মে মাসে ভারতের অর্থনীতি আরেকটি মাইলফলক অতিক্রম করে জাপানকে টপকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার সময় দেশটির অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ব্রিটিশ শাসনের শতাব্দীজুড়ে শোষণ দেশের অর্থভিত্তিকে বিপর্যস্ত করে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর জওহরলাল নেহরুর সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ভারী শিল্প ও সরকারি খাতকে কিছুটা গতি দিলেও মোট আর্থিক প্রবৃদ্ধি ৩-৪ শতাংশেই আটকে ছিল; ব্যঙ্গ করে যাকে “হিন্দু প্রবৃদ্ধি” বলা হতো। সেই নীতির ৪০ বছরে মোট দেশীয় উৎপাদন মাত্র ২৬৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
প্রথম বিশাল লাফটি আসে ১৯৯১-এ, যখন পি. ভি. নারাসিমা রাও সরকার উদারনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করে ভারতীয় উদ্যোক্তাদের সৃজনশীলতা মুক্ত করে দেয়। একই সময়ে ইন্টারনেটভিত্তিক ডিজিটাল বিপ্লবের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কিছু মেধাবী প্রযুক্তি-উদ্যোক্তা দ্রুত সাফল্য পান। পরের দুই দশকে সেবাখাত-নির্ভর অর্থনীতি—যার অংশ তখন জাতীয় জিডিপির ৬০ শতাংশ—ভারতের সামগ্রিক উৎপাদনকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়; ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই তা দুই ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
গত দশকে মোদি সরকার দ্রুত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে স্ট্যান্ড-আপ ইন্ডিয়া, স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া ও মেক-ইন-ইন্ডিয়ার মতো কর্মসূচিতে জোর দেয়। এর বাস্তব ফল এখন চোখের সামনে—আইএমএফ-এর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ২০২5-এর মে মাসে ভারতের অর্থনীতির আকার ৪.১৯ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে জাপানকে (৪.১৮ ট্রিলিয়ন) অতিক্রম করেছে। এক সময় ৫.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি নিয়ে জাপান শীর্ষে থাকলেও ১৯৯০-এর দশক থেকে স্থবিরতা ও ধীর প্রবৃদ্ধিতে তা সংকুচিত হয়েছে।
ভারতের এ অগ্রগতিতে নিন্দুকেরা তড়িগড়ি করে মাথাচাড়া দিয়েছে মাথাপিছু আয়ের যুক্তি তুলে; কিন্তু মাথাপিছু হিসাব মূলত জনসংখ্যার আকারের ওপর নির্ভর করে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হওয়ায় ভারতের জিডিপি যতই বাড়ুক, মাথাপিছু আয় তুলনামূলক কমই থাকবে। কোন দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি কেবল মাথাপিছু আয়ের মাপকাঠিতে বিচার করা সমীচীন নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির যুক্তরাষ্ট্র মাথাপিছু আয়ে সপ্তম, আর ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারের চীন ৬৯-তম স্থানে। এমনকি ভারত ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতেও পৌঁছলেও মাথাপিছু আয়ের হিসেবে হয়তো ৫৫-তম স্থানেই থাকবে। এ যুক্তির গুরুত্ব কেবল এখানেই যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল যেন নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উন্নয়নের সুফল স্বাভাবিকভাবে সমাজের সব স্তরে পৌঁছে যায় এবং তা ভোক্তা অভ্যাসে প্রতিফলিত হয়। জরিপে দেখা যাচ্ছে, গত দশকে মাসিক মাথাপিছু ব্যয় (এমপিসিই) আড়াই গুণেরও বেশি বেড়েছে; এর উল্লেখযোগ্য অংশ ভ্রমণ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় খরচ হয়েছে—যা সুস্থ প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
