পুরান ঢাকার ঈদ মানেই সারাদিনজুড়ে একটানা রান্না, খাওয়া আর আত্মীয়তার উদ্যাপন। তবে ঈদের দুপুরের রাজকীয় ভোজের পরেও উৎসবের মূল সুর থেমে থাকে না। বিকেল ঘনিয়ে এলে আরেকবার প্রাণচাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে গলিগুলোতে। এবার রান্নাঘরে প্রস্তুত হয় একেকটা ঘ্রাণে ভরা বিশেষ খাবার—চাপ, শিক কাবাব, রেজালা কিংবা নানারকমের পিঠাপুলি। আর একইসঙ্গে শুরু হয় একটি অনন্য সামাজিক প্রথা—খাবার ভাগাভাগি, যা পুরান ঢাকার সংস্কৃতির এক গৌরবময় দিক।
বিকেলের রাজা: চাপ
ঈদের বিকেলে পুরান ঢাকার প্রতিটি পাড়ায় একটি খাবার প্রায় অবধারিত—চাপ। গরুর পাঁজরের মাংস দিয়ে তৈরি এই খাবারটি রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, এলাচ, দারুচিনি, গোলমরিচ এবং দই দিয়ে মেরিনেট করে কয়েক ঘণ্টা রেখে, ধীরে ধীরে সেদ্ধ করে এরপর কয়লার আগুনে ঝলসানো হয়। গন্ধে মাটির মতো গভীরতা আর স্বাদে রাজার মতো রাজকীয়তা—এটাই চাপ।
চাপ সাধারণত রুটি, পরোটা কিংবা খামিরি নানরুটি দিয়ে পরিবেশন করা হয়। কিছু পরিবারে ‘মাংসের চাপ খিচুড়ি’ নামের বিশেষ পদও তৈরি হয়, যেখানে চাপের রস দিয়ে ভাত রান্না করা হয়।
শিক কাবাব ও রেজালা
চাপের পাশাপাশি শিক কাবাব ও রেজালাও বিকেলের সময় অনেক বাড়ির পছন্দের তালিকায় থাকে। শিক কাবাবে গরুর মাংসের কিমা, পেঁয়াজ, ধনে পাতা, কাঁচা মরিচ এবং বিশেষ মসলা মিশিয়ে বাঁশের বা স্টিলের শিকে গেঁথে কয়লার আগুনে ঝলসানো হয়। এর পাশে থাকে পুদিনা চাটনি আর পাতলা পরোটা।
রেজালা আবার একদম ভিন্ন ধাঁচের পদ। এটি ঘন সাদা রঙের, কেওড়া জল ও ঘি-ভিত্তিক একটি সুগন্ধি কারি। এর সঙ্গে পরিবেশন করা হয় সাদা পোলাও বা ঘিয়ে ভাজা রুটি।
খাবার ভাগাভাগি: এক দুর্লভ ঐতিহ্য
পুরান ঢাকার আরেকটি বিশেষ রেওয়াজ হলো খাবার ভাগাভাগি করা। বিকেলে, যখন কিছুটা বিশ্রাম নেওয়া হয় দুপুরের পর, তখন প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠানো হয় প্লেটভরা মাংস, কাবাব, চাপ বা রেজালা। কখনো বা পাঠানো হয় মিষ্টি, পায়েস বা শিরা। কেউ হাতে করে নিয়ে যান, কেউ পাঠান কাজের লোক দিয়ে। আবার সেই প্রতিবেশীও ফিরিয়ে দেন তাঁদের বানানো পদ।
এই খাবার দেওয়া-নেওয়া শুধুই সৌজন্য নয়—এটি সম্পর্ক রক্ষার প্রতীক। কারো বাড়িতে অতিথি বেশি, কেউ অসুস্থ, কেউ সদ্য এসেছেন ঢাকায়—তাঁদের দিকে বাড়তি খেয়াল রাখেন আশেপাশের মানুষ। এমনকি ভাড়াটিয়া পরিবার কিংবা একাকী বাস করা বৃদ্ধরাও এই ভাগাভাগির বাইরে থাকেন না।
বাচ্চাদের জন্য আলাদা আয়োজন
পুরান ঢাকায় বাচ্চাদের জন্য বিকেলে থাকে আলাদা আয়োজন। কেউ বানিয়ে রাখেন বিরিয়ানি, কেউ বানান চিকেন নাগেটস বা ফ্রাইড চিকেন। কিছু বাড়িতে বানানো হয় পোলাও ও মিষ্টি কোপ্তা, যা শিশুরা সহজে খেতে পারে। আবার অনেকে বানিয়ে রাখেন নানা রকমের মিষ্টান্ন—সুজির হালুয়া, পায়েস, কিংবা জিলাপি।
বাচ্চারা এ সময় ঘুরে বেড়ায় পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে। কোথাও গিয়েই যদি কোনো খাবারের গন্ধ পায়, সঙ্গে সঙ্গে বলেই ফেলে, “খাবো।” আর বাড়ির লোকজন সাদরে খাওয়ান।
মহল্লার আড্ডা ও খাবার
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই শুরু হয় ছাদবিলাস কিংবা পাড়ার আড্ডা। চা, শরবত, পেঁয়াজু, বেগুনি, অথবা মাংস দিয়ে বানানো স্ন্যাক্স দিয়ে চলে পরিবেশন। তরুণরা ছাদে বসে গিটার বাজায়, গল্প করে, কেউ কেউ তো কবিতাও বলে।
অনেক মহল্লায় আজও চালু আছে গ্রুপ-ভিত্তিক রান্না ও ভাগাভাগির ব্যবস্থা। কয়েকজন মিলে একসঙ্গে রান্না করেন, তারপর সবাই বসে একসঙ্গে খান। এই সম্মিলিত ভোজ পুরান ঢাকার সামাজিক সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
শান্তি ও শেখা
স্থানীয় বাসিন্দা আবু সামাদ সাহেব (৬৩), যিনি চকবাজার এলাকায় থাকেন, বলেন, “আমার ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি—ঈদের বিকেলে চাপ না হলে ঈদ যেন জমেই না। আর প্রতিবেশীকে কিছু না পাঠালে মনের শান্তি হয় না।”
আরেক বাসিন্দা, বেগম রেহানা (৫২), জানান, “মেয়েরা একেক বাড়িতে রান্না শিখে, আবার অন্যদের শেখায়। কোরবানির ঈদ শুধু রান্না নয়, শেখা ও শেখানোর সময়ও বটে।”
বিকেলের ভাগাভাগি মানেই সামাজিক বন্ধনের দৃশ্যমান রূপ
পুরান ঢাকার ঈদের বিকেল যেন একটি ছোট সামাজিক উৎসব। শুধু পেট ভরে খাওয়ার আনন্দই নয়, বরং সেই আনন্দ অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলে এক মানবিক সমাজ। এই ভাগাভাগির ভিতরেই লুকিয়ে আছে পরস্পরের প্রতি সম্মান, সহানুভূতি ও ভালোবাসা।