০১:০৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বেসরকারি খাতই চালিকা শক্তি হবে

ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে এখন এক বিপুল রূপান্তরের সময়। আগে যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ও আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা ছিল প্রাধান্যশীল, সেখানে এখন দেশীয় একটি শক্তিশালী ও স্বনির্ভর প্রতিরক্ষা শিল্পভিত্তি গড়ে তোলা হচ্ছে। এই পরিবর্তনের প্রধান প্রেরণা হল প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও ক্রয়ে বেসরকারি খাতকে কৌশলগতভাবে যুক্ত করার সাহসী নীতি-পরিবর্তন। ভারতকে বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা নির্মাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত করার লক্ষ্য সামনে রেখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এই যাত্রায় বেসরকারি খাতকে শুধু অংশীদার নয়, নেতৃত্বদাতা হিসেবেই দেখতে হবে।

সম্প্রতি ঘোষিত অ্যাডভান্সড মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফট (এএমসিএ) কর্মসূচি—ভারতের প্রথম নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ ফাইটার প্রকল্প—একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত নির্দেশ করে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি অংশগ্রহণের দরজা খুলে দিয়ে সরকার প্রকল্পের কাঠামোতেই দক্ষতা, উদ্ভাবনা ও ঝুঁকি ভাগাভাগির সংস্কৃতি স্থাপন করছে।

ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও)-নির্ভর পূর্ববর্তী উদ্যোগ, যেমন লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট (তেজস) কর্মসূচিতে যেসব সীমাবদ্ধতা—দীর্ঘ বিলম্ব ও ব্যয়-বৃদ্ধি—দেখা গিয়েছিল, এ-এমসিএ-র নতুন মডেল সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে গবেষণায় ডিআরডিও-র সক্ষমতার সঙ্গে বেসরকারি খাতের বাস্তবায়নশক্তি ও শিল্প-সমৃদ্ধিকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে মিলিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রতিরক্ষা ক্রয়ব্যবস্থা ছিল, কম স্বচ্ছতা,  সীমিত প্রতিযোগিতা ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিনির্ভরশীলতার দ্বারা চিহ্নিত। তবে গত এক দশকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ক্রমান্বয়ে আরও স্বচ্ছ ও বাজারমুখী ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিফেন্স প্রকিউরমেন্ট প্রসিডিউর (ডিপিপি) সংশোধন করে ২০২০ সালের ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন প্রসিডিউর (ডিএপি) করা হয়, যার লক্ষ্য সর্বোচ্চ জনদায়িত্ব, স্বচ্ছতা, ন্যায়সঙ্গত প্রতিযোগিতা ও বেসরকারি শিল্পকে সমপর্যায় প্রদান। ‘বাই ইন্ডিয়ান-আইডিডিএম’ (দেশীয়ভাবে নকশাকৃত, উন্নয়ন ও উৎপাদিত) এবং ‘বাই অ্যান্ড মেক (ইন্ডিয়ান)’ শ্রেণিতে ভারতীয় বিক্রেতাদের অগ্রাধিকার দিয়ে ডিএপি ২০২০ একাধারে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে এবং একক বিক্রেতার নির্ভরতাও কমিয়েছে। পাশাপাশি আইডিইএক্স ও ‘সমর্থ্য’ উদ্যোগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার যুদ্ধ ও দেশীয় অস্ত্রব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ত্বরান্বিত করছে।

এএমসিএ-কে প্রতিযোগিতামূলক বিডের আওতায় নেওয়া এই বিকাশমান নীতিপরিপার্শ্বের স্বাভাবিক সম্প্রসারণ। প্রথমবারের মতো একটি উচ্চ-মূল্যের, কৌশলগত দৃষ্টিকোণে গুরুত্বপূর্ণ ফাইটার এয়ারক্রাফট প্রকল্প বেসরকারি নেতৃত্বে উন্নয়নের জন্য উন্মুক্ত হলো। এতে বেসরকারি খাতের জটিল, প্রান্ত-থেকে-প্রান্ত প্ল্যাটফর্ম উন্নয়নে সক্ষমতার প্রতি সরকারের আস্থার নতুন মাত্রা ফুটে ওঠে।

