যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ঘোষণা করেছে, চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা “আগ্রাসীভাবে বাতিল” করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সংযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিরা কিংবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের শিক্ষার্থীরা নজরদারির আওতায় পড়বেন। ভবিষ্যতের সব আবেদনই কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
রুবিওর ঘোষণাকে চীনের প্রতি কঠোর অবস্থান হিসেবে দেখা হলেও এর পেছনে রয়েছে মারাত্মক ভুল হিসাব—যুক্তরাষ্ট্র শুধু বেইজিংকে নয়, নিজের উদ্ভাবন-প্রবাহকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের ভিত গড়ে তোলায় যে মেধা ও সৃজনশীলতার অবদান আছে, সেই উৎসকেই দূরে ঠেলে দিচ্ছে নতুন নীতি।
এটা নিরাপত্তা বনাম উন্মুক্ততার প্রশ্ন নয়; বরং আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। চীনা শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা শুধু শ্রেণিকক্ষ ভরাট করছেন না, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বায়োটেক ও পরিচ্ছন্ন শক্তি—এসব ক্ষেত্রে আমেরিকান অগ্রযাত্রায় চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিক থেকে চীন দ্বিতীয় স্থানে; ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ২,৭৭,৩৯৮ জন চীনা শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে, যা ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন-এর বার্ষিক জরিপ অনুযায়ী। তাদের বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গুপ্তচরবৃত্তি ঠেকাবে ভাবছে, বাস্তবে সে পথেই চীনকে প্রযুক্তি দৌড়ে অপ্রত্যাশিত সুবিধা দিয়ে দিচ্ছে।
আসল ঝুঁকি অনুপ্রবেশ নয়; তা অবান্তর। প্রতিভা দূরে ঠেলে দিলে যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে নিজের অবস্থান হারাতে পারে, আর প্রতিদ্বন্দ্বীরা সে সুযোগ লুফে নেবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রযুক্তিগত প্রাধান্যের লড়াইয়ে ‘প্রতিভা’ই চূড়ান্ত মুদ্রা। বহু বছর ধরে আমেরিকার বড় সুবিধা ছিল সারা বিশ্বের সেরা মেধা আকর্ষণ করার সক্ষমতা। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর প্রায় এক চতুর্থাংশই চীনের, আর তারা মূলত এসটিইএম (STEM)-খাতে, যা ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্নাতকোত্তর শেষে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে শিল্প ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখেন।
কিন্তু যখন ওয়াশিংটন ভিসা নিয়ম কঠোর করছে, বেইজিং লাল গালিচা পেতে দিচ্ছে। উন্নত গবেষণাগার, অনুদান, দ্রুত নাগরিকত্ব—এসব প্রণোদনা দিয়ে ‘থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান’-এর মতো কর্মসূচি বিশ্বসেরা গবেষক ও প্রকৌশলীদের টেনে নিচ্ছে। ফলে উল্টো মস্তিষ্কপলায়ন শুরু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র নিজের প্রতিযোগিতার সুবিধা নিজেই রপ্তানি করছে। বিদেশি সেরা মেধাকে এসে কাজ করার সুযোগ না দিলে আমেরিকার সমৃদ্ধি টিকবে কীভাবে? দরজা বন্ধ করে দিয়ে দেশটি বৈশ্বিক উদ্ভাবন দৌড়ে নিজেকে পেছনে ফেলতে পারে।
২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী—যার ৫৪ শতাংশ চীন ও ভারতের—মার্কিন অর্থনীতিতে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অবদান রেখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী। তারা শুধু পড়তেই আসে না; গবেষণাপত্রে সহলেখক হয়, পেটেন্ট ফাইল করে, স্টার্ট-আপ গড়ে তোলে। এরা গুপ্তচর নয়, বরং ক্যান্সার প্রতিরোধ, পরিচ্ছন্ন শক্তি উন্নয়ন বা কোয়ান্টাম এনক্রিপশন উন্নত করার মতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমেরিকানদের সঙ্গে কাজ করছে।
উদাহরণস্বরূপ, চীনা বিজ্ঞানীরা সিআরআইএসপিআর জিন-সম্পাদন প্রযুক্তিতে যুগান্তকারী অগ্রগতি সাধন করেছেন, চিকিৎসা নির্ণয়ের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুল তৈরি করেছেন। জুম, এনভিডিয়া ও অসংখ্য প্রযুক্তি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠায়ও চীনা উদ্যোক্তাদের ভূমিকা রয়েছে। তাদের অবদান কেবল তাত্ত্বিক নয়; আমেরিকান সমাজ ও বৈশ্বিক জনসমাজে এর বাস্তব সুফল মিলছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চীনা শিক্ষার্থীদের গুপ্তচর সন্দেহের গুজব ছড়ালেও, তাঁরাই আবার এআই-খাতে বড় অবদান রাখছেন। এই প্রতিভা অপসারণ মানেই আবিষ্কারের গতি কমে যাওয়া।
ইতিমধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিদেশি শিক্ষার্থী-নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক সংকটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মার্কিন প্রযুক্তি খাতের নির্বাহীরা সতর্ক করছেন—ভিসা বিধিনিষেধের ফলে গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র বিদেশে সরে যেতে পারে। আর চীন সেই প্রবাহকে স্বাগত জানাচ্ছে।
নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ, তবে যুক্তিবোধও জরুরি। প্রতিটি চীনা শিক্ষার্থীকে সম্ভাব্য গুপ্তচর ভাবা কেবল ভয়ানক নয়, উল্টো ফলদায়কও নয়। সার্বিক নিষেধাজ্ঞার বদলে কি অধিকতর লক্ষ্যভিত্তিক যাচাই সম্ভব নয়? জাতীয়তা নয়, প্রকৃত প্রমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নির্ধারণ করলে সংবেদনশীল প্রযুক্তি সুরক্ষিত থাকবে, আবার প্রতিভার ভাণ্ডারও অক্ষুণ্ন থাকবে।
বিশ্বের সেরা মেধা আকর্ষণ করেই যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সাফল্য পেয়েছে; দেয়াল তুলে নয়। যদি আমেরিকা চীনা শিক্ষার্থী-গবেষকদের সহযোগী নয়, হুমকি হিসেবে দেখে, তবে তারা শুধু নিজের পায়ে গুলি চালাবে না, বরং প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে বন্দুক তুলে দেবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বা ভ্যাকসিন উন্নয়নের পরবর্তী বড় সাফল্য ক্যালিফোর্নিয়া বা বেইজিং—যেকোনো এক ল্যাব থেকে আসতে পারে, তবে তার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেকে বিশ্ব থেকেও আলাদা না করতে হবে। সেরা মেধাকে তাড়িয়ে দেওয়া বিজয় নয়, আত্মসমর্পণ।
লেখক: নেপালভিত্তিক ব্যবসায়ী ব্রাবিম কার্কি দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, দ্য স্ট্রেইটস টাইমসসহ একাধিক গণমাধ্যমে নিয়মিত লেখেন।