঞ্চলে একান্ন বছর বয়সী মৎস্যজীবী আলমগীর হোসেন বলেন, “গত মাসেই এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম—শুধু জালের খরচ, ইঞ্জিনের তেল আর নৌকা মেরামতের জন্য; মনে ছিল এক মাসের মধ্যে কোটা গিয়ে মাছ ধরলেই সব মিটবে। এখন দেখি সেই ইচ্ছাও দূরে সরে গেছে। সুদ তো দিচ্ছি, কিন্তু ঋণের মেয়াদই বাড়িয়ে দিয়েছে কিস্তি—পাঁচ দিন পর।”

রংপুরের রাজামহলের জেলায় একগুচ্ছ মৎস্যজীবী যৌথ খামার চালাতেন; এখন সে খামারগুলোও বন্ধ। “এক বস্তা চাল-ডাল ভরা বানিয়ে ঘরে নিয়ে আসতে পারি না, খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে না,” বললেন ওই মানুষটি। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়াটা এক ধরনের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ অর্ধেক ক্ষেত্রেই কাগজপত্র ঠিকঠাক না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হাতে ঋণই আসে না—কৃষক ও পেশাজীবীরা বরং সুদে আগ্রহী থাকেন, যাতে ঋণের টাকা পৌঁছায় না।

সরকারি ত্রাণ-সহায়তা ও স্থানীয় উদ্যোগ

নির্বাচনের পরে সরকার মৎস্যজীবীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সহায়তার কথা মাথায় রেখেছিল—জেলেদের মাঝে চাষের পদ্ধতি শেখানো, ইলিশ চারা রোপণ, নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে মাছের সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে চাল, ডাল, লবণ, চিনি, সেমাই, সাবানসহ ত্রাণের পাইকারি বক্স অনেক ক্ষেত্রে দুরন্ত চর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছয়নি। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, নীলফামারী, পিরোজপুর—এসব জেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষুদ্র খামারীদের জন্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় কিছু চাল-ডাল বিতরণ শুরু করেছে।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, “বর্ষা মৌসুমে শেষ হলে ৩০ জুনের মধ্যে সাগরে মাছ ধরার জন্য ভ্যাটমুক্ত জ্বালানি চালু করা হবে। কোথাও যদি জ্বালানির মূল্য উল্লেখ্যহীন বৃদ্ধি দেখতে পান, দ্রুত জানাবেন। আর হাওর ও নদীতে ইলিশ সংরক্ষণের জন্য হেলিকপ্টার জরিপ আরও বাড়ানো হবে। তাছাড়া নিম্ন আয়ের মৎস্যজীবীদের জন্য জাল-মজবুত করার ঋণে অতিরিক্ত ২% কর ছাড় দেওয়া হবে।”

এদিকে স্থানীয়ভাবে চাঁদপুরের হাজী মোর্শেদ আলী ফেলভাল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গত মঙ্গলবার চাল-ডাল, টিনশেড, জ্বালানি তেলের সুবিধা প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যাতে অন্তত তারেকপুর, গোপালপুর, শ্রীমঙ্গল প্রভৃতি অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা সামান্য স্বস্তি পায়। একই সাথে রাজশাহী অঞ্চলে “মৎস্যবাহী” নামে এক স্বনির্ভর প্রকল্পের আওতায় ঘুড়িগ্রাম, বাগমারা, রাজারহাট এলাকায় আনা হয়েছে ভ্যান-ভিত্তিক চিংড়ি পালন।

শিক্ষাঙ্গণে পিছিয়ে পড়া: শিশুরা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়ে

মাছ ধরার আয় পেয়ে শিশুরা স্কুলে যেত; কারণ বাবার আয়ের নিরাপত্তা ছিল। কিন্তু এখন সেই নিরাপত্তা না থাকায় অনেক শিশুই পড়াশোনা থেকে বিরত। লক্ষ্মীপুরের পদ্মা পাড়ের একজন মৎস্যজীবী বলেন, “আমার দুই সন্তান—কন্যা (১২) আর পুত্র (৯)। ওরা এখন স্কুলে যেতে চায়, কিন্তু সাময়িক বাড়ি ভাড়া, বইপত্র, ইউনিফর্ম—সবই দেবে কে? তাই ওরা এখন চা বিক্রির কাজে হাত দিচ্ছে, বয়সের চেয়েও বড় বোঝা বহন করছে। মাছ না ধরলে তবুও সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়।”

