ভূমিকা
জাতীয় নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে জ্বালানি নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত যেসব দেশ দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ–ঘাটতির সঙ্গে লড়ছে। এমন সংকটে থাকা ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান বিগত দুই দশকে পাশের দেশের হাইড্রোকার্বন সম্পদ, বিশেষত প্রাকৃতিক গ্যাস, ব্যবহার করার লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক ও প্রকৌশলগত প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দুটি বড় পাইপলাইন প্রকল্প সরবরাহ ও চাহিদার ব্যবধান ঘোচাতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে—ইরান–পাকিস্তান (আইপি) পাইপলাইন এবং তুর্কমেনিস্তান–আফগানিস্তান–পাকিস্তান–ভারত (ট্যাপি) পাইপলাইন। নিবন্ধটিতে জটিল কারিগরি ও ভূরাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহার করে দুটি প্রকল্পের সমালোচনামূলক তুলনা করা হয়েছে। এতে আইপি পাইপলাইনের বহুমাত্রিক আর্থিক, কারিগরি ও নিরাপত্তাগত সুবিধা—এবং ট্যাপির গাঠনিক চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি—বিশ্লেষণের মাধ্যমে আইপি-কে অগ্রাধিকার দেওয়ার কৌশলগত যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
পাকিস্তানের জ্বালানি প্রেক্ষাপট
পাকিস্তানের দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতি ও জনসংখ্যা দেশটির জ্বালানি চাহিদা এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যা বিদ্যমান অবকাঠামো ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ পূরণ করতে পারছে না। তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার ও সাশ্রয়ী প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্প, বিদ্যুৎ ও আবাসিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই আইপি ও ট্যাপির মতো আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইন কেবল গ্যাস পরিবহনের কারিগরি সমাধান নয়; এগুলো জ্বালানি করিডর হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশ ও গোটা অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। এসব দিক বিশ্লেষণে প্রয়োজন সূক্ষ্ম কারিগরি ভাঙচুর, ঝুঁকি–মূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল বাস্তুচিত্র অনুসন্ধান।
ট্যাপি পাইপলাইন: বহুপাক্ষিক জটিলতা ও স্থায়ী ঝুঁকি
ট্যাপি প্রকল্পের লক্ষ্য তুর্কমেনিস্তানের দাউলাতাবাদ গ্যাসক্ষেত্র থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হয়ে ভারতে গ্যাস পাঠানো। সোজা পথে দক্ষিণ এশীয় ভোক্তাদের জন্য তুর্কমেন গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও প্রকল্পটি চারটি সার্বভৌম দেশের সম্মিলিত অংশগ্রহণের কারণেই নানা কাঠামোগত বাধা ও অনিশ্চয়তার মুখে।
১. চার দেশের ঐকমত্যের ওপর নির্ভরতা: নীতি নির্ধারণ, অর্থায়ন, প্রকৌশল, নির্মাণ ও পরিচালনা—সবকিছুতেই চার দেশের নিয়মিত সমন্বয় ও স্বার্থের মিল দরকার। অংশীদার দেশগুলোর রাজনৈতিক রদবদল, দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা (যেমন পাকিস্তান–ভারত সম্পর্ক) কিংবা অগ্রাধিকার বদল প্রকল্পকে বড় দেরি বা স্থবিরতার মুখে ফেলতে পারে।
২. আফগানিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা ঝুঁকি: ট্যাপির প্রধান অংশ আফগান অঞ্চলের ওপর দিয়ে যাবে; দেশটি বহু দশক ধরে স্থিতিশীল নয়। অসংখ্য সশস্ত্র গোষ্ঠী, কেন্দ্রীভূত শক্তিশালী সরকারের অনুপস্থিতি ও ক্রিটিক্যাল অবকাঠামোর নিরাপত্তাহীনতা প্রকল্পকে অপারেশনাল ঝুঁকিতে ফেলে। বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এত বড় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা প্রকল্পে অর্থ দিতে অনাগ্রহী। হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনকে যুদ্ধকালীন নাশকতা ও অপ্রতিসম হুমকি থেকে রক্ষা করতে বিপুল অর্থ ও সমন্বিত নিরাপত্তা দরকার, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্লভ।
