০১:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

সিন্দুর-পরবর্তী সময়ে বেলুচিস্তানের আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে ভারত

সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত সিন্দুর অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন। দুই দেশের ঐতিহ্যগত বৈরিতার প্রেক্ষাপটে এই বিরতিটিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পেছনে সমর্থন জোগাতে ভারতের উদ্যোগএমন আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সেক্ষেত্রে ভারত কোনো প্রক্সি গোষ্ঠী ব্যবহার করতে পারেকী ধরনের সহায়তা দিতে পারেতা নিয়ে সমন্বিত হুমকি-মূল্যায়ন জরুরি। এর ভিত্তিতে পাকিস্তানে ভারত-সমর্থিত সন্ত্রাস প্রতিরোধে একটি জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করা দরকার।

বর্তমানে পাকিস্তানকে নিশানা করা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো দুটি বৃহৎ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়উপজাতীয় (সাব-ন্যাশনালিস্ট) ও ধর্মীয় প্রেরণায় পরিচালিত গোষ্ঠী। উভয় শ্রেণিই স্থানীয় বঞ্চনার প্রসঙ্গ ব্যবহার করে নিজেদের বর্ণনাকে জোরদার করেতবে ভারতের মতো পাকিস্তানবিরোধী রাষ্ট্রের সহায়তা তাদের সক্রিয়তায় বড় ভূমিকা রাখে।

ঐতিহাসিকভাবে বেলুচ সাব-ন্যাশনালিস্টদেরবিশেষত বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) ও বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ)নিয়মিতভাবে ভারত সমর্থন দিয়ে আসছে। সিন্দুর-পরবর্তী সময়ে দুই গোষ্ঠীর প্রকাশ্য অবস্থানেই এই যোগসূত্রের ইঙ্গিত মিলেছে। ১১ মে ২০২৫-এ বিএলএর মুখপাত্র জিয়ান্ড বেলুচ এক সামাজিক-মাধ্যম বার্তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যেকোনো সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থনের অঙ্গীকার জানিয়েছেন।

বিএলএফ প্রধান ড. আল্লা নজর বেলুচও এক ভিডিও বার্তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতআফগানিস্তান ও ইরানের সক্রিয় সহায়তা প্রার্থনা করেন। তবে ২০১৭-তে ইরানের চাবাহার থেকে ধরা পড়া গোপন RAW কর্মকর্তা কুলভূষণ যাদবের জবানবন্দি থেকে জানা যায়ভারত তিন খাতে এই গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করেছিল: বিপুল অর্থঅস্ত্র সরবরাহ এবং বেলুচিস্তানে লোকজন ও সামগ্রী যাতায়াতের সুবিধা। তিনি জানানদিল্লি ও মুম্বাই থেকে দুবাই হয়ে হাওয়ালা-হুন্ডি মাধ্যমে টাকা পাঠানো হতোআর ইরানের জাহেদানে অবস্থিত ভারতীয় কনসুলেট দিয়ে নগদ অর্থলোকজন ও অস্ত্র পাচার করানো হতো।

শুধু সাব-ন্যাশনালিস্টই নয়ধর্মীয় প্রেরণায় চালিত গোষ্ঠীবিশেষত আফগানিস্তানভিত্তিক তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)এর সঙ্গেও আফগান ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্কের প্রমাণ আছে। ৮ মে টিটিপির টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তারা সিন্দুর অভিযানে ভারতীয় হামলায় বেসামরিক হতাহতের প্রতি শোক’ জানিয়ে পাকিস্তান সেনাকে অভিযুক্ত করেদাবি করে পাক সেনাই এসব লক্ষ্যবস্তু শনাক্তে ভারতকে তথ্য দিয়েছে। ২০১৪-তে মার্কিন বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে পরে পাকিস্তানে হস্তান্তরিত টিটিপি কমান্ডার লতিফ মেহসুদও স্বীকার করেছিলেন যে আফগান শহরগুলোর ভারতীয় কনসুলেটগুলো থেকে টিটিপিকে অর্থঅস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

এই প্রেক্ষাপটে টিটিপিকমপক্ষে তাদের কিছু অংশপাকিস্তানে সন্ত্রাস বাড়াতে ভারতের পরিকল্পনায় সঙ্গী হতে পারে। আফগান তালিবান নেতা হিবাতুল্লাহ সম্প্রতি আফগানভূমি ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা না চালাতে টিটিপিকে নির্দেশ দেওয়ায় ভারত-অনুগত উপাদানগুলোর আশ্রয় ভারতের দিকেই ঝুঁকতে পারে।

