ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বহুদিনের বৈরিতা ২০২৫ সালের শুরুতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্য অস্থিরতা ডেকে আনছে। ২০২৪ সালের শেষদিকে তেহরানে একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের (IRGC) শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হন, যা ইরান সরাসরি ইসরায়েলের ওপর দায় চাপায়। উত্তরে ইরান একযোগে সিরিয়া, ইরাক ও লেবানন থেকে ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলি সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামোতে হামলা চালায়। ইসরায়েলও পাল্টা জবাব দেয়, এতে যুদ্ধের সরাসরি আশঙ্কা দ্রুত বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। এই অবস্থা একটি বড় প্রশ্ন সামনে এনেছে—মধ্যপ্রাচ্য কি আরেকটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে?
এই সংঘাতের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ধর্মীয় শত্রুতা এবং আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই। ইরান নিজেকে ইসলামী প্রতিরোধের প্রধান শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে এবং হিজবুল্লাহ, হুথি, পিএমইউসহ একাধিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে ইসরায়েল ও পশ্চিমা স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ জানিয়া এসেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল মনে করে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি, এবং সেই হুমকি প্রতিরোধে যেকোনো ধরণের হামলা বৈধ। এই দ্বন্দ্ব সরাসরি যুদ্ধের বদলে একধরনের ছায়াযুদ্ধ হিসেবে চলেছে বহু বছর ধরে, যেখানে ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে, ইরান ইসরায়েলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে প্রক্সি বাহিনী দিয়ে চাপ প্রয়োগ করেছে, এমনকি পরস্পরের অভ্যন্তরে সাইবার আক্রমণ ও গুপ্তচর হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক হামলাগুলো এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে আর কেবল প্রভাব বিস্তারের লড়াই চলছে না, বরং প্রতিপক্ষকে সামরিকভাবে বিপর্যস্ত করার লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। ইরানের তরফ থেকে একযোগে ছোড়া শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। যদিও ‘আয়রন ডোম’ ও ‘অ্যারো সিস্টেম’ বেশ কিছু হামলা ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে, তবে কিছু হামলা লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছেছে, যা ইসরায়েলের জন্য এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা। একইসাথে, ইরানের হুমকি—যদি ইসরায়েল ফের হামলা চালায়, তবে তেলআবিব ও হাইফাকে নিশানা করা হবে—এই ঘোষণা শুধু প্রতিশোধ নয়, তা যুদ্ধের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য যে, এই সংঘাত এখনো এককভাবে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন—সবকটি দেশই কোনো না কোনোভাবে এই উত্তেজনার অংশ হয়ে উঠছে। হিজবুল্লাহ ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে, ইসরায়েলও পাল্টা লেবাননে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা রেড সি’তে ইসরায়েলমুখী জাহাজে হামলা অব্যাহত রেখেছে। ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিগুলোও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সম্ভাব্য ক্ষেত্র ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে, এখন দরকার কেবল একটি বড় ধরনের উসকানি, যা যুদ্ধকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেবে।
তবে দুই পক্ষই জানে, সরাসরি যুদ্ধ তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব ও স্থিতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইরানের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অসন্তোষ যেকোনো বড় ধরনের যুদ্ধ পরিচালনাকে কঠিন করে তুলবে। একইভাবে ইসরায়েলও বর্তমানে গাজা যুদ্ধ, পশ্চিম তীরে দমননীতি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখোমুখি, ফলে একসাথে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ চালানো তার পক্ষেও জটিল। ফলে এখন পর্যন্ত দুই পক্ষই সীমিত ও লক্ষ্যনির্ভর আক্রমণে সীমাবদ্ধ থেকেছে, যদিও উত্তেজনার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