বরিশালের চকরিয়া উপজেলায় বালিকা মৎস্যজীবী মনসুরা বেগম (১৪) সোমবার দুপুরে বার্মিজ ভাসমান মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে তার ছোট ভাইকে ডাক্তার দেখানোর খরচ চালান। মনসুরা বললেন, “আমরা প্রতিদিন ওজনমতো চুলায় ইলিশ ভাজি করে বিক্রি করি। কিন্তু গত পাঁচ দিন ইলিশ ধরতে গিয়ে ফিরে আসছি—নদীতে ঝড়। আর বাজারেও দাম নেই। এখন দেখছি—ভাই অসুস্থ। ওর ওষুধের জন্য আগে জমিয়ে রাখা টাকা আর নেই।”

জীবিকা ও অস্তিত্বের সন্ধানে: সমাধানের প্রত্যাশা

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ দিন ধরে দিনমজুর হয়ে যাত্রীবাহী নৌকায় পাথর-বালি ঢোকার দর বৃদ্ধি পেয়েছে; মাছের বাজার একেবারেই স্তিমিত। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ষাকালে মাছের প্রজনন ও প্রবাহ রক্ষা করতে প্রথমিকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় মজুরি ও দারিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে।

একদিকে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টায় সরকার এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে মৎসজীবীদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করাও সমান জরুরি। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রচার) অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান বলেন, “বর্ষা মৌসুমে মৎসজীবীদের সাময়িক প্রণোদনা চালু করা হয়েছে—সন্তান শিক্ষার ভাতা, ঋণ পুনর্গঠন, এককালীন ভাতা, জৈব সার-প্রয়োগ প্রকল্পে অগ্রগামী পদক্ষেপ। তবে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন অনেক অঞ্চলে দেরিতে পৌঁছেছে।”

আশাবাদ ও বাস্তবতার ফাঁক

গত কয়েক দিনে নদীতে নেমে প্রতিদিনের দায়িত্বের বোঝা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ছোট মৎস্যজীবীর কাঁধে চাপ লেগেছে। আবহাওয়া, নিষেধাজ্ঞা, উচ্চমূল্য জ্বালানি—সব মিলেমিশে তাদের মাছ ধরার স্বপ্নকে বিষন্ন করে দিয়েছে। পুরনো দিনের মতো মাছের জোয়ার এখন মায়াবী হয়ে উঠেছে।

তবে নদী ও সমুদ্রই তাদের প্রাণ। এখান থেকেই সংসার চলে; এখান থেকেই স্কুলের খরচ জোটে; ঋণের বোঝা সুদে বদলে যেত না। এখন সেই আস্থার জায়গায় এসেছে অনিশ্চয়তা, হতাশা, আর আর্থিক অসহায়তা। পুরনো দিনের সেই উজ্জ্বল দিনে ফিরতে চাইলে দরকার সক্রিয় উদ্যোগ, উন্নত বনায়ন, নিষেধাজ্ঞার অংশিক আর্থিক ক্ষতিপূরণ। যাতে হাওর-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ পুনরায় মাছ ধরতে পারে, তরুণ-তরুণীরা স্কুলে যেতে পারে, পরিবার-পরিজন নির্ধারিত পথে চলতে পারে।

যদি এই সংকটকালীন অবস্থাকে সাময়িক রাখা যায়—অর্থাৎ বর্ষা পার হতেই আবার নৌকা পানিতে নামবে, জাল ছুড়ে দেবে, ইলিশের পদ্মা-যমুনা রূপচর্চায় অংশ নেবে—তবে বুঝতে হবে বাংলাদেশের মৎসজীবীরা আবার সমৃদ্ধির সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকবে। কিন্তু যদি এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে কয়েক দশক ধরে গৃহীত মৎস্য নীতির ওপর প্রশ্ন তুলতে হবে, কারণ ভবিষ্যতে সুস্থ-উন্নত মৎস্যখাত না থাকলে বাংলাদেশের গায়ে জ্বলবে দারিদ্র্যের ছাপ।

