০২:৩৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত নারীদের এক গোপন স্কোয়াড্রনের বীরত্বগাথা

কাঠের বিমানে মৃত্যুঝুঁকির মিশনে

বিমান ছিল কাঠের তৈরি। হাতে ছিল না কোনো গান, রেডিও কিংবা প্যারাশুট। তারপরও রাতের গভীরে নাৎসি বাহিনীর ঘাঁটিতে বোমা ফেলে ফিরে আসতেন সোভিয়েত নারীদের একদল সাহসিনী যোদ্ধা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই নারী স্কোয়াড্রন পরিচিত হয়ে ওঠে ‘নাইট উইচেস’ নামে।

জার্মান সেনারা তাদের ডাকত ডি নাখট হেক্সেন বা নাইট উইচেস। কারণ তারা মনে করত, এই নারীরা যেন কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী, যারা হঠাৎ আকাশ থেকে বোমা ফেলে মিলিয়ে যেত।

দ্রুত প্রশিক্ষণদ্রুত অভিযানে

১৯৪১ সালের অক্টোবরে সোভিয়েত খ্যাতিমান নারী পাইলট মারিনা রাসকোভার নির্দেশে গঠিত হয় এই স্কোয়াড্রন। তরুণ পাইলট পলিনা গেলমান ও গালিয়া ডকুটোভিচ ছিলেন প্রথম দিকের সদস্যদের মধ্যে। মাত্র তিন মাসের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণেই তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।

ডকুটোভিচ শুরুতে পাইলট হতে চাইলেও পরে নেভিগেটর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে রোমাঞ্চ খুঁজে পান। আকাশে উড়ে তিনি উপলব্ধি করেন, এই কাজও সমান গুরুত্বপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর।

কাঠের বিমানের সীমাবদ্ধতা বদলে দিল সুযোগে

পর্যাপ্ত যুদ্ধবিমান না থাকায় সোভিয়েত বাহিনী তাদের হাতে তুলে দেয় কীটনাশক ছিটানোর কাজে ব্যবহৃত পুরনো কাঠের পিও-২ বিমান।

তাদের সঙ্গে ছিল না কোনো অস্ত্র বা প্যারাশুট। ফলে বিমানে যতটা সম্ভব বোমা বহন করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। তবে কাঠের এই বিমানের শব্দ খুবই কম ছিল, যা শত্রুর রাডারে ধরা পড়ত না। এভাবেই তারা রাতের অন্ধকারে জার্মান ঘাঁটির ওপর পৌঁছে ইঞ্জিন বন্ধ করে গ্লাইড করে নীরবে বোমা ফেলত।

প্রতি চার মিনিট পরপর একেকটি বিমান উড়ত, লক্ষ্যে বোমা ফেলত এবং ফিরে আসত। একটানা চলত এ মরণপণ অভিযান।

ভয়াবহ রাতের ভয়ংকর ইতিহাস

১৯৪৩ সালে স্কোয়াড্রনটি রূপ নেয় ‘৪৬তম গার্ডস নাইট বোম্বার এভিয়েশন রেজিমেন্ট’-এ। কিন্তু ওই বছরের জুলাই মাসে জার্মান বাহিনী কৌশল পাল্টায়। তারা আকাশে রাতের যুদ্ধের ফাঁদ পাতে। এই অভিযানে গালিয়া ডকুটোভিচসহ সাতজন পাইলট নিহত হন। ইতিহাসবিদ লিউবা ভিনোগ্রাদোভা এই রাতকে স্কোয়াড্রনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় রাত বলে অভিহিত করেন।

কিন্তু ভয়াবহ এই মৃত্যুও তাদের থামিয়ে রাখতে পারেনি। ১৯৪৫ সালের মে মাসে মিত্রবাহিনীর বিজয় আসা পর্যন্ত তারা নিয়মিত লড়াই চালিয়ে গেছে।

নারীর ইচ্ছাশক্তির অনন্য নজির

যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে স্কোয়াড্রনটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়। সেটিই ছিল রেড আর্মির ইতিহাসে একমাত্র সম্পূর্ণ নারী ইউনিট।

গেলমান পরে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ ফরেন ল্যাংগুয়েজেসে পড়াশোনা করেন। প্রয়াত সহযোদ্ধা গালিয়ার স্মরণে নিজের মেয়ের নামও রাখেন গালিয়া।

২০০৫ সালে মৃত্যুর আগে গেলমান বলেন, “আমরা কেউ বাধ্য হয়ে আসিনি। স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আর যা হৃদয়ের ডাকে করা হয়, তা সবসময়ই বাধ্যবাধকতার কাজের তুলনায় শ্রেষ্ঠ হয়।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত নারীদের এক গোপন স্কোয়াড্রনের বীরত্বগাথা

