০৬:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই: মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগন্নাথ মন্দির আর প্রসাদ বিতরণ নিয়ে কেন রাজনৈতিক বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে? মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ও গঙ্গা জলচুক্তি নবায়ন নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন: বাংলাদেশের বড় একটি ভুল, প্রতিশোধ বনাম সংস্কার সাকিব আল হাসান: বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক অমর কিংবদন্তি বাংলা নাটকের সুপারস্টার অপূর্বের জন্মদিন আজ শিবসা নদী: শতবর্ষী এক প্রাণপ্রবাহ ও তার সুন্দরবনের প্রভাব ইরান যুদ্ধ ও ‘ট্রাম্প নীতি’ চীনের বহুমুখী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘোলাটে করে দিচ্ছে আসিয়ান এখন আর কেবল বৈশ্বিক পুঁজির নীরব গ্রাহক নয় প্রতিদিন একটি রুমাল (পর্ব-১৯)

পর্ব ৩: উপকূলের আলু চাষিরা দাঁড়িয়ে আছেন বালির ঘরে স্বপ্ন বুনে

ফেনী—নদী, মাটি আর মানুষের সহিষ্ণুতা দিয়ে গড়া এক উপকূলীয় জেলা। এখানকার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া—এই তিনটি উপজেলায় আলু চাষ করেন বহু কৃষক, যাঁরা প্রতি বছর যেমন প্রকৃতির সঙ্গে লড়েন, তেমনি লড়েন বাজারের প্রতারণার সঙ্গে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ঈদুল আজহা সামনে, কিন্তু চাষিদের চোখে নেই উৎসবের আলো। অনেকের চোখে শঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর নিঃশব্দ অভিমান।

সাগরের হাওয়া আর শূন্য হাত

ফুলগাজীর কৃষক রহিম উদ্দিন (৪৮) বলেন, “এবার ফলন খারাপ হয়নি। কিন্তু বাজারে যখন আলু তুললাম, তখন পাইকারি দরে বিক্রি করেছি ১২-১৩ টাকা কেজিতে। অথচ আমার খরচ পড়েছে ১৫ টাকা। প্রতিবার ভাবি—এইবার হয়তো ভালো কিছু হবে। কিন্তু না, আমরা কৃষকরা শুধু আশাতেই বাঁচি।”

রহিমের কথা শেষ হতেই তাঁর স্ত্রী আমেনা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “ছেলেটা বলছে, গরু কবে আনবে? আমি কী করে বলি, এবছর হয়তো গরু হবে না।”

নদীর ভাঙনকৃষকের মন ভাঙন

এই অঞ্চলে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা চিরকালীন সমস্যা। অনেক চাষি পানি ঠেলে জমিতে সার দিতে গিয়ে জ্বর-সর্দি নিয়েও কাজ করেছেন। ছাগলনাইয়ার কৃষক সাহাবুদ্দিন বলেন, “বৃষ্টি থামলেই জমিতে নামি। পা ডুবে যায়, কিন্তু কী করব? আলু তো আর অপেক্ষা করে না।”

অথচ ঈদের আগে বাজারে যখন আলু বিক্রি করেন, তখন দাম পাননি। তিনি বলেন, “দাম এত নিচে ছিল যে মনে হয়েছে, গোটা বছরের কষ্টের বদলে যেন আমাদের অবহেলা দেওয়া হয়েছে। এটাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট।”

বাজারের ফাঁদ আর ফড়িয়া সিন্ডিকেট

ফেনীর কৃষকেরা অভিযোগ করেন, বাজারে কিছু ফড়িয়া সিন্ডিকেট করে দাম নামিয়ে রাখে। পরশুরামের কৃষক আজহারুল ইসলাম বলেন, “হিমাগারে আলু রাখার টাকা নাই। আবার সরাসরি বাজারে নিলেও পাইকারেরা ১০ কেজি দিলে ৯ কেজি গোনে।”

তিনি বলেন, “আমরা চাষ করি, কিন্তু দাম ঠিক করে ওরা। আমরা শুধু শুনি আর মাথা নুইয়ে চলি।”

ঈদ হবে কীভাবে?