ভারত-সমর্থিত প্রক্সি সন্ত্রাস মোকাবিলায় পাকিস্তানের তিন-স্তরীয় কৌশল প্রয়োজন।

প্রথমতসন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর অর্থের জোগান বন্ধ করতে হবে। হাওয়ালানগদ বহনকারীক্রিপ্টোকারেন্সি ও আর্থিক ব্যবস্থার ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে এই অর্থ আসে। সন্ত্রাসী অর্থায়ন ভেঙে ফেলা যেকোনো পাল্টা-কৌশলের কেন্দ্রে থাকা উচিত। যদিও পাকিস্তান সন্ত্রাসী অর্থায়ন ঠেকাতে অগ্রগতি করেছেসাম্প্রতিক সন্ত্রাসের ঊর্ধ্বগতি বড় ফাঁক থাকার ইঙ্গিত দেয়। সদ্য গঠিত জাতীয় মানি-লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন দমন কর্তৃপক্ষকে (এএমএল/সিএফটি) দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা বিবেচনায় রেখে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আনতে হবে।

দ্বিতীয়তআফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গে ছিদ্রপূর্ণ সীমান্ত দিয়ে নগদঅস্ত্রলোকজন ও সামগ্রী পাচার রোধ জরুরি। ইউক্রেনের প্রক্সি শক্তির ট্রাকে লুকিয়ে রাশিয়ায় ড্রোন পাঠিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক উদাহরণ সীমান্ত নজরদারির গুরুত্ব স্পষ্ট করে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা ছাড়া উপায় নেই।

তৃতীয়তবেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় স্থানীয় বঞ্চনা দূর করতে হবেযাতে সন্ত্রাসীরা জনসমর্থন না পায় এবং বিদেশি শক্তি প্রচারণার ইন্ধন জুটিয়ে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ না করতে পারে।

আঞ্চলিক শান্তির স্বার্থে আশা করা যায়সিন্দুর অভিযানের এই বিরতি সত্যিকারের যুদ্ধবিরতিতে রূপ নেবেগোপন তৎপরতায় নয়। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সতর্কতা কমানো চলবে নাভারত-সমর্থিত সন্ত্রাসের উত্থান ঠেকাতে প্রস্তুত থাকতে হবে। অসতর্কতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর ঝুঁকি ডেকে আনবে।

লেখক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং ন্যাকটার (জাতীয় সন্ত্রাসবাদ দমন কর্তৃপক্ষ) প্রথম জাতীয় সমন্বয়ক।

প্রকাশিত: ডন১৪ জুন ২০২৫

সিন্দুর-পরবর্তী সময়ে বেলুচিস্তানের আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে ভারত

০৬:২০:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫

সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত সিন্দুর অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন। দুই দেশের ঐতিহ্যগত বৈরিতার প্রেক্ষাপটে এই বিরতিটিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পেছনে সমর্থন জোগাতে ভারতের উদ্যোগএমন আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সেক্ষেত্রে ভারত কোনো প্রক্সি গোষ্ঠী ব্যবহার করতে পারেকী ধরনের সহায়তা দিতে পারেতা নিয়ে সমন্বিত হুমকি-মূল্যায়ন জরুরি। এর ভিত্তিতে পাকিস্তানে ভারত-সমর্থিত সন্ত্রাস প্রতিরোধে একটি জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করা দরকার।

বর্তমানে পাকিস্তানকে নিশানা করা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো দুটি বৃহৎ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়উপজাতীয় (সাব-ন্যাশনালিস্ট) ও ধর্মীয় প্রেরণায় পরিচালিত গোষ্ঠী। উভয় শ্রেণিই স্থানীয় বঞ্চনার প্রসঙ্গ ব্যবহার করে নিজেদের বর্ণনাকে জোরদার করেতবে ভারতের মতো পাকিস্তানবিরোধী রাষ্ট্রের সহায়তা তাদের সক্রিয়তায় বড় ভূমিকা রাখে।

ঐতিহাসিকভাবে বেলুচ সাব-ন্যাশনালিস্টদেরবিশেষত বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) ও বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ)নিয়মিতভাবে ভারত সমর্থন দিয়ে আসছে। সিন্দুর-পরবর্তী সময়ে দুই গোষ্ঠীর প্রকাশ্য অবস্থানেই এই যোগসূত্রের ইঙ্গিত মিলেছে। ১১ মে ২০২৫-এ বিএলএর মুখপাত্র জিয়ান্ড বেলুচ এক সামাজিক-মাধ্যম বার্তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যেকোনো সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থনের অঙ্গীকার জানিয়েছেন।

