ভূমিকা
পাঁচ মাস ধরে দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ আবার বাড়ছে। শুক্রবারের সর্বশেষ বুলেটিনে দৈনিক পরীক্ষার পজিটিভিটি হার ১৪.২৯ শতাংশে পৌঁছেছে।বিশেষজ্ঞদের মতে এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা মূলত NB.1.8.1 নামের একটি নতুন উপধারা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে জড়িত । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ভ্যারিয়েন্টটিকে “ভ্যারিয়েন্ট আন্ডার মনিটরিং (VUM)” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে; মধ্য-মে নাগাদ এটি বিশ্বব্যাপী জিনোম সিকোয়েন্সের ১০.৭ শতাংশে শনাক্ত হয়েছে ।
NB.1.8.1 কী এবং কেন তা আলাদা
NB.1.8.1 হচ্ছে Omicron-এর JN.1 লাইনের বংশধর, যার স্পাইক প্রোটিনে ছয়টি অতিরিক্ত মিউটেশন (T22N, F59S, G184S, A435S, V445H, T478I) রয়েছে। গবেষণা বলছে, V445H মিউটেশন ACE2 রিসেপ্টরের সঙ্গে ভাইরাসের যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে সংক্রমণ-ক্ষমতা বাড়াতে পারে, আর T478I কিছু অ্যান্টিবডি এড়িয়ে যেতে সাহায্য করে । তবে এখন পর্যন্ত রোগের তীব্রতা LP.8.1-এর চেয়ে বেশি নয় ।
উপসর্গে কী ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে
সংক্রমিতদের বেশিরভাগের উপসর্গ আগের মতোই—জ্বর, কাশি, গলা-ব্যথা, নাক বন্ধ বা সর্দি, মাথা-ব্যথা ও ক্লান্তি। তবে NB.1.8.1-এ পেটের গোলযোগ, হালকা চর্মর্যাশ ও দীর্ঘস্থায়ী ডায়ারিয়া তুলনামূলক বেশি দেখা যাচ্ছে । যুক্তরাষ্ট্রের কেস-স্টাডির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক অ্যামি এডওয়ার্ডস জানান, ‘চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়াই অধিকাংশ রোগী সাত-দশ দিনেই সেরে উঠলেও কয়েক সপ্তাহ ধরে গ্যাসট্রো-ইনটেস্টাইনাল সমস্যা থাকছে’।
বাংলাদেশি রোগীদের অভিজ্ঞতা
• ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ৩৮-বছরের শিক্ষক হাসান কবির জানান, “বাড়তি কোনো শ্বাসকষ্ট না থাকলেও টানা তিন দিন পেট খারাপ ও মাথা-ব্যথায় ভুগেছি; গন্ধ ও স্বাদও আংশিক হারিয়েছিলাম।” ডাক্তারি পরীক্ষায় NB.1.8.1 ধরা পড়ে এবং পাঁচ দিনের অ্যান্টিভাইরাল কোর্সের পর স্বাভাবিক হন।
• সিরাজগঞ্জের গৃহশিক্ষক রুবিনা আক্তারের (৪৫) প্রধান অভিযোগ ছিল তীব্র ক্লান্তি: “জ্বর নামে-ওঠে, কিন্তু বেশি দম বন্ধ হয়নি। সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছে ঘুম থেকে ওঠার সময় শরীরে ব্যথা।” তিনি পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া সত্ত্বেও আক্রান্ত হন; চিকিৎসকরা ‘ব্রেক-থ্রু ইনফেকশন’ বলে ব্যাখ্যা করেন, যা NB.1.8.1-এ তুলনামূলক বেশি দেখা যাচ্ছে ।
চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, “নতুন ভ্যারিয়েন্ট টিকা নেওয়া ব্যক্তিকেও সংক্রমিত করতে পারছে, কিন্তু হাসপাতালে অক্সিজেন-নির্ভর রোগীর হার কম — এটিই স্বস্তি। তুবস মেডিসিনের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ডা. শিরা ডরনের মত অনুযায়ী, NB.1.8.1 তুলনামূলক বেশি ছোঁয়াচে হলেও রোগ তীব্রতায় এখনো বড় পার্থক্য আনেনি ।
মানসিক-সামাজিক অভিঘাত
অনেক রোগীই জানান, কোভিড ধরা পড়ার চেয়ে পরিবারের মনোভাব ও প্রতিবেশীর প্রতিক্রিয়া তাঁদের বেশি চাপ দিয়েছে। ঢাকার বাসিন্দা সুমিতা সাহা (৩২) বলেন, “ডাক্তারেরা বলছিলেন বিচ্ছিন্ন থাকতে; কিন্তু বাসার ছোট বাচ্চা দূরে রাখা কঠিন। আরও মুশকিল হয়েছে এলাকায় আবার ‘কোভিড’ নিয়ে গুজব ছড়াতে।” চিকিৎসকেরা বলছেন, NB.1.8.1-এ দীর্ঘ-কোভিডের সম্ভাবনা এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি; তাই মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও পরবর্তী ফলো-আপ জরুরি ।
সরকারি প্রস্তুতি ও জনসচেতনতা
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই ভিড়ের মধ্যে মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার পূর্বের নির্দেশনা আবার সক্রিয় করেছে; অনুরোধ জানানো হয়েছে বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের বাড়তি সতর্কতা মানতে । ডব্লিউএইচও-র সুপারিশ অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য যেকোনো উপলভ্য টিকা গ্রহণ বিলম্ব না করার পরামর্শও পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে ।
কি করণীয়
১. উপসর্গ দেখা দিলে পাঁচ দিনের মধ্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা ও ডাক্তারি পরামর্শ নিন।
২. বাড়িতে শিশু, বয়স্ক বা কো-মরবিড কেউ থাকলে আইসোলেশন মেনে চলুন।
৩. হালকা অসুখ হলেও বিশ্রাম, পানি ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করুন; পেটের সমস্যায় ইলেক্ট্রোলাইট সল্যুশন রাখুন।
৪. যারা গত ছয় মাসে টিকা নেননি, দ্রুত বুস্টার ডোজ নিন—বিশেষ করে বয়স্ক, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি।
৫. সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক চাপ কমাতে পরিবার-বন্ধুর সহায়তা নিন; দীর্ঘ-কোভিড উপসর্গ থাকলে পুনর্বাসন পরিষেবা গ্রহণ করুন।
NB.1.8.1 নতুন আতঙ্ক না হলেও স্মরণ করিয়ে দেয়—ভাইরাসটি এখনও বিবর্তিত হচ্ছে এবং স্বাস্থ্য-সুরক্ষা অভ্যাসে ঢিল দিলে সংক্রমণ বাড়তে পারে। উপসর্গ তুলনামূলক মৃদু হলেও অনিয়ন্ত্রণে ছড়ালে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তাই টিকাকরণ, সময়মতো পরীক্ষা, সঠিক তথ্য ও পারস্পরিক সহমর্মিতা—এই চার স্তম্ভই নতুন ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।