রহিম উদ্দিন বলেন, “আমার ছেলে সবসময় গরুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে। এবার বলেছে, ‘আব্বা, এবার কি গরু হবে না?’ আমি বলেছি, ‘দোয়া কর, আল্লাহ যা ভালো মনে করেন, তাই হোক।’”

আসলে এই কথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে কৃষকের স্বপ্ন, দুঃখ আর ঈদের আনন্দের ক্ষীণ আশ্রয়।

ভাগের কোরবানিভাগ করা কষ্ট

ফেনীর অনেক কৃষক এবার ভাই-ভগ্নিপতি কিংবা প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলেমিশে ভাগে গরু কোরবানি করছেন। কেউ আবার ছাগল বা খাসি নিয়েই ঈদের কাজ সারছেন। রহিম বলেন, “আমার ভাই আর ভায়রার সঙ্গে মিলে একটা ছোট গরু নিচ্ছি। আল্লাহর নামে কোরবানি দিচ্ছি, এটুকুই শান্তি।”

বাচ্চাদের জন্য ছোট ঈদ

আমেনা বেগম বললেন, “আগে যেভাবে নতুন কাপড় কিনতাম, এবার তেমন হয়নি। বাচ্চাদের দুইটা জামা কিনেছি—একটা পুরনো দোকান থেকে, একটা নতুন। ওরা খুশি, কিন্তু আমি জানি, তাদের চোখে অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যাবে।”

এই অপূর্ণতা ফেনীর কৃষকদের কাছে যেন পরিচিত সঙ্গী। প্রতিবছর তারা চেষ্টা করেন ভালো কিছু দিতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলুর বাজারে হোঁচট খেয়ে আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হয়।

প্রশাসনের দৃষ্টি ও সম্ভাবনা

ফেনী জেলা কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা কৃষকদের জন্য কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণ, কম সুদে ঋণ এবং সার-বীজ সহায়তার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু রহিম বলেন, “ঋণ নেওয়া মানে আবার নতুন ফাঁদে পড়া। যতক্ষণ না বাজার আমাদের হাতে আসবে, ততক্ষণ কিছুই হবে না।”

ঈদসংক্ষিপ্ত তবু হৃদয়ের পূর্ণতা

ফেনীর কৃষকদের ঈদ অনেক সীমিত, কিন্তু হৃদয়ে তবুও পূর্ণ। ছোট পাত্রে রান্না, ছেলেমেয়ের মুখে একটু হাসি, আর নামাজ শেষে একসঙ্গে বসে খাওয়া—এইসব মিলেই ঈদ।

রহিম বলেন, “আল্লাহ জানেন, আমরা কত কষ্ট করি। আমরা চাই, অন্তত ছেলেমেয়েগুলা যেন আমাদের মতো না হয়। তারা যেন বড় হয়ে নিজের ঈদ করতে পারে। সেই আশাতেই বাঁচি।”

এই আশার ওপর দাঁড়িয়েই ফেনীর কৃষকেরা বেঁচে থাকেন, প্রতি বছর নতুন করে শুরু করেন। ঈদের দিনে তাঁদের কোরবানি শুধু গরু নয়, তাঁদের আত্মত্যাগও যেন এক নিঃশব্দ আহ্বান—“আমাদের কথা কেউ শুনবে কি?”

ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই: মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী

পর্ব ৩: উপকূলের আলু চাষিরা দাঁড়িয়ে আছেন বালির ঘরে স্বপ্ন বুনে

০৫:০০:৪৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫

ফেনী—নদী, মাটি আর মানুষের সহিষ্ণুতা দিয়ে গড়া এক উপকূলীয় জেলা। এখানকার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া—এই তিনটি উপজেলায় আলু চাষ করেন বহু কৃষক, যাঁরা প্রতি বছর যেমন প্রকৃতির সঙ্গে লড়েন, তেমনি লড়েন বাজারের প্রতারণার সঙ্গে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ঈদুল আজহা সামনে, কিন্তু চাষিদের চোখে নেই উৎসবের আলো। অনেকের চোখে শঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর নিঃশব্দ অভিমান।

সাগরের হাওয়া আর শূন্য হাত

ফুলগাজীর কৃষক রহিম উদ্দিন (৪৮) বলেন, “এবার ফলন খারাপ হয়নি। কিন্তু বাজারে যখন আলু তুললাম, তখন পাইকারি দরে বিক্রি করেছি ১২-১৩ টাকা কেজিতে। অথচ আমার খরচ পড়েছে ১৫ টাকা। প্রতিবার ভাবি—এইবার হয়তো ভালো কিছু হবে। কিন্তু না, আমরা কৃষকরা শুধু আশাতেই বাঁচি।”

রহিমের কথা শেষ হতেই তাঁর স্ত্রী আমেনা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “ছেলেটা বলছে, গরু কবে আনবে? আমি কী করে বলি, এবছর হয়তো গরু হবে না।”