বিএলএফ প্রধান ড. আল্লা নজর বেলুচও এক ভিডিও বার্তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতআফগানিস্তান ও ইরানের সক্রিয় সহায়তা প্রার্থনা করেন। তবে ২০১৭-তে ইরানের চাবাহার থেকে ধরা পড়া গোপন RAW কর্মকর্তা কুলভূষণ যাদবের জবানবন্দি থেকে জানা যায়ভারত তিন খাতে এই গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করেছিল: বিপুল অর্থঅস্ত্র সরবরাহ এবং বেলুচিস্তানে লোকজন ও সামগ্রী যাতায়াতের সুবিধা। তিনি জানানদিল্লি ও মুম্বাই থেকে দুবাই হয়ে হাওয়ালা-হুন্ডি মাধ্যমে টাকা পাঠানো হতোআর ইরানের জাহেদানে অবস্থিত ভারতীয় কনসুলেট দিয়ে নগদ অর্থলোকজন ও অস্ত্র পাচার করানো হতো।

শুধু সাব-ন্যাশনালিস্টই নয়ধর্মীয় প্রেরণায় চালিত গোষ্ঠীবিশেষত আফগানিস্তানভিত্তিক তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)এর সঙ্গেও আফগান ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্কের প্রমাণ আছে। ৮ মে টিটিপির টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তারা সিন্দুর অভিযানে ভারতীয় হামলায় বেসামরিক হতাহতের প্রতি শোক’ জানিয়ে পাকিস্তান সেনাকে অভিযুক্ত করেদাবি করে পাক সেনাই এসব লক্ষ্যবস্তু শনাক্তে ভারতকে তথ্য দিয়েছে। ২০১৪-তে মার্কিন বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে পরে পাকিস্তানে হস্তান্তরিত টিটিপি কমান্ডার লতিফ মেহসুদও স্বীকার করেছিলেন যে আফগান শহরগুলোর ভারতীয় কনসুলেটগুলো থেকে টিটিপিকে অর্থঅস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

এই প্রেক্ষাপটে টিটিপিকমপক্ষে তাদের কিছু অংশপাকিস্তানে সন্ত্রাস বাড়াতে ভারতের পরিকল্পনায় সঙ্গী হতে পারে। আফগান তালিবান নেতা হিবাতুল্লাহ সম্প্রতি আফগানভূমি ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা না চালাতে টিটিপিকে নির্দেশ দেওয়ায় ভারত-অনুগত উপাদানগুলোর আশ্রয় ভারতের দিকেই ঝুঁকতে পারে।

ভারত-সমর্থিত প্রক্সি সন্ত্রাস মোকাবিলায় পাকিস্তানের তিন-স্তরীয় কৌশল প্রয়োজন।

প্রথমতসন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর অর্থের জোগান বন্ধ করতে হবে। হাওয়ালানগদ বহনকারীক্রিপ্টোকারেন্সি ও আর্থিক ব্যবস্থার ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে এই অর্থ আসে। সন্ত্রাসী অর্থায়ন ভেঙে ফেলা যেকোনো পাল্টা-কৌশলের কেন্দ্রে থাকা উচিত। যদিও পাকিস্তান সন্ত্রাসী অর্থায়ন ঠেকাতে অগ্রগতি করেছেসাম্প্রতিক সন্ত্রাসের ঊর্ধ্বগতি বড় ফাঁক থাকার ইঙ্গিত দেয়। সদ্য গঠিত জাতীয় মানি-লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন দমন কর্তৃপক্ষকে (এএমএল/সিএফটি) দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা বিবেচনায় রেখে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আনতে হবে।

দ্বিতীয়তআফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গে ছিদ্রপূর্ণ সীমান্ত দিয়ে নগদঅস্ত্রলোকজন ও সামগ্রী পাচার রোধ জরুরি। ইউক্রেনের প্রক্সি শক্তির ট্রাকে লুকিয়ে রাশিয়ায় ড্রোন পাঠিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক উদাহরণ সীমান্ত নজরদারির গুরুত্ব স্পষ্ট করে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা ছাড়া উপায় নেই।

তৃতীয়তবেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় স্থানীয় বঞ্চনা দূর করতে হবেযাতে সন্ত্রাসীরা জনসমর্থন না পায় এবং বিদেশি শক্তি প্রচারণার ইন্ধন জুটিয়ে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ না করতে পারে।

আঞ্চলিক শান্তির স্বার্থে আশা করা যায়সিন্দুর অভিযানের এই বিরতি সত্যিকারের যুদ্ধবিরতিতে রূপ নেবেগোপন তৎপরতায় নয়। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সতর্কতা কমানো চলবে নাভারত-সমর্থিত সন্ত্রাসের উত্থান ঠেকাতে প্রস্তুত থাকতে হবে। অসতর্কতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর ঝুঁকি ডেকে আনবে।

লেখক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং ন্যাকটার (জাতীয় সন্ত্রাসবাদ দমন কর্তৃপক্ষ) প্রথম জাতীয় সমন্বয়ক।

প্রকাশিত: ডন১৪ জুন ২০২৫