বর্তমানে ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বেসরকারি খাতের অংশীদারি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট প্রতিরক্ষা উৎপাদনের প্রায় ২১ শতাংশ। রোবটিক্স, ইউএভি, নজরদারি ব্যবস্থা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক যুদ্ধক্ষেত্র স্নায়ুতে অগ্রণী সমাধান নিয়ে স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলিও দ্রুত উঠে আসছে। লারসেন অ্যান্ড টুব্রো, ভারত ফোর্জ, টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমসসহ কয়েকটি কোম্পানির সাফল্য—ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও বৈশ্বিক ওয়েমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, প্ল্যাটফর্ম ও সাব-সিস্টেম সরবরাহ—প্রমাণ করে যে ভারতীয় শিল্প এখন আরও কৌশলগত ও উচ্চ-মূল্য প্রকল্পে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এই প্রস্তুতিকে সজীব রাখতে প্রয়োজন ধারাবাহিক প্রকল্পপাইপলাইন, নীতিগত স্থায়িত্ব, সময়মতো সিদ্ধান্ত এবং গবেষণা ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ।

২০২৯ সালের মধ্যে ৩ লক্ষ কোটি টাকার প্রতিরক্ষা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও অর্জনযোগ্য। যদিও নীতিগত সংস্কার বেসরকারি অংশগ্রহণের পথ খুলেছে, পূর্ণ সম্ভাবনা সফল করতে চাই টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা, সরলীকৃত প্রক্রিয়া ও গভীর শিল্প-সরকার সহযোগিতা।

সময়মতো প্রকল্পবাস্তবায়ন একটি পূর্বানুমেয় চাহিদা-পাইপলাইন তৈরি করবে, যাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতায় বিনিয়োগ করতে পারে। এতে খরচ-বৃদ্ধি কমার পাশাপাশি বৈশ্বিক সরবরাহ দক্ষতা-সম্পন্ন দেশীয় প্ল্যাটফর্ম সমন্বয়কারীর উত্থান ঘটবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিরক্ষা প্রকল্প দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য বাস্তবায়িত হলে ভারতের অপারেশনাল প্রস্তুতি ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা বাড়বে, যা সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করবে।

কর-ছাড় ও যৌথ গবেষণা উদ্যোগের মতো পদক্ষেপ নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহ দিলে ভারত প্রযুক্তি আমদানিকারক থেকে বৈশ্বিক উদ্ভাবকেে পরিণত হতে পারে। এতে স্বত্বাধিকারী মেধাস্বত্ত্ব তৈরি হবে, বৈশ্বিক ক্রেতা আকৃষ্ট হবে এবং কৌশলগত নির্ভরতা কমবে।

ক্রয়-প্রক্রিয়া সরলীকরণ ও ‘সিঙ্গেল উইন্ডো’ ছাড়পত্র ব্যবস্থা চালু করলে প্রবেশ-বাধা কমবে এবং আরও বিস্তৃত পরিসরের প্রতিষ্ঠান প্রতিরক্ষা উৎপাদনে আসতে আগ্রহী হবে। ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো সিস্টেম ব্যবসা-সূচকে জটিলতা কমালেও প্রতিরক্ষা-কেন্দ্রিক একটি আলাদা ছাড়পত্র ব্যবস্থার দরকার, যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসমূহ একত্রে থাকবে। এর ফলে প্রতিযোগিতা বাড়বে, কার্যকারিতা উন্নত হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ উপ-খাতে মান বৃদ্ধি পাবে।

প্রতিরক্ষা নির্মাণে বেসরকারি অংশগ্রহণ বাড়লে শিল্প-বাস্তবভিত্তির জুড়িদিকেও শক্তিশালী প্রভাব পড়বে। হাইটেক প্রতিরক্ষা প্ল্যাটফর্ম উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধাতুবিদ্যা, কম্পোজিট উপাদান, নিখুঁত যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক্স, সেমি-কন্ডাক্টর, সাইবার সুরক্ষা ও উন্নত উৎপাদনশিল্পে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে ভারতের শিল্পায়নের আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত হবে এবং নির্মাণ-ভিত্তির টেকসই সক্ষমতাও বাড়বে।

ভারত এখন প্রতিরক্ষা সংস্কারকে সামগ্রিক শিল্পীয় পুনরুত্থান ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের ইঞ্জিনে পরিণত করার দ্বারপ্রান্তে। যদি ভারতকে সত্যিকারের ‘উৎপাদনশক্তি’তে উঠতে হয়, প্রতিরক্ষা খাতই হবে প্রথম সীমান্ত। ইন্টারনেট, জিপিএস, ক্যানজাত খাবার, কম্পিউটার এবং ডিজিটাল ক্যামেরা—এসবই একসময় সামরিক উদ্ভাবন ছিল, যা পরে সাধারণ জীবনে প্রবেশ করেছে।

প্রতিযোগিতামূলক বিড, সহ-উন্নয়ন মডেল এবং বৃহত্তর স্বচ্ছতার দিকে এই স্খডবদল ভারতের প্রতিরক্ষা নির্মাণে নতুন যুগ সূচিত করছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে ভারত জাতীয় ‘চ্যাম্পিয়ন’ গড়ে তুলতে পারবে, যারা বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খল গঠনে বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে সমকক্ষ হবে। এই নীতি-পরিবর্তন ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও কৌশলগত উদ্ভাবনে একটি শক্তিশালী শক্তি হয়ে উঠতে পারে।

লেখক: অমিতাভ কান্ত ভারতের জি-২০ শেরপা এবং নীতি আয়োগের সাবেক সিইও।

 

প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বেসরকারি খাতই চালিকা শক্তি হবে

১২:৪৫:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫

ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে এখন এক বিপুল রূপান্তরের সময়। আগে যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ও আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা ছিল প্রাধান্যশীল, সেখানে এখন দেশীয় একটি শক্তিশালী ও স্বনির্ভর প্রতিরক্ষা শিল্পভিত্তি গড়ে তোলা হচ্ছে। এই পরিবর্তনের প্রধান প্রেরণা হল প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও ক্রয়ে বেসরকারি খাতকে কৌশলগতভাবে যুক্ত করার সাহসী নীতি-পরিবর্তন। ভারতকে বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা নির্মাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত করার লক্ষ্য সামনে রেখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এই যাত্রায় বেসরকারি খাতকে শুধু অংশীদার নয়, নেতৃত্বদাতা হিসেবেই দেখতে হবে।

সম্প্রতি ঘোষিত অ্যাডভান্সড মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফট (এএমসিএ) কর্মসূচি—ভারতের প্রথম নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ ফাইটার প্রকল্প—একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত নির্দেশ করে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি অংশগ্রহণের দরজা খুলে দিয়ে সরকার প্রকল্পের কাঠামোতেই দক্ষতা, উদ্ভাবনা ও ঝুঁকি ভাগাভাগির সংস্কৃতি স্থাপন করছে।

ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও)-নির্ভর পূর্ববর্তী উদ্যোগ, যেমন লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট (তেজস) কর্মসূচিতে যেসব সীমাবদ্ধতা—দীর্ঘ বিলম্ব ও ব্যয়-বৃদ্ধি—দেখা গিয়েছিল, এ-এমসিএ-র নতুন মডেল সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে গবেষণায় ডিআরডিও-র সক্ষমতার সঙ্গে বেসরকারি খাতের বাস্তবায়নশক্তি ও শিল্প-সমৃদ্ধিকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে মিলিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রতিরক্ষা ক্রয়ব্যবস্থা ছিল, কম স্বচ্ছতা,  সীমিত প্রতিযোগিতা ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিনির্ভরশীলতার দ্বারা চিহ্নিত। তবে গত এক দশকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ক্রমান্বয়ে আরও স্বচ্ছ ও বাজারমুখী ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিফেন্স প্রকিউরমেন্ট প্রসিডিউর (ডিপিপি) সংশোধন করে ২০২০ সালের ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন প্রসিডিউর (ডিএপি) করা হয়, যার লক্ষ্য সর্বোচ্চ জনদায়িত্ব, স্বচ্ছতা, ন্যায়সঙ্গত প্রতিযোগিতা ও বেসরকারি শিল্পকে সমপর্যায় প্রদান। ‘বাই ইন্ডিয়ান-আইডিডিএম’ (দেশীয়ভাবে নকশাকৃত, উন্নয়ন ও উৎপাদিত) এবং ‘বাই অ্যান্ড মেক (ইন্ডিয়ান)’ শ্রেণিতে ভারতীয় বিক্রেতাদের অগ্রাধিকার দিয়ে ডিএপি ২০২০ একাধারে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে এবং একক বিক্রেতার নির্ভরতাও কমিয়েছে। পাশাপাশি আইডিইএক্স ও ‘সমর্থ্য’ উদ্যোগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার যুদ্ধ ও দেশীয় অস্ত্রব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ত্বরান্বিত করছে।

এএমসিএ-কে প্রতিযোগিতামূলক বিডের আওতায় নেওয়া এই বিকাশমান নীতিপরিপার্শ্বের স্বাভাবিক সম্প্রসারণ। প্রথমবারের মতো একটি উচ্চ-মূল্যের, কৌশলগত দৃষ্টিকোণে গুরুত্বপূর্ণ ফাইটার এয়ারক্রাফট প্রকল্প বেসরকারি নেতৃত্বে উন্নয়নের জন্য উন্মুক্ত হলো। এতে বেসরকারি খাতের জটিল, প্রান্ত-থেকে-প্রান্ত প্ল্যাটফর্ম উন্নয়নে সক্ষমতার প্রতি সরকারের আস্থার নতুন মাত্রা ফুটে ওঠে।

বর্তমানে ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বেসরকারি খাতের অংশীদারি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট প্রতিরক্ষা উৎপাদনের প্রায় ২১ শতাংশ। রোবটিক্স, ইউএভি, নজরদারি ব্যবস্থা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক যুদ্ধক্ষেত্র স্নায়ুতে অগ্রণী সমাধান নিয়ে স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলিও দ্রুত উঠে আসছে। লারসেন অ্যান্ড টুব্রো, ভারত ফোর্জ, টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমসসহ কয়েকটি কোম্পানির সাফল্য—ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও বৈশ্বিক ওয়েমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, প্ল্যাটফর্ম ও সাব-সিস্টেম সরবরাহ—প্রমাণ করে যে ভারতীয় শিল্প এখন আরও কৌশলগত ও উচ্চ-মূল্য প্রকল্পে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এই প্রস্তুতিকে সজীব রাখতে প্রয়োজন ধারাবাহিক প্রকল্পপাইপলাইন, নীতিগত স্থায়িত্ব, সময়মতো সিদ্ধান্ত এবং গবেষণা ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ।

২০২৯ সালের মধ্যে ৩ লক্ষ কোটি টাকার প্রতিরক্ষা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও অর্জনযোগ্য। যদিও নীতিগত সংস্কার বেসরকারি অংশগ্রহণের পথ খুলেছে, পূর্ণ সম্ভাবনা সফল করতে চাই টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা, সরলীকৃত প্রক্রিয়া ও গভীর শিল্প-সরকার সহযোগিতা।