আইপি পাইপলাইন: দ্বিপাক্ষিক সরলতা ও স্থিতিশীল সম্পদে প্রবেশাধিকার
ট্যাপির জটিলতার বিপরীতে আসা–পাশের দেশ ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক আইপি পাইপলাইন স্পষ্ট কিছু কৌশলগত ও অপারেশনাল সুবিধা দেয়।
১. ইরানের বিপুল গ্যাস মজুত ও স্বল্প দূরত্ব: বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রমাণিত গ্যাস মজুতের দেশ ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকায় তৃতীয় দেশের ওপর নির্ভরতা কমে, ফলে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকিও হ্রাস পায়। ইরানের সুগঠিত জাতীয় গ্যাস নেটওয়ার্ক পাকিস্তানের চাহিদা মেটাতে স্থিতিশীল সরবরাহ দিতে পারে।
২. আঞ্চলিক উৎস বৈচিত্র্যের সম্ভাবনা: আইপি পাইপলাইন ভবিষ্যতে কাতারের সঙ্গে ভাগ করা সাউথ পার্স, আজারবাইজান কিংবা এমনকি তুর্কমেনিস্তানের গ্যাসও ইরানি ভূখণ্ডে এনে পাকিস্তানে স্থানান্তরের সুযোগ দিতে পারে। এতে আলাদা ঝুঁকিপূর্ণ করিডর ছাড়াই সরবরাহ–নিরাপত্তা বাড়ে।
৩. ইরান–পাকিস্তান ঐতিহাসিক সম্পর্ক: স্বাধীনতার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মানবিক যোগাযোগের সেতুবন্ধ রয়েছে। বড় অবকাঠামো প্রকল্পে দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতার নজির নেই, যা ট্যাপির তুলনায় রাজনৈতিক ঝুঁকি কমায়।
৪. দ্রুত সম্পাদনের সম্ভাবনা: ইরান দিকের বেশির ভাগ পাইপলাইন ইতিমধ্যে নির্মিত, পাকিস্তান অংশই বাকি। অন্যদিকে ট্যাপিকে চার দেশের ভেতর প্রায় পুরো পাইপলাইন বসাতে হবে, বিশেষত আফগানিস্তানে—যা সময়সাপেক্ষ। আইপি দ্রুত চালু হলে পাকিস্তানের গ্যাস ঘাটতি দ্রুত কমবে ও অর্থনৈতিক সুফলও তাড়াতাড়ি আসবে।
কেস স্টাডি: তুরস্কের ইরানি গ্যাস ব্যবহার
তাহরিজ–আঙ্কারা পাইপলাইনের মাধ্যমে তুরস্ক দুই দশকের বেশি সময় ধরে ইরান থেকে গ্যাস নিচ্ছে। পারস্পরিক রাজনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি অটুট আছে এবং বারবার নবায়ন হয়েছে। এ নির্ভরযোগ্য গ্যাস সরবরাহ তুরস্কের শিল্প ও বিদ্যুৎখাতের বিকাশে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে বিপুল রিজার্ভ পাওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান যেখানেই টেকসই সমাধান নিতে পারছে না, তুরস্ক সেখানে সফল উদাহরণ স্থাপন করেছে; পাকিস্তানের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় শিল্পোৎপাদন কমেছে, ব্যয়বহুল জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
উপসংহার ও নীতিগত সুপারিশ
টেকনিক্যাল, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে তুলনা করে দেখা যায়—আইপি পাইপলাইনের কৌশলগত ও অপারেশনাল সুবিধা ট্যাপির তুলনায় স্পষ্টভাবে বেশি। ট্যাপির বহুপাক্ষিক গাঠনিক জটিলতা, বিশেষ করে আফগানিস্তানের স্থায়ী নিরাপত্তা ঝুঁকি ও অর্থায়নের অনিশ্চয়তা, এর বাস্তবায়ন সম্ভাবনাকে গুরুতরভাবে খর্ব করে। বিপরীতে, আইপি’র দ্বিপাক্ষিক সরলতা, বিশাল রিজার্ভে সরাসরি প্রবেশাধিকার, বহুমুখী ট্রানজিটের সুবিধা, স্বল্প সম্পাদন সময়সূচি ও ইতিবাচক ইতিহাস এটিকে স্থিতিশীল সমাধান করে তুলেছে। তুরস্কের দুই দশকের সাফল্য ইরানি গ্যাসের নির্ভরযোগ্যতা ও অর্থনৈতিক সুফলের অকাট্য প্রমাণ।
অতএব, পাকিস্তানের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাস্তবভিত্তিক কৌশল অনুসারে আইপি পাইপলাইনের নির্মাণ ও চালু করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষণস্থায়ী ভূরাজনৈতিক বিবেচনা বা বহিঃচাপ নয়, বরং অপারেশনাল ঝুঁকি, অর্থনৈতিক সম্ভবনা ও জাতীয় স্বার্থই মূল হওয়া উচিত। আইপি সম্পন্ন হলে কেবল গ্যাস ঘাটতি মিটবে না; পাকিস্তান আঞ্চলিক জ্বালানি করিডর হিসেবে শক্ত অবস্থানও তৈরি করবে এবং জ্বালানি উৎস বৈচিত্র্য বাড়াবে। বর্তমান বাস্তবতায় আইপি আর কেবল সম্ভাবনা নয়—পাকিস্তানের জন্য এটি একটি কৌশলগত অপরিহার্যতা।
লেখক: একজন থিঙ্কট্যাঙ্ক, পাকিস্তানের একটি পত্রিকার সম্পাদক