মৎস্যজীবীর জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, অঙ্গীকার; এখন সেই অঙ্গীকার রক্ষা পাবে কিনা, তা নির্ভর করছে সক্রিয় অনুদান, নীতি পরিবর্তন, এবং তাদের দৃষ্টিতে ‘যদি’ আর ‘যতদিন’ না আসে। তাই শেষ কথা হচ্ছে: নদী-সাগরের পারে দাঁড়িয়ে যাদের জীবন বিপন্ন—তাদের সহায়তা যদি সময়মত না পৌঁছায়, তাহলে দেশের মাছ-সম্পদের অপচয় নয়, বরং মানব-সম্পদও অপচয় হয়ে যাবে।

ঝড়ের ঢেউ, জ্বালানির দাম: দেশজুড়ে মৎসজীবীদের ক্রান্তিকাল

০৫:২০:১৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী, খাল ও সাগরতটে মাছ ধরার নৌকাগুলো এখন অনিশ্চয়তার সাগর পেরিয়ে ফের কাজে ফিরতে পারবে কিনা—এটাই মৎসজীবীরা ফিসফিস করে ভাবছে। বর্ষা মৌসুমের প্রারম্ভে আছড়ে পড়া মেঘমালা, বেড়ে যাওয়া জ্বালানির দাম, আইন-শৃঙ্খলার অস্বচ্ছতা, মাছের প্রজনন মৌসুমে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা—এসব একত্রে মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে মৎসজীবীদের জীবনযাত্রায় এক উথাল-পাথাল পরিস্থিতি। সামুদ্রিক ট্রলার থেকে নৌকা-জাল, ছোট্ট নৌকা থেকে পাঁজর ব্যান্ড নৌকা—সবই এখন থেমে আছে শিমুলতলা, চরাঞ্চল, সাগরতট, পাড়িবন্ধন হাওর, মধ্যবঙ্গের নদীপাইলট প্রভৃতিতে।

নীচে বাংলাদেশের আটটি বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মৎসজীবীদের গত কয়েক দিনের জীবনের চিত্র তুলে ধরা হলো। কেমনভাবে তারা দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয়তা মেটাচ্ছে, পরিবার-পরিজনের মুখে কীভাবে খাবার তুলে দিচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ কাজ করছে:

বৈরী আবহাওয়া ও ঝড়-ঝঞ্ঝায় নদীতটে নীরব নৌকা

মেঘমালার দখলে। রাজধানী ঢাকার মতো খ্যাতনামা জায়গা না হলেও বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর—এসব বরিশাল বিভাগের জেলায় মৎস্যজীবীরা গত কয়েক দিনে ঝড়ো বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার কারণে নদীতে নামতে পারেনি। দুর্গম চরাঞ্চলে ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা মোটেই নিরাপদ নয়; নদীর ঢেউ যখন পাঁচ থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত তুঙ্গে ওঠে, তখন নৌকাই ঝাঁকুনি দেয়।

চরাঞ্চলের মাঝিপাড়া নামক এলাকায় ৩৫ বছর বয়সী মৎস্যজীবী কামরুল ইসলাম বলেন, “গত সোমবার থেকে এখানে এতোই বৃষ্টি হচ্ছে যে, রোববার মাছ ধরতে যাওয়ার ইচ্ছে করেছিলাম, কিন্তু নদীর ঢেউ দেখে মনে হলো ডিঙিই যাওয়ার উপযোগী নয়। এখনই যদি মাছ ধরতে যাই, জীবন ঝুঁকিতে ফেলা স্বত্বেও সামান্য লাভের সুযোগ থাকলেও কী আর লাভ থাকে? স্বামীর একমাত্র উপার্জন ছিল মাছ, এখন সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে।” তার স্ত্রী শীলা আক্তার যোগ করেন, “বাচ্চাদের ভাত-ডাল এখন ঋণ করে আনতে হচ্ছে; দোকানে গিয়ে বলছি—দেখো, রুই-কাতলা মাছ ধরে আসব এবার। কিন্তু মাছই তো ধরতে পারছি না।”

বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সিভিল) অনিমেষ চন্দ্র দাশ জানান, “নদী-খালগুলোতে রক্ষা বাঁধের সংস্কার কাজ চলছে; বন্যার পূর্বাভাসে সামান্য কিছু জায়গায় কাজ থেমেছিল বলে নিরাপত্তার কারণে মাছ ধরায় বাধা এসেছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত কাজ শেষ করে দিন–রাত নৌকাচালকদের জন্য চলাচলের পথ খুলে দিতে।” তবে আমন মৌসুমের প্রারম্ভে অর্থনৈতিক সাহায্যের কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে মৎসজীবীদের জীবনযাত্রার ছন্দ ছিঁড়ে গেছে এখানে।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি: সমুদ্রপথে সংকট

খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া—এসব জেলায় সমুদ্রপথে মাছ ধরা কতটা ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা এখন আর কেউ অগ্রাহ্য করে না। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম যখন ১০৪ টাকা থেকে কমিয়ে ১০২ টাকা (১ জুন থেকে কার্যকর), আবার একই সঙ্গে পেট্রোল ১২১ থেকে ১১৮ টাকা—এই পরিবর্তনের ফলে নৌকাপালেরা ভুগছে। গত কয়েক দিনে সমুদ্রপারে দুটো ছোট জেটি ঘাটে দেখা গেছে—অনেক নৌকা ইঞ্জিন বন্ধ রেখে দাঁড়িয়ে আছে, কারণ জ্বালানির ওপর ভরসা আর সুবিধা নেই।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, জ্বালানি ব্যয় কমলেও ঠান্ডা বাতাসে সমুদ্রের ঢেউ তখনও উত্তাল। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কার্তিকের বাতাসের দাপট দিন দিন বাড়ছে—শাহাজালালে ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫৫ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বইছে, আর শেষ কয়েক দিন ধরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরেও একই অবস্থা। ফলে মৎসজীবীরা একমাত্র আউট-বোর্ড ইঞ্জিন নিয়ে খোলা সমুদ্রপারে মাছ ধরতে পারেননি।

ঝালকাঠির শেখ শেখ পরিবার—তিনজনেই ইঞ্জিন চালানোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের নৌকার নাম ‘নূরজাহান ৭’। গত মঙ্গলবার তারা ইঞ্জিন চালানোর চেষ্টা করেছিল; আট ঘণ্টা চেষ্টা করেও মাত্র এক হাঁড়ি (প্রায় ১০ কেজি) ইলিশ ধরতে পেরেছে। তাও বেশির ভাগ মাছটা তো জীবন ঝুঁকি নিয়ে ধরে আনা। জ্বালানির ২০ লিটার খরচ করেই বাজারে মাছ বিক্রি করার সুযোগ পেয়েছে তেমন কিছুই না বলে মনে করেন কামরুল শেখ (৪২), “আজকাল বাজারে ইলিশের দাম খুব ভালো—কয়টা যে তবু লাভ! কিন্তু নদী বা সমুদ্রপারে জীবন ঝুঁকি তো বাদই দিলাম, যে দাম চুক্তি হচ্ছে, তার থেকেও ক্ষতি কম!”

তৃতীয় সারির নৌকা চালক হাকিম আলী বলেন, “আমরা সাধারণ নৌকা চালিয়ে নদীতে নামলে ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার গতিতে যাই; কিন্তু জ্বালানির দাম এত বেড়ে যাওয়ার কারণে এক দিন কাজ করলে ৪০,০০০ টাকা ব্যয় হয়, আর আমরা যে মজুরি পাই, তার সিংহভাগ পারিবারিক খরচে চলে যায়। এখন পরিস্থিতি এমন, নদীতে নামার আগেই জানি দিনের পরিশ্রম মানে মাইনাস।”

ইলিশ কারেন্ট ও প্রজনন মৌসুম: আইনি নিষেধাজ্ঞার ছায়া

বাংলাদেশে ইলিশ আয়ের অপর নাম। ফ্রাই-এর মৌলিক পর্যায়ে কয়েক দিন মাছ ধরতে না পারলেই বাজারে সরবরাহ কমে যায়; দাম দ্রুত বাড়ে। কিন্তু ইলিশ কারেন্ট জাল ব্যবহার এবং মা-ইলিশের প্রজনন মৌসুমের কারণে মৎস্য মন্ত্রণালয় গত ১৫ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত এক মাস নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই সময়ে শ্রেণিভুক্ত স্থানীয় ট্রলার ও নৌকা যাতে মাছ না ধরতে পারে, সেই জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে।