গত দশকে পর্যটন খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল নজরকাড়া। কখনও চীনারাই সবচেয়ে বেশি ভ্রমণপ্রিয় বলে ধরা হতো। এখনও অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণে চীন প্রথম, কিন্তু পর্যটন অবকাঠামোর অভাব ও সীমিত ব্যয়ে বহু বছর পিছিয়ে থাকা ভারতেও এখন ভ্রমণপ্রবণতা তুঙ্গে। মাঝারি আয়ের মানুষের আয় বেড়ে যাওয়ায় দেশে ২০২৪-এ অভ্যন্তরীণ পর্যটক সংখ্যা ২৫০ কোটিতে পৌঁছেছে—গড়ে প্রত্যেক ভারতীয় বছরে দুবার করে ভ্রমণ করেছেন। আন্তর্জাতিক ভ্রমণও চোখে পড়ার মতো বেড়েছে; ২০২৪-এ বিদেশগামী ভারতীয় পর্যটক ছিল প্রায় ২.৯ কোটি, যা আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি।
এসবই দেখাচ্ছে যে ভারতের অর্থনীতি সুস্বাস্থ্যের দিকে এগোচ্ছে, প্রাথমিক দারিদ্র্য লোপ পাচ্ছে এবং যথেষ্ট ব্যয়ক্ষম মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে। সরকার ২০২৭-এর মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ও ২০৩৫-এর মধ্যে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়। গত দশকের এ সাফল্য সরকারের বিভিন্ন সংশোধনমূলক পদক্ষেপের ফল—জাল অর্থনীতি বন্ধ, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ও ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি।
তবে এখান থেকে পথচলা হতে হবে সুচিন্তিত। কেবল ভোগব্যয় নয়, বাণিজ্য ও প্রযুক্তির উপর নির্ভর করেই অর্থনীতি টেকসইভাবে বাড়ে; এখানে গুণগত মান, পরিমাণ ও গতি—এই তিনটি মূল বিচার্য। যন্ত্রায়নের আগের যুগে ১৮-শ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারত ও চীনই বৈশ্বিক অর্থনীতির শীর্ষে ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ড ও পরে আমেরিকায় শিল্পবিপ্লব ঘটায়, তারা ২০-শ শতকের শুরুতেই বিশ্বময় নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিগত শতাব্দীর শেষ ভাগে স্বয়ংক্রিয়তা ও ডিজিটালায়ন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চীন এগিয়ে গিয়ে ২০০৮-এ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি হয়।
এখন আমরা কারখানা-নির্ভর ও ডিজিটাল পর্ব পেরিয়ে প্রবেশ করেছি ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুগে, যেখানে অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে অতুলনীয় উদ্ভাবনের উপর। ভারতের মতো সম্ভাবনাময় দেশ ক্রমাগত পশ্চিমকে অনুসরণে নয়, বরং এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রবাহের আগেই এগিয়ে থাকতে হবে।
প্রথম দুই শিল্পবিপ্লবে ভারত ছিল পরাধীন, ফলে অংশ নিতে পারেনি। তৃতীয়—ডিজিটাল—বিপ্লবে কিছুটা লাভ পেয়ে আইটি সেবায় নেতৃত্ব গড়ে তোলে। কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব—যার মূল চালিকাশক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, রোবোটিকস, মহাকাশ, প্রতিরক্ষা, ক্রিপ্টো এবং বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং—এ অংশ নিতে চাইলে নতুন চিন্তা ও অগ্রাধিকার জরুরি। গত দশকের অগ্রগতি মূলত অন্তর্নিহিত সক্ষমতার মুক্তির ফল। এখান থেকে এগোতে হলে লক্ষ্য হতে হবে কৌশলগত—গভীর প্রযুক্তি গবেষণা-উন্নয়নে জোর এবং এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের অনায়াস প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, যে খাতে আমরা এখনও পিছিয়ে। তবেই ভারত আগামী দশকে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গড়ার স্বপ্ন সফল করতে পারবে।
রাম মাধব
সদস্য, বোর্ড অব গভর্নর্স, ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন