দোকানপাট ভেঙে গেল, জীবনও খানখান
পল্টনের ফুটপাতে চামড়ার মানিব্যাগ, বেল্ট আর মোবাইল কভার বিক্রি করতেন আব্দুল করিম (৪৬)। চল্লিশ হাজার টাকা ধার করে নতুন ঈদের স্টক এনেছিলেন ফেব্রুয়ারির শুরুতে। দু’সপ্তাহ পর শহরে রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হলো—অবরোধ, ভাঙচুর, হরতাল। ক্রেতা নেই, দোকান পুড়ে গেল।
“যেদিন দোকান পুড়ল, আমি পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। তেলাও পড়তে পারিনি। আমার ১৬ বছরের ব্যবসা শেষ হয়ে গেল এক রাতেই,”—বলেন করিম।
তার দোকানের জায়গাটাও এখন দখলে। দেনাদারেরা প্রতিদিন ফোন করে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে এখন এক কামরার ঘরে বাস করছেন। ঈদের আগমনে বুকটা ভারি হয়ে আসে—“কী দিই বাচ্চাদের? দেনা শোধ দেব, না মাংস কিনব?”
শুধু পুঁজি নয়, আস্থা হারিয়েছেন
মিরপুরের কাঁচাবাজারে ১২ বছর ফলের দোকান চালিয়েছিলেন নুর আলম। দেড় মাস আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার খরচ জোগাতে দোকান বন্ধ করতে হয়। এরপর সুস্থ হলেও আর পুঁজির টাকা ছিল না। ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন, এখন সেই ঋণের কিস্তি দিতে পারছেন না।
“ঈদের দিনটায় আগে আমি আনারস আর তরমুজ বেশি রাখতাম, কারণ ক্রেতা আসত পরিবার নিয়ে। এখন ঈদে আমি নিজেই একটা কলা কিনতে ভয় পাই—দামে উঠছে ৩০ টাকা,”—বলছিলেন নুর আলম।
দোকান বন্ধ মানে শুধু আয় নয়, আত্মপরিচয়ের শেষ
বংশালের নুরজাহান বেগম একটা ছোট কাপড়ের দোকান চালাতেন নিজের গলিতে। মহিলাদের সালোয়ার-কামিজ বিক্রি করতেন, ঈদের মৌসুমে তার দোকান জমজমাট থাকত। এপ্রিল মাসে গলির নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় তার দোকান ভেঙে ফেলা হয়, স্থায়ী কোনো জায়গা না থাকায় ব্যবসা বন্ধ।
“আমি স্বামী মারা যাওয়ার পর এই দোকান দিয়েই দুই মেয়েকে স্কুলে দিতাম। এখন দোকান নেই, মেয়ে বলে—‘মা, আমরাও কি ঈদে জামা পাব না?’ আমি কি উত্তর দিই?”—বলছিলেন নুরজাহান, চোখের কোণ দিয়ে অশ্রু মুছতে মুছতে।
ঈদের নাম শুনলেই মনে হয়—‘দেনার দিন’
যাদের দোকান নেই, আয় নেই, তাদের কাছে ঈদ মানে আরও বাড়তি চাপ। বাচ্চারা নতুন জামা চায়, মাংস খেতে চায়, পরিবার চায় একদিন একটু ভিন্ন রকম খাওয়া-দাওয়া। কিন্তু বাস্তবতা বলছে—দেনার কিস্তির দিন, বাড়িওয়ালার ভাড়ার চাপ, দোকান ভাড়ার বকেয়া, পণ্যের বাকি…
ফারুক হোসেন, যিনি আগে মিরপুর-২ নম্বরে মোবাইল ফোনের দোকান চালাতেন, বলেন—“ঈদের দিনে দোকান খোলা থাকত, বিক্রি হতো ভালো। এখন ঈদের কথা শুনলেই ভয় লাগে—দেনাদার আসবে, স্ত্রী বলবে কী রান্না করবো, আর আমি দাঁড়িয়ে থাকব চুপচাপ।”
সহায়তা কোথায়?
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সাধারণত আনুষ্ঠানিক সাহায্য বা প্রণোদনার আওতায় পড়েন না। বড় ব্যবসায়িক গ্রুপ বা শিল্প খাতের জন্য ব্যাংক ঋণ, সাবসিডি থাকে, কিন্তু যারা পুঁজি জোগাড় করেন বিকালে বাজার করে আবার সকালে স্টল দিয়ে তাদেরকে কেউ চেনে না, তারা ব্যবসায়ী হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে আসে না।
সরকার বা স্থানীয় সরকার পর্যায়েও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঈদের জন্য কোনো বিশেষ সহায়তা নেই। এনজিওর কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা খুবই সীমিত এবং শহরের কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরের এলাকায় পৌঁছায় না।
তবুও স্বপ্ন? না, কেবল প্রত্যাশা বেঁচে থাকার
যেসব ব্যবসায়ী ঈদে দোকান খুলতেন, বিশেষ ডিসকাউন্ট দিতেন, কাস্টমারদের মিষ্টি দিতেন—আজ তারাই বাসায় বসে ভাবছেন ঈদের দিন কীভাবে কাটবে। কেউ কেউ ভাঙা পুঁজি দিয়ে ফের দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। অনেকে বলছেন, “চলুন ঈদের পর কিছু করি।” কিন্তু এর মধ্যে অনেকেই চুপচাপ নিজেদের আত্মসম্মান বাঁচিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন।
“বউ বলে ঈদের দিন ওর ভাইয়ের বাসায় যাবো। আমি বলি—তুমি যাও। আমি যাব না। আমি তো একটা লুঙ্গিও কিনতে পারিনি,”—বলছিলেন করিম।