০১:২০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

৭ জুন ৬-দফা দিবসঃ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সোপান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ জুন একটি গভীর তাৎপর্যময় দিন। এই দিনটি শুধু একটি কর্মসূচির অংশ ছিল না, বরং বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সোপানরূপে চিহ্নিত। ১৯৬৬ সালের এই দিনে পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবির পক্ষে সারাদেশে পালিত সর্বাত্মক হরতাল ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ মোট ১১ জন বাঙালি নিহত হন। ৬ দফা আন্দোলনে প্রথম নিহত হয়েছিলেন সিলেটের মনু মিয়া। ছয় দফা মূলত স্বাধীনতার এক দফা ছিল। ছয় দফার মধ্যেই স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।

১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি সংগৃহীত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা সংবলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যার নাম ছিল “ ছয় দফা আমাদের বাঁচার দাবি” ।

২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে ছয় দফা উত্থাপন করা হয়। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে(প্ররাষ্ট্র/উপররাষ্ট্র)পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয়দফা কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও, তৎক্ষণাৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পূর্ব পাকিস্তান বা তৎকালীন পূর্ব বাংলা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে। ভাষা আন্দোলন থেকেই তার সূত্রপাত ঘটে। এরপরের বছরগুলোতে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে চরম বৈষম্য, নিপীড়ন ও দমননীতি। অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসন, সামরিক বাহিনী—সবখানেই পূর্ববাংলার প্রতি অবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় কাঠামোগতভাবে। এই পটভূমিতে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা প্রদান করে। এতে বলা হয়, যদি সংবিধানের মাধ্যমে এই দাবিগুলো মানা হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তান বাস্তবিক অর্থেই একটি স্বশাসিত অঞ্চল হয়ে উঠবে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকে হলেও বাঙালির নিজস্ব অধিকার সংরক্ষিত থাকবে।

৬ দফায় কী ছিল :

১ : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;

২ : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু’টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।

৩ : মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু’টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-
(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা
(খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।

৪ : রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।

৫ : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

৬ : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

এই দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর পূর্ব বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা। পূর্ব বাংলার কৃষিপ্রধান জনগোষ্ঠী তখন প্রধানত পাট উৎপাদন করত, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস ছিল। অথচ এর রাজস্ব, লভ্যাংশ এবং সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তানেই থেকে যেত। শুধু অর্থনীতিতেই নয়, সামরিক কাঠামোতেও পূর্ব বাংলার বঞ্চনা ছিল প্রকট। সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব থেকে শুরু করে অফিসার ক্যাডারে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্ব ছিল নামমাত্র। শিক্ষা, চাকরি, প্রশাসন—সবখানে একই বৈষম্য। এই বঞ্চনার শিকড় উপড়ে ফেলার জন্য বঙ্গবন্ধু এই ছয় দফার রূপরেখা দেন, যা হয়ে ওঠে “বাঙালির মুক্তির সনদ”。

৬-দফা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা একে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টা করে ৬-দফাকে দমন করতে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়, যাতে বোঝা যায় কেন্দ্রীয় সরকার ৬-দফাকে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে নয়, বরং এক বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা ছিল, ৬-দফা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভাঙার নয়, বরং সঠিকভাবে টিকিয়ে রাখার সর্বশেষ সুযোগ। পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করার সর্বশেষ সাংবিধানিক প্রস্তাব ছিল ৬-দফা। কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী যদি ৬-দফা গ্রহণ করত, তাহলে ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে রচিত হতো। কিন্তু তারা বরং দমন-পীড়নকে বেছে নেয়।

৬-দফার পরের বছরগুলোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আর এই দাবিগুলো মানবে না। কিন্তু বাঙালিরা তা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন—সবকিছু ৬-দফা ভিত্তিক রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে উল্টো সামরিক অভিযান চালায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের বীজ রোপিত হয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু তার কাঠামোগত রূপরেখা ছিল ৬-দফা।