বরগুনার মৎস্যজীবী মনিরুজ্জামান (৩৮) বলেন, “গত সোমবার থেকে এতটা নিষেধাজ্ঞা আমি আগে দেখিনি। রোববার এপার থেকে ওপার পার হওয়া প্রতিটি নৌকায় পুলিশ চেক করছে। আমাদের এলাকায় অন্তত ৫০টি ছোট নৌকা আছে, প্রতিটি নৌকা রোজগার করে গিয়ে ২০০০–৩০০০ টাকা আয় করে। এখন আর নদীতে নামার প্রশ্নই নেই।” তার স্ত্রী রিনা (৩৫) যোগ করেন, “বাবা আগে কখনোই ব্যাংক-বিবিএলের ঋণে ছিল না; কিন্তু এখন আমাদের একমাত্র ছেলে স্কুলে যাওয়ার উপযোগী খাবার পাচ্ছে না—বাবা তো মাছ ধরেই পরিবারের খরচ চালাত। সংসারে একঝাঁকটা স্কুল ফি, বইপত্রের টাকা কোথা থেকে হবে?”

নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জের নদীতটে এখন এক তীব্র সংকটের ছায়া—লোকাল যাত্রীনৌকার ভাড়া উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ায় চাল ও ডালবাটি মজুদ করছে যাত্রীরা। যাত্রীরা আবার লোকাল নৌকায় ডিঙি ভাড়া দিতে এসে হতাশ হয়েছেন। এর ফলে মাছের সরবরাহ লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে; বাজারে বিক্রির মতো মাছই নেই।

ক্ষয়িষ্ণু মাছের সংখ্যা

সরকারি তথ্য মতে, প্রতি বছর ১০% করে চাষ করেও নদী-খাল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে আবহাওয়ার পরিবর্তন, অবৈধ জাটকা শিকার, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাছের আয়তন ক্রমাগত কমছে। সাম্প্রতিক মৎস্য অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত মার্চে মেঘনা নদীতে মাছের সংখ্যা ১৫% হ্রাস পেয়েছে। মলদহ, বৈরুটি, পদ্মা, যমুনা—সব নদীই এখন আগের তুলনায় মাছের মজুদ কম বলেই দেখা যাচ্ছে।

বরিশাল ঋদ্ধপুরের মৎস্য গবেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হানিফ বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে গবেষণা পর্যালোচনায় আশা করেছিলাম ২০২৫ সালের এই সময়ে মাছের মজুদ বাড়বে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা যেটা দেখছি, পরিবেশগত পরিবর্তনের পাশাপাশি অবৈধ জাটকা শিকার প্রতিহত করতে না পারায় পরের বছরগুলোতেও চ্যালেঞ্জ বেড়ে যাবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়—অর্থাৎ জাটকা শিকার নিয়ন্ত্রণ করা না হয়—নদীতে মৃত মাছ ভাসতে দেখা দেবে। মাত্র একজন–দুইজন ইঞ্জিনচালক মাছ ধরে ফেললে পরের দিন একই জালে কোনও মাছই ধরে না।”

জীবনযাত্রা: পরিবার-হুমকির মধ্যে

বরগুনা থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত—একই পৃথিবীতে অবিরাম ক্লান্তির মধ্যে দিন পার করছে কম্পনপুরের মাছ ধরা পরিবার। মাছ ধরার কাজ বন্ধ থাকায় প্রান্তিকরা মুন্সিগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নরসিংদী—এসব জেলা থেকে শহর-বন্দর পাড়ে দিনমজুরি খুঁজছে। অনেকেই একরোদা হয়ে ছাদ-মেঝে পাতার কাজ করছেন, আবার কেউ রাস্তা মেরামতিতে হাত দিচ্ছে।

ঝিনাইদহের শ্যামগঞ্জ উপজেলার মৎস্যজীবী খালেদ মাস্টার (৪৫) গত পাঁচ দিন ধরে মাছ ধরতে যাননি। তিনি বলেন, “লেখাপড়া খুব কম, তাই ঢাকায় কোনো কাজই আমার হাতে গোনা। তাই এক গাড়ির চালক হয়ে ভিক্ষা করে জীবন চালানোই সম্ভব নয়। পরিবার তো দেখতে হবে—স্ত্রী, দুই মেয়ে, আরেক ছেলে। সে ছোট, পড়াশোনা করছে। এখন নৌকা-ইঞ্জিন বন্ধ, আমি চলে গিয়েছি মুন্সিগঞ্জে কাজ করতে। প্রতিদিন চারশত টাকা পাই, কিন্তু তাতে তো চালই জোটেনা , ভাতের কষ্টও কমানোর পথ পাই না।”

