১২:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩২ তম কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল ২০২৪
  • 20
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

সুপ্রিয়া স্নান হেসে বলল, ‘মেয়েটার বুদ্ধি আছে তো!’

হেরম্ব অন্যমনস্ক ছিল। বলল, ‘কার বুদ্ধি আছে? খেপেছিস্। আমাদের ও বুদ্ধি করে একা রেখে যায়নি। কাজ করতে গিয়েছে। কাজ না থাকলে এখান থেকে ও নড়ত না, বসে বসে তোর সঙ্গে গল্প করত।’

সত্যি? তাহলে মেয়েটা খুব সরল। আমি বুঝাতে পারিনি।’

‘ ‘বুঝতে পারিসনি? তুই কি ওর সঙ্গে পাঁচ মিনিটও কথা বলিসনি, সুপ্রিয়া?’

সুপ্রিয়ার মুখ লাল হয়ে গেল। সে নীচু গলায় বলল, ‘তা বলেছি। আমারি বুদ্ধির দোষ। বুদ্ধি ঠিক থাকলে ওই মেয়েটা যে খুব সরল এটা বুঝতে পাঁচ মিনিট সময়ও লাগত না।’

সুপ্রিয়ার অপলক দৃষ্টিপাতে হেরম্ব একটু লজ্জা বোধ করল। সরলতার হিসাবে সুপ্রিয়াও যে কারো চেয়ে ছোট নয় এও তো সে জানে। সুপ্রিয়ার অভিজ্ঞতা বেশী, মানুষের মনের জটিল প্রক্রিয়া অনুধাবন করার শক্তি বেশী, সে তাই সাবধানে কথা বলে, হিসাব করে কাজ করে। কিন্তু তার কথা ও কাজে সরলতার অভাব কোনদিনই হেরম্বের কাছে ধরা পড়েনি, মিথ্যার মানস- স্বর্গ ওর নেই এও হয়তো সত্য যে, আনন্দের সহজাত সরলতার চেয়ে স্বপ্রিয়ার মনোভিজাত্যের সরলতার বেশী মূল্যবান। একটা ছেলেমানুষী, আর একটা সুশিক্ষা।

হেরম্ব সুর বদলাল।

‘ভাল করে বোস সুপ্রিয়া, তোর কষ্ট হচ্ছে।’

‘কষ্ট হওয়া মন্দ কি? তাতে মানুষের দরদ পাওয়া যায়। চোখে না দেখলে কেউ তো বোঝে না কারো কষ্ট আছে কি নেই।’

‘কারো কি নিজের কষ্টের কিছু অভাব আছে সুপ্রিয়া, যে পরের মধ্যে কষ্ট

খুঁজে বেড়াবে?’

‘সবাই তো সকলের পর নয়।’

হেরম্ব হেসে বলল, ‘নয়? তুই ছাই জানিস্। মোহ-মুদগর, বৈরাগ্যশতক, মহানির্বাণ-তন্ত্র সব লিখেছে-‘

সুপ্রিয়া অত্যন্ত মৃদুস্বরে বলল, ‘কাছে এসে বসুন না? দূরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে লাভ কি?’

‘কোথায় বসব দেখিয়ে দে।’

‘তাহলে থাকুন দাঁড়িয়ে।’

সুপ্রিয়া জানালার সঙ্কীর্ণ স্থানটিতে অত্যন্ত অসুবিধার মধ্যে বসে ছিল; সেখানে তার কাছে বসা অসম্ভব। হেরম্ব বিছানায় বসে তাকে ডাকল, ‘আয় সুপ্রিয়া এখানে বোস। এখুনি এলি, এসেই ঝগড়া জুড়ে দিলি কেন?’

উঠে এসে বিছানায় বসে স্বপ্রিয়া বলল ‘আপনিই বা শুধু হাঙ্কা কথা বলছেন কেন? পুরীতে কেন এলাম জিজ্ঞাসা করবেন কখন ?’

‘একেবারেই যদি জিজ্ঞাসা না করি?’

‘তাহলে একটু মুশকিলে পড়ব।’ সুপ্রিয়া এবার হাসল, ‘আপনি এ ঘরে থাকেন, না?’

‘হ্যাঁ, একা। আমি এ ঘরে একা থাকি স্বপ্রিয়া।

‘তা জানি না নাকি!’