এই দিক থেকে বিবেচনা করলে, ৬-দফা দাবি এবং ৭ জুনের আন্দোলন কেবল একটি আন্দোলনের দিন নয়, এটি ছিল একটি জাতির আত্মবিকাশ ও আত্মসচেতনতার প্রথম কার্যকর ধাপ। বাঙালির জাতীয়তাবাদ, অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন, সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়—সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল এই দাবি। বঙ্গবন্ধু একে শুধু কাগজে-কলমে ছয়টি পয়েন্ট হিসেবে দেননি, তিনি এ দাবিকে এক বিস্তৃত রাজনৈতিক দর্শনের ভিত হিসেবে নির্মাণ করেন। তাঁর চোখে বাঙালির মুক্তির পথ এই ছয়টি পথ ধরে গড়ে উঠবে। বাস্তবেও তাই হয়।

এটি লক্ষণীয় যে, ৬-দফার সময়কার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ছিল বহুমাত্রিক। বামপন্থী দলগুলো একদিকে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণবিরোধী, কিন্তু ৬-দফা নিয়ে তাদের দ্বিধা ছিল। অনেকে মনে করত এটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বা পেটিবুর্জোয়া ধাঁচের দাবি। আবার কেউ কেউ এটিকে একটি জনগণের বাস্তব দাবির সারবত্তা হিসেবে দেখেছে। কিন্তু যখন শহরের শ্রমিক, গ্রামের কৃষক, ছাত্র-জনতা—সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ৬-দফার পক্ষে রাস্তায় নামে, তখন এটি কেবল রাজনৈতিক দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি হয়ে ওঠে গণমানুষের চেতনার প্রতিফলন। বঙ্গবন্ধু বারবার বলতেন, ‘৬-দফা মানে আমার জীবনের দাবি, আমার জাতির দাবি, আমার জনগণের দাবি।’ এই বক্তব্যে তাঁর রাজনৈতিক আত্মনির্ভরতা এবং দূরদর্শিতা প্রকাশ পায়।

৭ জুন এই চেতনার উদ্ভাসনের দিন। যে দিন বাঙালি প্রথম গণআন্দোলনে জীবন দিল এই ছয় দফা আদর্শ প্রতিষ্ঠায়, সেই দিনটি কেবল স্মরণীয় নয়, বরং অনুপ্রেরণার উৎস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন দিন খুব কমই আছে, যেদিন গণমানুষ এমন প্রত্যয় নিয়ে রাজপথে নেমেছে এবং শাসকের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক-ইতিহাস বুঝতে চাইলে ৭ জুনকে বুঝতেই হবে, এর রক্তক্ষয়, ত্যাগ, এবং যে বৈপ্লবিক রাজনীতির ভিত্তি এইদিনে নির্মিত হয়েছিল, তা উপলব্ধি করতেই হবে।

আজ যখন বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র, তখন ৭ জুন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই স্বাধীনতা হঠাৎ আসেনি, এটি একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। সেই সংগ্রামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ছিল ৬-দফা এবং তার রক্তাক্ত প্রকাশ ছিল ৭ জুন। এই দিনটির স্মৃতি শুধু অতীত নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও প্রাসঙ্গিক। আজও যখন আমরা অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কিংবা রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ মোকাবিলা করি, তখন ৭ জুন আমাদের শেখায় যে, নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়, আত্মনির্ভরতা অর্জন করতে হয় এবং নেতৃত্বের মধ্যে থাকতে হয় সাহস ও আত্মবিশ্বাস।

৭ জুন একটি দিগন্তরেখার নাম—যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এক জাতির আত্মপ্রত্যয়ের পথচলা। এ পথচলা শেষ হয়নি, বরং চলমান। তাই বাংলাদেশে ৭ জুনকে মনে রাখা, স্মরণ না করা, ইতিহাস থেকে স্বপ্রনোদিতভাবে দূরে চলে যাওয়া বা যাবার প্রবণতা কতটা ক্ষতিকর, সেটা সাময়িক আবেগ-উত্তেজনায় বোঝার নয়, রবং সব সময় মনে রাখতে হয় ইতিহাস বদলানো বা ভোলার নয়, ইতিহাসের পাতা নির্মম। সেখানে স্থান শুধু সত্যের। অন্য কোন কিছুই ইতিহাসের পাতায় বিশাল শক্তিমানও প্রবেশ করাতে পারে না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