নদীর ভাঙনকৃষকের মন ভাঙন

এই অঞ্চলে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা চিরকালীন সমস্যা। অনেক চাষি পানি ঠেলে জমিতে সার দিতে গিয়ে জ্বর-সর্দি নিয়েও কাজ করেছেন। ছাগলনাইয়ার কৃষক সাহাবুদ্দিন বলেন, “বৃষ্টি থামলেই জমিতে নামি। পা ডুবে যায়, কিন্তু কী করব? আলু তো আর অপেক্ষা করে না।”

অথচ ঈদের আগে বাজারে যখন আলু বিক্রি করেন, তখন দাম পাননি। তিনি বলেন, “দাম এত নিচে ছিল যে মনে হয়েছে, গোটা বছরের কষ্টের বদলে যেন আমাদের অবহেলা দেওয়া হয়েছে। এটাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট।”

বাজারের ফাঁদ আর ফড়িয়া সিন্ডিকেট

ফেনীর কৃষকেরা অভিযোগ করেন, বাজারে কিছু ফড়িয়া সিন্ডিকেট করে দাম নামিয়ে রাখে। পরশুরামের কৃষক আজহারুল ইসলাম বলেন, “হিমাগারে আলু রাখার টাকা নাই। আবার সরাসরি বাজারে নিলেও পাইকারেরা ১০ কেজি দিলে ৯ কেজি গোনে।”

তিনি বলেন, “আমরা চাষ করি, কিন্তু দাম ঠিক করে ওরা। আমরা শুধু শুনি আর মাথা নুইয়ে চলি।”

ঈদ হবে কীভাবে?

রহিম উদ্দিন বলেন, “আমার ছেলে সবসময় গরুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে। এবার বলেছে, ‘আব্বা, এবার কি গরু হবে না?’ আমি বলেছি, ‘দোয়া কর, আল্লাহ যা ভালো মনে করেন, তাই হোক।’”

আসলে এই কথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে কৃষকের স্বপ্ন, দুঃখ আর ঈদের আনন্দের ক্ষীণ আশ্রয়।

ভাগের কোরবানিভাগ করা কষ্ট

ফেনীর অনেক কৃষক এবার ভাই-ভগ্নিপতি কিংবা প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলেমিশে ভাগে গরু কোরবানি করছেন। কেউ আবার ছাগল বা খাসি নিয়েই ঈদের কাজ সারছেন। রহিম বলেন, “আমার ভাই আর ভায়রার সঙ্গে মিলে একটা ছোট গরু নিচ্ছি। আল্লাহর নামে কোরবানি দিচ্ছি, এটুকুই শান্তি।”

বাচ্চাদের জন্য ছোট ঈদ

আমেনা বেগম বললেন, “আগে যেভাবে নতুন কাপড় কিনতাম, এবার তেমন হয়নি। বাচ্চাদের দুইটা জামা কিনেছি—একটা পুরনো দোকান থেকে, একটা নতুন। ওরা খুশি, কিন্তু আমি জানি, তাদের চোখে অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যাবে।”

এই অপূর্ণতা ফেনীর কৃষকদের কাছে যেন পরিচিত সঙ্গী। প্রতিবছর তারা চেষ্টা করেন ভালো কিছু দিতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলুর বাজারে হোঁচট খেয়ে আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হয়।

প্রশাসনের দৃষ্টি ও সম্ভাবনা

ফেনী জেলা কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা কৃষকদের জন্য কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণ, কম সুদে ঋণ এবং সার-বীজ সহায়তার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু রহিম বলেন, “ঋণ নেওয়া মানে আবার নতুন ফাঁদে পড়া। যতক্ষণ না বাজার আমাদের হাতে আসবে, ততক্ষণ কিছুই হবে না।”

ঈদসংক্ষিপ্ত তবু হৃদয়ের পূর্ণতা

ফেনীর কৃষকদের ঈদ অনেক সীমিত, কিন্তু হৃদয়ে তবুও পূর্ণ। ছোট পাত্রে রান্না, ছেলেমেয়ের মুখে একটু হাসি, আর নামাজ শেষে একসঙ্গে বসে খাওয়া—এইসব মিলেই ঈদ।

রহিম বলেন, “আল্লাহ জানেন, আমরা কত কষ্ট করি। আমরা চাই, অন্তত ছেলেমেয়েগুলা যেন আমাদের মতো না হয়। তারা যেন বড় হয়ে নিজের ঈদ করতে পারে। সেই আশাতেই বাঁচি।”

এই আশার ওপর দাঁড়িয়েই ফেনীর কৃষকেরা বেঁচে থাকেন, প্রতি বছর নতুন করে শুরু করেন। ঈদের দিনে তাঁদের কোরবানি শুধু গরু নয়, তাঁদের আত্মত্যাগও যেন এক নিঃশব্দ আহ্বান—“আমাদের কথা কেউ শুনবে কি?”