তবে যদি পরিস্থিতি সত্যিই পূর্ণমাত্রিক যুদ্ধের দিকে যায়, তাহলে এর প্রভাব শুধু তেহরান কিংবা তেলআবিবে সীমিত থাকবে না। প্রথমত, হরমুজ প্রণালীতে যদি ইরান সাময়িক অবরোধ সৃষ্টি করে বা ট্যাংকারে হামলা করে, তাহলে বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। এমনিতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে জ্বালানির বাজার অস্থিতিশীল, সেখানে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বিশ্ববাজারে নতুন এক জ্বালানি সংকটের জন্ম দিতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ইত্যাদিও এই পরিস্থিতির চাপ অনুভব করবে। অনেক ক্ষেত্রে এই দেশগুলো সরাসরি যুক্ত না থাকলেও রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র এই পুরো সংঘাতে একটি জটিল অবস্থানে আছে। একদিকে সে ইসরায়েলের প্রধান মিত্র, নিরাপত্তা ও অস্ত্র সহায়তাকারী; অন্যদিকে ইরানকে ঠেকাতে গিয়ে ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে তার বেশ কিছু ঘাঁটি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে একাধিকবার হামলা হয়েছে, সিরিয়ায় তার সৈন্যরা আহত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দুটি পথ খোলা—এক, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়া; দুই, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করা। এখন পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসন দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছে, যদিও সামরিক প্রস্তুতি ও নৌবাহিনীর মোতায়েন পরিস্থিতির গুরুত্বই নির্দেশ করে।
মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো। সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে চীন-মধ্যস্থতায় একটি সাম্প্রতিক শান্তি চুক্তিতে পৌঁছেছে, ফলে সে এখনো ইসরায়েলের পাশে স্পষ্টভাবে দাঁড়াতে পারছে না। একইভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা বাহরাইনও তাদের জনমতের কারণে দ্বিধায় আছে। তুরস্ক প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করলেও কূটনৈতিকভাবে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে না। পাকিস্তান বরাবরের মতোই ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান বজায় রেখেছে, তবে সামরিক জোটে অংশ নেওয়ার মত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি তার নেই। ফলে মুসলিম বিশ্বে একধরনের মৌন দ্বিধা বিরাজ করছে—ইসরায়েলবিরোধিতা স্পষ্ট, কিন্তু ইরানের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন দিতেও সবাই রাজি নয়।
এই যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি একটি ধর্মীয় রূপও নিচ্ছে। ইসরায়েল ও ইরান উভয়ই একে ধর্মীয় কর্তব্যের রূপ দিচ্ছে। ইরান বলছে, জেরুজালেমকে মুক্ত করতে হবে; আর ইসরায়েল বলছে, পারস্যের “মৃত্যুর সংস্কৃতি” থামাতে হবে। এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ সাধারণ জনতার মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করছে, যা শুধু রাজনৈতিক নেতা বা সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত নয়, জনমতের চাপকেও যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
অর্থনৈতিকভাবে এই যুদ্ধ গোটা বিশ্বের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। মধ্যপ্রাচ্য এমনিতেই একটি জ্বালানিনির্ভর অঞ্চল, এখানকার কোনো উত্তেজনা বিশ্ব অর্থনীতিকে একধাক্কায় পিছিয়ে দিতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলো—বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেমন বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান—তেল-গ্যাসের দামে হঠাৎ বৃদ্ধিতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক চাপে পড়বে। পাশাপাশি এই অঞ্চলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী আয় কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটও দেখা দেবে।
সবশেষে বলা যায়, ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ এখন আর একটি সীমিত বিবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি বড় একটি আঞ্চলিক সংঘাতের সম্ভাব্য সূচনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে সামনের দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য আরও অস্থির, রক্তাক্ত ও অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। এখন সময়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর মধ্যস্থতা করুক। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়—তা কেবল ধ্বংসের নতুন এক চক্রের জন্ম দেয়। এই সত্য যত দ্রুত দুই পক্ষ বুঝবে, ততই বিশ্ব একটু শান্তির নিশ্বাস নিতে পারবে।