৭ জুন ৬-দফা দিবসঃ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সোপান

০৮:০০:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ জুন একটি গভীর তাৎপর্যময় দিন। এই দিনটি শুধু একটি কর্মসূচির অংশ ছিল না, বরং বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সোপানরূপে চিহ্নিত। ১৯৬৬ সালের এই দিনে পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবির পক্ষে সারাদেশে পালিত সর্বাত্মক হরতাল ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ মোট ১১ জন বাঙালি নিহত হন। ৬ দফা আন্দোলনে প্রথম নিহত হয়েছিলেন সিলেটের মনু মিয়া। ছয় দফা মূলত স্বাধীনতার এক দফা ছিল। ছয় দফার মধ্যেই স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।

১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি সংগৃহীত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা সংবলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যার নাম ছিল “ ছয় দফা আমাদের বাঁচার দাবি” ।

২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে ছয় দফা উত্থাপন করা হয়। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে(প্ররাষ্ট্র/উপররাষ্ট্র)পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয়দফা কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও, তৎক্ষণাৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পূর্ব পাকিস্তান বা তৎকালীন পূর্ব বাংলা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে। ভাষা আন্দোলন থেকেই তার সূত্রপাত ঘটে। এরপরের বছরগুলোতে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে চরম বৈষম্য, নিপীড়ন ও দমননীতি। অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসন, সামরিক বাহিনী—সবখানেই পূর্ববাংলার প্রতি অবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় কাঠামোগতভাবে। এই পটভূমিতে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা প্রদান করে। এতে বলা হয়, যদি সংবিধানের মাধ্যমে এই দাবিগুলো মানা হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তান বাস্তবিক অর্থেই একটি স্বশাসিত অঞ্চল হয়ে উঠবে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকে হলেও বাঙালির নিজস্ব অধিকার সংরক্ষিত থাকবে।

৬ দফায় কী ছিল :

১ : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;

২ : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু’টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।

৩ : মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু’টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-
(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা
(খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।

৪ : রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।

৫ : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

৬ : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

এই দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর পূর্ব বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা। পূর্ব বাংলার কৃষিপ্রধান জনগোষ্ঠী তখন প্রধানত পাট উৎপাদন করত, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস ছিল। অথচ এর রাজস্ব, লভ্যাংশ এবং সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তানেই থেকে যেত। শুধু অর্থনীতিতেই নয়, সামরিক কাঠামোতেও পূর্ব বাংলার বঞ্চনা ছিল প্রকট। সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব থেকে শুরু করে অফিসার ক্যাডারে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্ব ছিল নামমাত্র। শিক্ষা, চাকরি, প্রশাসন—সবখানে একই বৈষম্য। এই বঞ্চনার শিকড় উপড়ে ফেলার জন্য বঙ্গবন্ধু এই ছয় দফার রূপরেখা দেন, যা হয়ে ওঠে “বাঙালির মুক্তির সনদ”。

৬-দফা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা একে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টা করে ৬-দফাকে দমন করতে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়, যাতে বোঝা যায় কেন্দ্রীয় সরকার ৬-দফাকে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে নয়, বরং এক বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা ছিল, ৬-দফা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভাঙার নয়, বরং সঠিকভাবে টিকিয়ে রাখার সর্বশেষ সুযোগ। পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করার সর্বশেষ সাংবিধানিক প্রস্তাব ছিল ৬-দফা। কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী যদি ৬-দফা গ্রহণ করত, তাহলে ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে রচিত হতো। কিন্তু তারা বরং দমন-পীড়নকে বেছে নেয়।

৬-দফার পরের বছরগুলোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আর এই দাবিগুলো মানবে না। কিন্তু বাঙালিরা তা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন—সবকিছু ৬-দফা ভিত্তিক রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে উল্টো সামরিক অভিযান চালায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের বীজ রোপিত হয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু তার কাঠামোগত রূপরেখা ছিল ৬-দফা।