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩২ তম কিস্তি )

১২:০০:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

সুপ্রিয়া স্নান হেসে বলল, ‘মেয়েটার বুদ্ধি আছে তো!’

হেরম্ব অন্যমনস্ক ছিল। বলল, ‘কার বুদ্ধি আছে? খেপেছিস্। আমাদের ও বুদ্ধি করে একা রেখে যায়নি। কাজ করতে গিয়েছে। কাজ না থাকলে এখান থেকে ও নড়ত না, বসে বসে তোর সঙ্গে গল্প করত।’

সত্যি? তাহলে মেয়েটা খুব সরল। আমি বুঝাতে পারিনি।’

‘ ‘বুঝতে পারিসনি? তুই কি ওর সঙ্গে পাঁচ মিনিটও কথা বলিসনি, সুপ্রিয়া?’

সুপ্রিয়ার মুখ লাল হয়ে গেল। সে নীচু গলায় বলল, ‘তা বলেছি। আমারি বুদ্ধির দোষ। বুদ্ধি ঠিক থাকলে ওই মেয়েটা যে খুব সরল এটা বুঝতে পাঁচ মিনিট সময়ও লাগত না।’

সুপ্রিয়ার অপলক দৃষ্টিপাতে হেরম্ব একটু লজ্জা বোধ করল। সরলতার হিসাবে সুপ্রিয়াও যে কারো চেয়ে ছোট নয় এও তো সে জানে। সুপ্রিয়ার অভিজ্ঞতা বেশী, মানুষের মনের জটিল প্রক্রিয়া অনুধাবন করার শক্তি বেশী, সে তাই সাবধানে কথা বলে, হিসাব করে কাজ করে। কিন্তু তার কথা ও কাজে সরলতার অভাব কোনদিনই হেরম্বের কাছে ধরা পড়েনি, মিথ্যার মানস- স্বর্গ ওর নেই এও হয়তো সত্য যে, আনন্দের সহজাত সরলতার চেয়ে স্বপ্রিয়ার মনোভিজাত্যের সরলতার বেশী মূল্যবান। একটা ছেলেমানুষী, আর একটা সুশিক্ষা।

হেরম্ব সুর বদলাল।

‘ভাল করে বোস সুপ্রিয়া, তোর কষ্ট হচ্ছে।’

‘কষ্ট হওয়া মন্দ কি? তাতে মানুষের দরদ পাওয়া যায়। চোখে না দেখলে কেউ তো বোঝে না কারো কষ্ট আছে কি নেই।’

‘কারো কি নিজের কষ্টের কিছু অভাব আছে সুপ্রিয়া, যে পরের মধ্যে কষ্ট

খুঁজে বেড়াবে?’

‘সবাই তো সকলের পর নয়।’

হেরম্ব হেসে বলল, ‘নয়? তুই ছাই জানিস্। মোহ-মুদগর, বৈরাগ্যশতক, মহানির্বাণ-তন্ত্র সব লিখেছে-‘

সুপ্রিয়া অত্যন্ত মৃদুস্বরে বলল, ‘কাছে এসে বসুন না? দূরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে লাভ কি?’

‘কোথায় বসব দেখিয়ে দে।’

‘তাহলে থাকুন দাঁড়িয়ে।’

সুপ্রিয়া জানালার সঙ্কীর্ণ স্থানটিতে অত্যন্ত অসুবিধার মধ্যে বসে ছিল; সেখানে তার কাছে বসা অসম্ভব। হেরম্ব বিছানায় বসে তাকে ডাকল, ‘আয় সুপ্রিয়া এখানে বোস। এখুনি এলি, এসেই ঝগড়া জুড়ে দিলি কেন?’

উঠে এসে বিছানায় বসে স্বপ্রিয়া বলল ‘আপনিই বা শুধু হাঙ্কা কথা বলছেন কেন? পুরীতে কেন এলাম জিজ্ঞাসা করবেন কখন ?’

‘একেবারেই যদি জিজ্ঞাসা না করি?’

‘তাহলে একটু মুশকিলে পড়ব।’ সুপ্রিয়া এবার হাসল, ‘আপনি এ ঘরে থাকেন, না?’

‘হ্যাঁ, একা। আমি এ ঘরে একা থাকি স্বপ্রিয়া।

‘তা জানি না নাকি!’