সংবাদপত্রে অন্যের ঈদ, নিজের ঈদ নিঃশব্দ
রিপোর্টার আবদুল মুকিত গত বছর ঈদুল আজহার ঠিক আগের দিনও একটি গ্রাফিক রিপোর্ট করেছিলেন—“কত মানুষ এবার কোরবানি করতে পারবে না?” তারই করা ছবিতে একজন কাঁদছিলেন মাংস না পেয়ে। এক বছর পর, সেই চিত্র যেন নিজের জীবনে ফিরে এসেছে।
“আমি এখন নিজেই জানি না ঈদের দিন কী খাবো। তিন মাস ধরে কোনো ফিক্সড ইনকাম নেই। পত্রিকা থেকে বাদ পড়েছি। নতুন কোথাও সুযোগ নেই। বাসায় বলি—অনলাইন প্রজেক্টে আছি। কিন্তু কিছুই নেই,”—বললেন মুকিত।
কথা বলতে বলতে চুপ করে গেলেন। বললেন, “তোমরা লিখবে তো? কারণ আমরা নিজেরা লিখলে সেটা কেউ ছাপে না।”
“অন্যের গল্প তুলে ধরার মানুষ, নিজের কষ্ট লিখতে পারি না”
সাংবাদিক পেশার একটা বিশেষত্ব হলো—তাঁরা নিজে থাকেন গল্পের বাইরে। শত দুর্ঘটনা, সংকট বা মানবিক বিপর্যয় হোক না কেন, তাঁর কাজ শুধু খবর তোলা। কিন্তু যখন তাঁর নিজের জীবনটাই দুর্দশায় ভরে যায়, তখন সেই পেশার ভদ্র আড়াল হয়ে দাঁড়ায় দেয়াল হয়ে।
প্রান্তিক অনলাইন পত্রিকার ফিচার সম্পাদক রাশিদা সুলতানা বলেন, “আমার ছেলে বলল—মা, তোমার তো পত্রিকায় লেখা ছাপে। এবার আমাদের ঈদের ছবি কেন ছাপবে না?”
চাকরি নেই, আয় নেই, সম্মানও ক্ষয়ে যায়
গত ছয় মাসে প্রায় ১৭টি দৈনিক ও অনলাইন পোর্টাল রিপোর্টার ছাঁটাই করেছে বা সম্মানী কমিয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে মাসের পর মাস সম্মানী বন্ধ। কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টালে ‘ফ্রিল্যান্স ভলান্টিয়ার’ নামে মানুষকে ব্যবহার করা হচ্ছে, বিনা বেতনে।
সোহেল পারভেজ, যিনি আগে একটি জাতীয় দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন, এখন রাইডশেয়ারিংয়ে বাইক চালান। বলেন, “একটা সময় ছিল আমি ঈদের দিন মন্ত্রীদের ফোন করতাম স্টেটমেন্টের জন্য। এখন আমার নিজের ফোনে কেউ কল করে না। আর করলেই ভয় হয়—দেনা চায় কি না।”
ঈদ মানে আগে ছিল স্টোরি ছাপা, এখন কষ্ট লুকানো
সাংবাদিকরা আগে ঈদে মাঠে নামতেন—কোরবানির পশুর হাট, ট্রাফিক রিপোর্ট, নিম্ন আয়ের মানুষের গল্প। কিন্তু এখন নিজের ঈদেই ভয়—বাসায় কী রান্না হবে, বাচ্চাকে জামা কিনে দিতে পারবো কি না, বাড়ি যাওয়া সম্ভব হবে কি না।
রাশিদা বলেন, “আমি এখন রিপোর্ট করি অন্যের দুঃখ নিয়ে। কিন্তু কেউ আমার মেয়ের জন্য নতুন জামা কিনে দেবে না। পত্রিকায় লিখলেও আমাদের খবর কেউ পড়ে না।”
নেটওয়ার্কের মানুষ, এখন বিচ্ছিন্ন
সাংবাদিক পেশায় সাধারণত ‘নেটওয়ার্ক’ শব্দটি বড়। পরিচিতি থাকে মন্ত্রী, নেতা, ব্যবসায়ী, সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে। কিন্তু চাকরি হারানোর পর সেই নেটওয়ার্ক নিঃশব্দ হয়ে যায়। ফোন তোলা বন্ধ, মেসেজের উত্তর আসে না। যেন ‘চাকরি’ই ছিল তাদের বৈধতা।
“আমি অনেকের কষ্ট তুলে ধরেছি। কিন্তু আজ আমারই একটুখানি সহায়তায় কেউ এগিয়ে আসে না। ঈদে আমার ছোট মেয়েটা বলল—তোমার প্রেস কার্ড কি এবার কোনো কাজে লাগবে না?”—বললেন পারভেজ।
সহকর্মীদের কাছেও বিব্রত, নিজের কাছেও লজ্জিত
চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক সাংবাদিকই আর পুরনো অফিসের দিকে মুখ তুলে তাকান না। ঈদে সহকর্মীদের ছবি, সেলফি, গরুর ছবি দেখে ফেসবুক অফ করে রাখেন। পারভেজ বলেন, “আমি একসময় ঈদের দিনে স্ট্যাটাস দিতাম—‘আজকের প্রধান রিপোর্ট আমার’। এখন লিখি না কিছুই। কে পড়বে?”
আশাবাদ? কেবল সন্তানের দিকে তাকিয়ে
এই প্রতিবেদনের শেষ দিকে এসে দেখা গেল, কেউ কেউ চেষ্টা করছেন ইউটিউব চ্যানেল চালু করতে, কেউ ব্লগ লিখছেন, কেউ অনলাইন কোর্স করছেন। তবে সত্যি বলতে, আয় শুরু হতে হতে ঈদ পার হয়ে যাবে। তবুও তাঁরা সন্তানদের চোখে স্বপ্ন দেখতে চান।
রাশিদা বলেন, “আমার মেয়ে বলেছে—‘মা, তুমি না অন্যদের কষ্ট লিখো? এবার আমার কষ্টটা লিখবে?’ আমি লিখছি না, কারণ ভয় পাই, চোখের পানি কীবোর্ডে পড়ে যাবে।”