নেত্রকোণার সন্দ্বীপে এখন নৌকা থেকে নেমে ছোট্ট দোকান নিয়ে ব্যবসা করছে সালাম (৩৮)। তিনি জানালেন, “নৌকা চালিয়ে বছরে আমরাই সারা বছর খরচের টাকা তুলতাম। কিন্তু কয়েক দিন মাছ ধরতে না পারায় দেখলাম—শুধু নৌকা মেরামত, জ্বালানির টাকা ছাড়া সংসারে অন্য কিছুই রাখার অবস্থা নেই। তাই এখন দোকান খুলেছি—শুধু শুকনো মাছ, খেজুর, নিম্বুর পানি বিক্রি করছি। যেটুকু ইনভেস্টমেন্ট করা হয়েছিল, সেটা ক্যাশ-ই আটকে আছে।”

নারী মৎসজীবীরা: ইলিশ কাঁধে সংসার

ঢালার হাট হাওড়ার বইমেলায় এবার দেখা যাচ্ছে শিশু-ফ্যাশনের পাশপাশি নদীর ধারে সাইকেলে কাঁধে ভারি মাছের বাক্স নিয়ে আসা মায়েদেরও হিড়িক। এই নারীরা মৎস্যজীবী পরিবারে আয়ের সহায়তা করেন। বিশেষ করে সন্তোষপুর (চট্টগ্রাম), মামুনিয়া (বরগুনা), মেঘনার পাড় (লক্ষ্মীপুর) প্রভৃতি অঞ্চলে নারী মৎস বিক্রেতাদের নানা সংগ্রাম।

বান্দরবানের পথেঘাটাতেও দেখা যায়—গাছঢাকায় ইলিশ বিক্রেতা রেহানা (৪২) গত তিন দিন ইলিশ ধরতে পারেননি তাঁর স্বামী। এখন সে দুপুরবেলা সাইকেলে বসে দুই বস্তায় ইলিশ নিয়ে পটুয়াখালীর বাজারে যাচ্ছেন। “এক বস্তায় ইলিশ আসে ২০–২৫ কেজি; দাম ৫৫০–৬০০ টাকা প্রতি কেজিতে ধরে বিক্রি করি। সকালে বাজারে মাছ কিনতে আসি, বিকেল পাঁচটায় ফেরার পথে মাঝখানে টাকা নষ্ট হয়—কিছুই বাঁচে না,” বললেন রেহানা। তার তিন মেয়ে, এক ছেলে—তাদের স্কুলফি আর বইপত্রের টাকা আগে থেকেই মাছ বিক্রির টাকায় জুটতো। এখন তার উপার্জন কম, তাতে হয়তো খাওয়া-দাওয়াও নষ্ট।

সিলেটের হাওরাঞ্চলে বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গরিব নারী-পুরুষরা নৌকা চালিয়ে মাছ ধরেই সংসারের চালিকা শক্তি জোগাতেন। “আজকাল বাঁশ প্লাই নৌকা চালানো ঠিক আসছে না—তার ফলে মাছ ধরে বেচার মতো কোনো স্টক নেই,” বললেন সিলেটের জালালাবাদ এলাকার মৎস্যজীবী নারী সুলতানা বেগম (৩৮)। একই এলাকায় সরকারি পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ সহায়তা বা ভর্তুকির কথা এখন পর্যন্ত তার জানা হয়নি।

ঋণের বোঝা ও সুদের চক্র: দিশেহারা মৎসজীবীরা

মৎসজীবীরা অধিকাংশই ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে নৌকা ও ইঞ্জিন চালান, ভেঞ্চার উৎপাদন করে। এই ঋণগুলো সাধারণত পাঞ্চার্স বা স্পট থেকে নেওয়া হয়। এখন যেহেতু মাছ ধরতে পারছি না, মজুরি নেই, ঋণ শোধের উপায় বন্ধ—সুদের বোঝা সামনে থেকেই ছায়া ফেলেছে। জালালপুর (রাজশাহী) অঞ্চলে একান্ন বছর বয়সী মৎস্যজীবী আলমগীর হোসেন বলেন, “গত মাসেই এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম—শুধু জালের খরচ, ইঞ্জিনের তেল আর নৌকা মেরামতের জন্য; মনে ছিল এক মাসের মধ্যে কোটা গিয়ে মাছ ধরলেই সব মিটবে। এখন দেখি সেই ইচ্ছাও দূরে সরে গেছে। সুদ তো দিচ্ছি, কিন্তু ঋণের মেয়াদই বাড়িয়ে দিয়েছে কিস্তি—পাঁচ দিন পর।”