এই দিক থেকে বিবেচনা করলে, ৬-দফা দাবি এবং ৭ জুনের আন্দোলন কেবল একটি আন্দোলনের দিন নয়, এটি ছিল একটি জাতির আত্মবিকাশ ও আত্মসচেতনতার প্রথম কার্যকর ধাপ। বাঙালির জাতীয়তাবাদ, অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন, সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়—সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল এই দাবি। বঙ্গবন্ধু একে শুধু কাগজে-কলমে ছয়টি পয়েন্ট হিসেবে দেননি, তিনি এ দাবিকে এক বিস্তৃত রাজনৈতিক দর্শনের ভিত হিসেবে নির্মাণ করেন। তাঁর চোখে বাঙালির মুক্তির পথ এই ছয়টি পথ ধরে গড়ে উঠবে। বাস্তবেও তাই হয়।

এটি লক্ষণীয় যে, ৬-দফার সময়কার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ছিল বহুমাত্রিক। বামপন্থী দলগুলো একদিকে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণবিরোধী, কিন্তু ৬-দফা নিয়ে তাদের দ্বিধা ছিল। অনেকে মনে করত এটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বা পেটিবুর্জোয়া ধাঁচের দাবি। আবার কেউ কেউ এটিকে একটি জনগণের বাস্তব দাবির সারবত্তা হিসেবে দেখেছে। কিন্তু যখন শহরের শ্রমিক, গ্রামের কৃষক, ছাত্র-জনতা—সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ৬-দফার পক্ষে রাস্তায় নামে, তখন এটি কেবল রাজনৈতিক দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি হয়ে ওঠে গণমানুষের চেতনার প্রতিফলন। বঙ্গবন্ধু বারবার বলতেন, ‘৬-দফা মানে আমার জীবনের দাবি, আমার জাতির দাবি, আমার জনগণের দাবি।’ এই বক্তব্যে তাঁর রাজনৈতিক আত্মনির্ভরতা এবং দূরদর্শিতা প্রকাশ পায়।

৭ জুন এই চেতনার উদ্ভাসনের দিন। যে দিন বাঙালি প্রথম গণআন্দোলনে জীবন দিল এই ছয় দফা আদর্শ প্রতিষ্ঠায়, সেই দিনটি কেবল স্মরণীয় নয়, বরং অনুপ্রেরণার উৎস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন দিন খুব কমই আছে, যেদিন গণমানুষ এমন প্রত্যয় নিয়ে রাজপথে নেমেছে এবং শাসকের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক-ইতিহাস বুঝতে চাইলে ৭ জুনকে বুঝতেই হবে, এর রক্তক্ষয়, ত্যাগ, এবং যে বৈপ্লবিক রাজনীতির ভিত্তি এইদিনে নির্মিত হয়েছিল, তা উপলব্ধি করতেই হবে।

আজ যখন বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র, তখন ৭ জুন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই স্বাধীনতা হঠাৎ আসেনি, এটি একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। সেই সংগ্রামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ছিল ৬-দফা এবং তার রক্তাক্ত প্রকাশ ছিল ৭ জুন। এই দিনটির স্মৃতি শুধু অতীত নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও প্রাসঙ্গিক। আজও যখন আমরা অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কিংবা রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ মোকাবিলা করি, তখন ৭ জুন আমাদের শেখায় যে, নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়, আত্মনির্ভরতা অর্জন করতে হয় এবং নেতৃত্বের মধ্যে থাকতে হয় সাহস ও আত্মবিশ্বাস।

৭ জুন একটি দিগন্তরেখার নাম—যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এক জাতির আত্মপ্রত্যয়ের পথচলা। এ পথচলা শেষ হয়নি, বরং চলমান। তাই বাংলাদেশে ৭ জুনকে মনে রাখা, স্মরণ না করা, ইতিহাস থেকে স্বপ্রনোদিতভাবে দূরে চলে যাওয়া বা যাবার প্রবণতা কতটা ক্ষতিকর, সেটা সাময়িক আবেগ-উত্তেজনায় বোঝার নয়, রবং সব সময় মনে রাখতে হয় ইতিহাস বদলানো বা ভোলার নয়, ইতিহাসের পাতা নির্মম। সেখানে স্থান শুধু সত্যের। অন্য কোন কিছুই ইতিহাসের পাতায় বিশাল শক্তিমানও প্রবেশ করাতে পারে না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।