ঈদুল আজহা—ত্যাগের উৎসব—শুধু ধর্মীয় অনুশীলন নয়, এটি ঢাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক জীবনের গভীর অংশ। যুগ যুগ ধরে এই উৎসব রাজধানী ঢাকায় পালিত হয়ে আসছে এক বিশেষ গৌরব আর ঐতিহ্যের সঙ্গে। এই পর্বে আমরা ঢাকায় ঈদুল আজহার সূচনা, এর ধর্মীয় তাৎপর্য, সামাজিক প্রস্তুতি, রান্নাবান্না, কোরবানি, ও দান-খয়রাতের ধারাবাহিকতা তুলে ধরব।
মুঘল আমলের ঈদগাহ থেকে শুরু
ঢাকায় ঈদুল আজহার উদযাপনের ইতিহাস বহু পুরনো। মুঘল আমলে নির্মিত ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ (প্রতিষ্ঠা: ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ) আজও ঈদের অন্যতম প্রধান নামাজের স্থান। শতাব্দী পেরিয়ে এলেও এটি আজও ঈদের সকালে লাখো মুসল্লির ভিড় ধারণ করে। এ ঈদগাহ শুধু নামাজের স্থান নয়, এটি ঢাকার ইসলামী ঐতিহ্যের জীবন্ত নিদর্শন।
ঈদের প্রস্তুতিতে ঢাকার প্রাণচাঞ্চল্য
ঈদের এক-দুই সপ্তাহ আগে থেকেই ঢাকাজুড়ে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। বিপণিবিতান, কাঁচাবাজার, পশুর হাট—সবখানেই মানুষের ঢল নামে। বিশেষ করে গাবতলী হাট, সায়েদাবাদ, অরণ্যঘেরা আমিনবাজার বা দনিয়া হাটে গরু-ছাগল কেনার ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। এসব জায়গায় শুধু কেনাবেচা নয়, চলে দরদাম, পশুর যত্ন, ও পশু নির্বাচনের নানারকম আচার।
ঈদের নামাজ ও কোরবানির তাৎপর্য
ঈদের দিন সকালে লাখো মুসল্লি জামাতে অংশ নেন। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমন্ডি ঈদগাহ, খিলগাঁও মাঠ, ও রমনা পার্কে হয় ঈদের বড় জামাত। নামাজ শেষে সবাই আলিঙ্গন করে একে অপরকে ‘ঈদ মোবারক’ জানান।
এরপর শুরু হয় কোরবানির কাজ। রাসুল (স.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করে কেউ গরু, কেউ ছাগল কোরবানি দেন। ঢাকার পাড়া-মহল্লা, বাসা-বাড়িতে চলে এই কোরবানির কাজ। এই ধর্মীয় অনুশীলন শুধু ত্যাগের শিক্ষা দেয় না, এটি সমাজে সমবণ্টনের সংস্কৃতি তৈরি করে—এক অংশ গরিবদের, এক অংশ আত্মীয়-স্বজনদের, এবং এক অংশ পরিবারের জন্য রাখা হয়।
ঢাকাই রান্নাবান্না: খাবারের ঐতিহ্য
কোরবানির ঈদ মানেই ঢাকার রান্নাঘরে ব্যস্ততা। পুরান ঢাকায় বিখ্যাত কাচ্চি বিরিয়ানি, খাসির রেজালা, গরুর চাপ, শুটকি দিয়ে মাংসের ঝাল, কিংবা পায়েস-কোরমা—সব মিলে চলে ঈদের বিশেষ আয়োজন। অনেকে পূর্বপুরুষের পুরোনো রেসিপি অনুসরণ করেন। পুরান ঢাকার বংশাল, লক্ষীবাজার, নবাবপুরে এখনও অনেক পরিবার ‘ঐতিহ্য রক্ষা’ করে একদিনে তিনবেলা আলাদা পদ রান্না করে।
সামাজিক উৎসব ও আনন্দঘন পরিবেশ
ঈদুল আজহা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক সম্মিলন। ঢাকার কিছু এলাকায় ঈদের পরদিন আয়োজন করা হয় ‘কোরবানি মেলা’। যেমন মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায় হয় লোকগান ও পিঠা মেলা। আবার কোরবানির মাংস ভাগাভাগির পর বহু এলাকায় চলে পাড়াভিত্তিক ভোজ—যেখানে সবাই একসঙ্গে বসে খায়। কেউ আমন্ত্রণ দেয় প্রতিবেশীকে, কেউ আয়োজনে নিয়ে আসে রকমারি খাবার। এতে দেখা যায় আন্তঃসম্পর্কের উষ্ণতা।
দান ও সমাজকল্যাণ
ঢাকার অনেক এনজিও, ছাত্র সংগঠন, বা স্বেচ্ছাসেবী দল কোরবানির ঈদের সময় আয়োজন করে মাংস বিতরণ কর্মসূচি। মিরপুর, কামরাঙ্গীরচর বা রামপুরার মতো এলাকায় এসব আয়োজন বেশি চোখে পড়ে। কেউ পরিবারসহ অংশ নেয়, কেউ একা এসে নিজের কোরবানির মাংস দিয়ে যায় দুস্থদের জন্য। এই ধারা ঈদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অনন্য দৃষ্টান্ত।