রংপুরের রাজামহলের জেলায় একগুচ্ছ মৎস্যজীবী যৌথ খামার চালাতেন; এখন সে খামারগুলোও বন্ধ। “এক বস্তা চাল-ডাল ভরা বানিয়ে ঘরে নিয়ে আসতে পারি না, খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে না,” বললেন ওই মানুষটি। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়াটা এক ধরনের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ অর্ধেক ক্ষেত্রেই কাগজপত্র ঠিকঠাক না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হাতে ঋণই আসে না—কৃষক ও পেশাজীবীরা বরং সুদে আগ্রহী থাকেন, যাতে ঋণের টাকা পৌঁছায় না।

সরকারি ত্রাণ-সহায়তা ও স্থানীয় উদ্যোগ

নির্বাচনের পরে সরকার মৎস্যজীবীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সহায়তার কথা মাথায় রেখেছিল—জেলেদের মাঝে চাষের পদ্ধতি শেখানো, ইলিশ চারা রোপণ, নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে মাছের সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে চাল, ডাল, লবণ, চিনি, সেমাই, সাবানসহ ত্রাণের পাইকারি বক্স অনেক ক্ষেত্রে দুরন্ত চর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছয়নি। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, নীলফামারী, পিরোজপুর—এসব জেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষুদ্র খামারীদের জন্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় কিছু চাল-ডাল বিতরণ শুরু করেছে।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, “বর্ষা মৌসুমে শেষ হলে ৩০ জুনের মধ্যে সাগরে মাছ ধরার জন্য ভ্যাটমুক্ত জ্বালানি চালু করা হবে। কোথাও যদি জ্বালানির মূল্য উল্লেখ্যহীন বৃদ্ধি দেখতে পান, দ্রুত জানাবেন। আর হাওর ও নদীতে ইলিশ সংরক্ষণের জন্য হেলিকপ্টার জরিপ আরও বাড়ানো হবে। তাছাড়া নিম্ন আয়ের মৎস্যজীবীদের জন্য জাল-মজবুত করার ঋণে অতিরিক্ত ২% কর ছাড় দেওয়া হবে।”

এদিকে স্থানীয়ভাবে চাঁদপুরের হাজী মোর্শেদ আলী ফেলভাল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গত মঙ্গলবার চাল-ডাল, টিনশেড, জ্বালানি তেলের সুবিধা প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যাতে অন্তত তারেকপুর, গোপালপুর, শ্রীমঙ্গল প্রভৃতি অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা সামান্য স্বস্তি পায়। একই সাথে রাজশাহী অঞ্চলে “মৎস্যবাহী” নামে এক স্বনির্ভর প্রকল্পের আওতায় ঘুড়িগ্রাম, বাগমারা, রাজারহাট এলাকায় আনা হয়েছে ভ্যান-ভিত্তিক চিংড়ি পালন।

শিক্ষাঙ্গণে পিছিয়ে পড়া: শিশুরা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়ে

মাছ ধরার আয় পেয়ে শিশুরা স্কুলে যেত; কারণ বাবার আয়ের নিরাপত্তা ছিল। কিন্তু এখন সেই নিরাপত্তা না থাকায় অনেক শিশুই পড়াশোনা থেকে বিরত। লক্ষ্মীপুরের পদ্মা পাড়ের একজন মৎস্যজীবী বলেন, “আমার দুই সন্তান—কন্যা (১২) আর পুত্র (৯)। ওরা এখন স্কুলে যেতে চায়, কিন্তু সাময়িক বাড়ি ভাড়া, বইপত্র, ইউনিফর্ম—সবই দেবে কে? তাই ওরা এখন চা বিক্রির কাজে হাত দিচ্ছে, বয়সের চেয়েও বড় বোঝা বহন করছে। মাছ না ধরলে তবুও সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়।”