১২:৩০:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

কাঠের বিমানে মৃত্যুঝুঁকির মিশনে

বিমান ছিল কাঠের তৈরি। হাতে ছিল না কোনো গান, রেডিও কিংবা প্যারাশুট। তারপরও রাতের গভীরে নাৎসি বাহিনীর ঘাঁটিতে বোমা ফেলে ফিরে আসতেন সোভিয়েত নারীদের একদল সাহসিনী যোদ্ধা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই নারী স্কোয়াড্রন পরিচিত হয়ে ওঠে ‘নাইট উইচেস’ নামে।

জার্মান সেনারা তাদের ডাকত ডি নাখট হেক্সেন বা নাইট উইচেস। কারণ তারা মনে করত, এই নারীরা যেন কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী, যারা হঠাৎ আকাশ থেকে বোমা ফেলে মিলিয়ে যেত।

দ্রুত প্রশিক্ষণদ্রুত অভিযানে

১৯৪১ সালের অক্টোবরে সোভিয়েত খ্যাতিমান নারী পাইলট মারিনা রাসকোভার নির্দেশে গঠিত হয় এই স্কোয়াড্রন। তরুণ পাইলট পলিনা গেলমান ও গালিয়া ডকুটোভিচ ছিলেন প্রথম দিকের সদস্যদের মধ্যে। মাত্র তিন মাসের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণেই তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।

ডকুটোভিচ শুরুতে পাইলট হতে চাইলেও পরে নেভিগেটর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে রোমাঞ্চ খুঁজে পান। আকাশে উড়ে তিনি উপলব্ধি করেন, এই কাজও সমান গুরুত্বপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর।

কাঠের বিমানের সীমাবদ্ধতা বদলে দিল সুযোগে

পর্যাপ্ত যুদ্ধবিমান না থাকায় সোভিয়েত বাহিনী তাদের হাতে তুলে দেয় কীটনাশক ছিটানোর কাজে ব্যবহৃত পুরনো কাঠের পিও-২ বিমান।

তাদের সঙ্গে ছিল না কোনো অস্ত্র বা প্যারাশুট। ফলে বিমানে যতটা সম্ভব বোমা বহন করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। তবে কাঠের এই বিমানের শব্দ খুবই কম ছিল, যা শত্রুর রাডারে ধরা পড়ত না। এভাবেই তারা রাতের অন্ধকারে জার্মান ঘাঁটির ওপর পৌঁছে ইঞ্জিন বন্ধ করে গ্লাইড করে নীরবে বোমা ফেলত।

প্রতি চার মিনিট পরপর একেকটি বিমান উড়ত, লক্ষ্যে বোমা ফেলত এবং ফিরে আসত। একটানা চলত এ মরণপণ অভিযান।

ভয়াবহ রাতের ভয়ংকর ইতিহাস

১৯৪৩ সালে স্কোয়াড্রনটি রূপ নেয় ‘৪৬তম গার্ডস নাইট বোম্বার এভিয়েশন রেজিমেন্ট’-এ। কিন্তু ওই বছরের জুলাই মাসে জার্মান বাহিনী কৌশল পাল্টায়। তারা আকাশে রাতের যুদ্ধের ফাঁদ পাতে। এই অভিযানে গালিয়া ডকুটোভিচসহ সাতজন পাইলট নিহত হন। ইতিহাসবিদ লিউবা ভিনোগ্রাদোভা এই রাতকে স্কোয়াড্রনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় রাত বলে অভিহিত করেন।

কিন্তু ভয়াবহ এই মৃত্যুও তাদের থামিয়ে রাখতে পারেনি। ১৯৪৫ সালের মে মাসে মিত্রবাহিনীর বিজয় আসা পর্যন্ত তারা নিয়মিত লড়াই চালিয়ে গেছে।

নারীর ইচ্ছাশক্তির অনন্য নজির

যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে স্কোয়াড্রনটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়। সেটিই ছিল রেড আর্মির ইতিহাসে একমাত্র সম্পূর্ণ নারী ইউনিট।

গেলমান পরে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ ফরেন ল্যাংগুয়েজেসে পড়াশোনা করেন। প্রয়াত সহযোদ্ধা গালিয়ার স্মরণে নিজের মেয়ের নামও রাখেন গালিয়া।

২০০৫ সালে মৃত্যুর আগে গেলমান বলেন, “আমরা কেউ বাধ্য হয়ে আসিনি। স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আর যা হৃদয়ের ডাকে করা হয়, তা সবসময়ই বাধ্যবাধকতার কাজের তুলনায় শ্রেষ্ঠ হয়।”