ঈদুল আজহা সামনে। বগুড়ার শিবগঞ্জ, কাহালু, আদমদীঘি ও দুপচাঁচিয়া অঞ্চলে এখন মাঠে নেই আলু, তবে কৃষকের মনে জমে আছে শঙ্কা—এবারের ঈদে গরু কোরবানি দিতে পারবেন তো? নাকি আলুর দরপতনের ক্ষত এখনো পুষিয়ে ওঠেনি?
আলুর মৌসুম শেষে হিসাব-নিকাশের পালা
বগুড়া দেশের অন্যতম প্রধান আলু উৎপাদনকারী জেলা। চলতি বছরের জানুয়ারি–মার্চে কৃষকেরা প্রতি বিঘায় গড়ে ২২০-২৫০ মণ আলু উৎপাদন করেছেন। কিন্তু সমস্যা হয়েছে বাজারে। শুরুতে দাম ভালো থাকলেও মার্চের পর থেকে পাইকারি বাজারে আলুর দাম ১২-১৫ টাকা কেজিতে নেমে আসে, যেখানে উৎপাদন খরচ ছিল গড়ে ১৬-১৭ টাকা।
কৃষক হারুনুর রশীদ জানান, “আমার চার বিঘা জমির আলু থেকে মোটামুটি ৩ লাখ টাকার মতো আলু বিক্রি করেছি, কিন্তু খরচ ছিল প্রায় ২.৪ লাখ টাকা। এখন ঈদের আগে গরু কেনার কথা ভাবতেই ভয় লাগে।”
ঈদে কোরবানি না কৃষি—কোনটা আগে?
ঈদুল আজহা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, সামাজিক মর্যাদার প্রতীকও। আলু চাষিদের জন্য ঈদ মানেই একধরনের সামাজিক চাপ—”পাশের বাড়ি কোরবানি দিলে আমি কেন নয়?” কিন্তু এবার সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত আছে আগামী ফসলের ভবিষ্যৎ।
রুহুল আমিন নামের একজন চাষি বলেন, “কোরবানির গরু কিনলে অন্তত ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা চলে যাবে। কিন্তু ওই টাকা দিয়েই আমি পরের মৌসুমের জন্য হাইব্রিড বীজ, ইউরিয়া সার আর শ্রমিক খরচ চালাতে পারি।”
বীজ ও সারের দামের উল্লম্ফন
গত বছরের তুলনায় এবার বীজ আলুর দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। বগুড়া কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ডায়মেন্ট ও গাজীপুরি জাতের বীজ আলুর প্রতি কেজি ৪৫-৫০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অন্যদিকে ইউরিয়া সারের বাজারমূল্যও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে, যা কৃষকের চিন্তা আরও বাড়িয়েছে।
স্থানীয় বাজারে আস্থাহীনতা, হিমাগারেও ঠাঁই নেই
বগুড়ার সিংহভাগ আলু জমা হয় হিমাগারে। তবে হিমাগার মালিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাষির আলু না কিনে ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করেন। এতে করে কৃষকরা দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।
কৃষক রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের আলু হিমাগারে রাখলেও পরে বিক্রি করে লাভ হয় না। দাম নির্ধারণ করে বড় বড় ব্যবসায়ী, আমরা শুধু ক্ষতিই দেখি।”
পরিবারের চাহিদা বনাম কৃষির প্রয়োজন
তিন সন্তানের জনক মোশাররফ হোসেন বলেন, “বাচ্চারা কোরবানির ঈদে খুশি হয় গরু দেখলে। কিন্তু আমি যদি গরু কিনি, তবে ফসলের জন্য সার কিনব কেমন করে? আবার যদি কিছু না করি, তাহলে পরিবারে মন খারাপ—তবু হয়তো ছাগল কিনে ঈদ করব।”
কৃষি কর্মকর্তাদের সুপারিশ
বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল বাতেন বলেন, “এবার কৃষকেরা একটু ক্ষতির মুখে পড়লেও সরকারের তরফ থেকে ভর্তুকি দিয়ে পরের মৌসুমে তাদের পাশে দাঁড়ানো হবে। ইতিমধ্যে কম সুদে কৃষি ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
উৎসবের রঙ ফিকে, তবু আশা টিকে আছে
আলুর দাম পড়ে গেলেও ঈদের আনন্দ একেবারে হারিয়ে যায়নি। অনেক কৃষক গরুর পরিবর্তে ছাগল বা খাসি কোরবানি দিচ্ছেন। কেউ কেউ আত্মীয়দের সঙ্গে যৌথভাবে কোরবানি করছেন, যাতে ধর্মীয় বিধান রক্ষা হয় আবার ব্যয়ও সীমিত থাকে।
কৃষক আবুল কাশেম বলেন, “আমরা গরু দিতে না পারলেও ঈদ করছি। আল্লাহর কাছে চাইব, আগামী মৌসুমটা যেন ভালো কাটে।”