বরিশালের চকরিয়া উপজেলায় বালিকা মৎস্যজীবী মনসুরা বেগম (১৪) সোমবার দুপুরে বার্মিজ ভাসমান মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে তার ছোট ভাইকে ডাক্তার দেখানোর খরচ চালান। মনসুরা বললেন, “আমরা প্রতিদিন ওজনমতো চুলায় ইলিশ ভাজি করে বিক্রি করি। কিন্তু গত পাঁচ দিন ইলিশ ধরতে গিয়ে ফিরে আসছি—নদীতে ঝড়। আর বাজারেও দাম নেই। এখন দেখছি—ভাই অসুস্থ। ওর ওষুধের জন্য আগে জমিয়ে রাখা টাকা আর নেই।”

জীবিকা ও অস্তিত্বের সন্ধানে: সমাধানের প্রত্যাশা

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ দিন ধরে দিনমজুর হয়ে যাত্রীবাহী নৌকায় পাথর-বালি ঢোকার দর বৃদ্ধি পেয়েছে; মাছের বাজার একেবারেই স্তিমিত। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ষাকালে মাছের প্রজনন ও প্রবাহ রক্ষা করতে প্রথমিকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় মজুরি ও দারিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে।

একদিকে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টায় সরকার এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে মৎসজীবীদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করাও সমান জরুরি। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রচার) অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান বলেন, “বর্ষা মৌসুমে মৎসজীবীদের সাময়িক প্রণোদনা চালু করা হয়েছে—সন্তান শিক্ষার ভাতা, ঋণ পুনর্গঠন, এককালীন ভাতা, জৈব সার-প্রয়োগ প্রকল্পে অগ্রগামী পদক্ষেপ। তবে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন অনেক অঞ্চলে দেরিতে পৌঁছেছে।”

আশাবাদ ও বাস্তবতার ফাঁক

গত কয়েক দিনে নদীতে নেমে প্রতিদিনের দায়িত্বের বোঝা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ছোট মৎস্যজীবীর কাঁধে চাপ লেগেছে। আবহাওয়া, নিষেধাজ্ঞা, উচ্চমূল্য জ্বালানি—সব মিলেমিশে তাদের মাছ ধরার স্বপ্নকে বিষন্ন করে দিয়েছে। পুরনো দিনের মতো মাছের জোয়ার এখন মায়াবী হয়ে উঠেছে।

তবে নদী ও সমুদ্রই তাদের প্রাণ। এখান থেকেই সংসার চলে; এখান থেকেই স্কুলের খরচ জোটে; ঋণের বোঝা সুদে বদলে যেত না। এখন সেই আস্থার জায়গায় এসেছে অনিশ্চয়তা, হতাশা, আর আর্থিক অসহায়তা। পুরনো দিনের সেই উজ্জ্বল দিনে ফিরতে চাইলে দরকার সক্রিয় উদ্যোগ, উন্নত বনায়ন, নিষেধাজ্ঞার অংশিক আর্থিক ক্ষতিপূরণ। যাতে হাওর-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ পুনরায় মাছ ধরতে পারে, তরুণ-তরুণীরা স্কুলে যেতে পারে, পরিবার-পরিজন নির্ধারিত পথে চলতে পারে।

যদি এই সংকটকালীন অবস্থাকে সাময়িক রাখা যায়—অর্থাৎ বর্ষা পার হতেই আবার নৌকা পানিতে নামবে, জাল ছুড়ে দেবে, ইলিশের পদ্মা-যমুনা রূপচর্চায় অংশ নেবে—তবে বুঝতে হবে বাংলাদেশের মৎসজীবীরা আবার সমৃদ্ধির সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকবে। কিন্তু যদি এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে কয়েক দশক ধরে গৃহীত মৎস্য নীতির ওপর প্রশ্ন তুলতে হবে, কারণ ভবিষ্যতে সুস্থ-উন্নত মৎস্যখাত না থাকলে বাংলাদেশের গায়ে জ্বলবে দারিদ্র্যের ছাপ।

মৎস্যজীবীর জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, অঙ্গীকার; এখন সেই অঙ্গীকার রক্ষা পাবে কিনা, তা নির্ভর করছে সক্রিয় অনুদান, নীতি পরিবর্তন, এবং তাদের দৃষ্টিতে ‘যদি’ আর ‘যতদিন’ না আসে। তাই শেষ কথা হচ্ছে: নদী-সাগরের পারে দাঁড়িয়ে যাদের জীবন বিপন্ন—তাদের সহায়তা যদি সময়মত না পৌঁছায়, তাহলে দেশের মাছ-সম্পদের অপচয় নয়, বরং মানব-সম্পদও অপচয় হয়ে যাবে।