সময়মতো প্রকল্পবাস্তবায়ন একটি পূর্বানুমেয় চাহিদা-পাইপলাইন তৈরি করবে, যাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতায় বিনিয়োগ করতে পারে। এতে খরচ-বৃদ্ধি কমার পাশাপাশি বৈশ্বিক সরবরাহ দক্ষতা-সম্পন্ন দেশীয় প্ল্যাটফর্ম সমন্বয়কারীর উত্থান ঘটবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিরক্ষা প্রকল্প দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য বাস্তবায়িত হলে ভারতের অপারেশনাল প্রস্তুতি ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা বাড়বে, যা সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করবে।

কর-ছাড় ও যৌথ গবেষণা উদ্যোগের মতো পদক্ষেপ নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহ দিলে ভারত প্রযুক্তি আমদানিকারক থেকে বৈশ্বিক উদ্ভাবকেে পরিণত হতে পারে। এতে স্বত্বাধিকারী মেধাস্বত্ত্ব তৈরি হবে, বৈশ্বিক ক্রেতা আকৃষ্ট হবে এবং কৌশলগত নির্ভরতা কমবে।

ক্রয়-প্রক্রিয়া সরলীকরণ ও ‘সিঙ্গেল উইন্ডো’ ছাড়পত্র ব্যবস্থা চালু করলে প্রবেশ-বাধা কমবে এবং আরও বিস্তৃত পরিসরের প্রতিষ্ঠান প্রতিরক্ষা উৎপাদনে আসতে আগ্রহী হবে। ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো সিস্টেম ব্যবসা-সূচকে জটিলতা কমালেও প্রতিরক্ষা-কেন্দ্রিক একটি আলাদা ছাড়পত্র ব্যবস্থার দরকার, যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসমূহ একত্রে থাকবে। এর ফলে প্রতিযোগিতা বাড়বে, কার্যকারিতা উন্নত হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ উপ-খাতে মান বৃদ্ধি পাবে।

প্রতিরক্ষা নির্মাণে বেসরকারি অংশগ্রহণ বাড়লে শিল্প-বাস্তবভিত্তির জুড়িদিকেও শক্তিশালী প্রভাব পড়বে। হাইটেক প্রতিরক্ষা প্ল্যাটফর্ম উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধাতুবিদ্যা, কম্পোজিট উপাদান, নিখুঁত যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক্স, সেমি-কন্ডাক্টর, সাইবার সুরক্ষা ও উন্নত উৎপাদনশিল্পে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে ভারতের শিল্পায়নের আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত হবে এবং নির্মাণ-ভিত্তির টেকসই সক্ষমতাও বাড়বে।

ভারত এখন প্রতিরক্ষা সংস্কারকে সামগ্রিক শিল্পীয় পুনরুত্থান ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের ইঞ্জিনে পরিণত করার দ্বারপ্রান্তে। যদি ভারতকে সত্যিকারের ‘উৎপাদনশক্তি’তে উঠতে হয়, প্রতিরক্ষা খাতই হবে প্রথম সীমান্ত। ইন্টারনেট, জিপিএস, ক্যানজাত খাবার, কম্পিউটার এবং ডিজিটাল ক্যামেরা—এসবই একসময় সামরিক উদ্ভাবন ছিল, যা পরে সাধারণ জীবনে প্রবেশ করেছে।

প্রতিযোগিতামূলক বিড, সহ-উন্নয়ন মডেল এবং বৃহত্তর স্বচ্ছতার দিকে এই স্খডবদল ভারতের প্রতিরক্ষা নির্মাণে নতুন যুগ সূচিত করছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে ভারত জাতীয় ‘চ্যাম্পিয়ন’ গড়ে তুলতে পারবে, যারা বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খল গঠনে বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে সমকক্ষ হবে। এই নীতি-পরিবর্তন ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও কৌশলগত উদ্ভাবনে একটি শক্তিশালী শক্তি হয়ে উঠতে পারে।

লেখক: অমিতাভ কান্ত ভারতের জি-২০ শেরপা এবং নীতি আয়োগের সাবেক সিইও।