কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী অফিস সংস্কৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে যেসব প্রজন্ম—বেবি বুমার, জেনারেশন এক্স এবং মিলেনিয়ালরা—প্রথাগত অফিস পরিবেশে কাজ করে এসেছে, তাদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে নতুন কর্মজীবী প্রজন্ম: জেনারেশন জেড। তবে তারা পুরনো নিয়মে ফিরতে মোটেই প্রস্তুত নয়।
জেনারেশন জেড কখনও পূর্ণ সময় অফিসে কাজের ধারণা নিয়ে বড় হয়নি। তাই যখন কোনো প্রতিষ্ঠান পুরনো নিয়মে পুরো সপ্তাহ অফিসে আসার নিয়ম চালু করছে, তখন তারা ক্ষুব্ধ হচ্ছে। ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ‘গেট আ কর্পোরেট জব’-এর প্রতিষ্ঠাতা কেটি স্মিথ বলছেন, “জেন জেড কখনও ভাবেনি যে তাদের সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিসে যেতে হবে। তাই যখন এখন প্রতিষ্ঠানগুলো পুরনো রীতিতে ফিরতে বলছে, তখন তারা বিরক্ত।”
বহুমাত্রিক কর্মী বাহিনী: সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে বিভিন্ন প্রজন্মের কর্মীরা একই অফিসে বা টিম কলে একসঙ্গে কাজ করছে। অভিজ্ঞ মানবসম্পদ কর্মকর্তা মারিসা আন্দ্রাদা জানান, বিভিন্ন বয়সের কর্মীদের একসঙ্গে কাজ করাকে পরিবারিক আবহের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এতে যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও আছে।
তিনি বলেন, একসঙ্গে খাবার খাওয়া বা কাজের প্রস্তুতির সময় বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও চিন্তাধারার বিনিময় হয়। এতে কর্মীরা একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। আন্দ্রাদা বর্তমানে ডব্লিউইউএফ ওয়ার্ল্ড নামের মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে চিফ কালচার অফিসার হিসেবে কর্মরত।
কর্মশক্তিতে জেনারেশন জেড-এর অংশগ্রহণ বাড়ছে
PEW রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া জেনারেশন জেড সদস্যরা ২০২০ সাল থেকে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে তারা কর্মশক্তির ১৮ শতাংশে পৌঁছেছে। অপরদিকে বেবি বুমারদের অংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশে।
বর্তমানে কর্মশক্তির সবচেয়ে বড় অংশ মিলেনিয়ালরা (১৯৮১-১৯৯৬), যারা ৩৬ শতাংশ। এরপর আছে জেনারেশন এক্স (১৯৬৫-১৯৮০), যারা ৩১ শতাংশ। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে জেনারেশন জেড কর্মশক্তির প্রায় ৩০ শতাংশ হয়ে উঠবে।
জেনারেশন জেড-এর জন্য সেরা কর্মস্থলের তালিকা
জেনারেশন জেড সদস্যদের জন্য কর্মসংস্থান সহজ করতে নিউজউইক ও ডেটা অ্যানালিটিক্স প্রতিষ্ঠান প্ল্যান্ট-এ ইনসাইটস যৌথভাবে তৈরি করেছে ‘আমেরিকার সেরা কর্মস্থল ফর জেন জেড ২০২৫’ তালিকা। এই তালিকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জনসাধারণের তথ্য, মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার এবং জেনারেশন জেড কর্মীদের অনলাইন জরিপের তথ্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর সোশ্যাল মিডিয়া রিভিউ, পেশাগত উন্নয়ন এবং কর্পোরেট সংস্কৃতিও মূল্যায়িত হয়েছে।
অফিসে ভারসাম্য: হাইব্রিড বা রিমোট কাজ
ডেলয়েটের ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, জেনারেশন জেড এবং মিলেনিয়ালদের প্রায় ৬০ শতাংশ মনে করে, তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাখে। বিশেষ করে কর্ম-জীবন ভারসাম্য, মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক প্রভাব, বৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে তারা বেশ সচেতন।
তবে মহামারির সময় রিমোট বা হাইব্রিড কাজের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, অনেক প্রতিষ্ঠান সেটি বাতিল করে আবার পুরনো নিয়মে ফিরতে চাইছে। এতে তরুণ কর্মীরা মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে।
কেটি স্মিথ জানান, অনেক জেন জেড কর্মী ফোনে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে এবং অফিসের সেই পুরনো সামাজিক যোগাযোগ ও পরামর্শের সুযোগগুলো তারা হারিয়ে ফেলেছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গে পরিবর্তন
জেনারেশন জেড কর্মীরা অফিসে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। এর ফলে শুধু তরুণরা নয়, সব বয়সের কর্মীরা উপকৃত হচ্ছে।
গ্রেট উলফ লজের চিফ ওয়েলনেস অফিসার ডা. রুমি মুশতাক বলেন, আগের প্রজন্মের “সহ্য করো” মানসিকতা থেকে সরে এসে মিলেনিয়াল ও জেনারেশন জেড মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি জানান, তাদের সঙ্গে প্রতিদিন বিভিন্ন থেরাপি, ওষুধ ও মেডিটেশনের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা হয়।
নেতৃত্বের জন্য করণীয়
ডা. মুশতাক বলেন, “সব প্রজন্মের ভাষা আলাদা। ভাষার এই ফারাক না বুঝে এগিয়ে গেলে কখনওই সমস্যাগুলো সমাধান হবে না।” তাই নেতৃত্বকে এই ভাষার ব্যবধান বুঝে সমন্বয় তৈরি করতে হবে।
কেটি স্মিথ যোগ করেন, যখন বিভিন্ন প্রজন্ম একসঙ্গে কাজ করে, তখন তারা একে অপরের কাছ থেকে নতুন দক্ষতা শিখতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ইতিবাচক।
অন্যদিকে মারিসা আন্দ্রাদা মনে করেন, প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিত স্পষ্ট উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধ। নেতৃত্বকে এই মূল্যবোধ ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে আচরণ করতে হবে। এতে প্রতিষ্ঠানজুড়ে অন্তর্ভুক্তি, ঐক্য এবং উৎপাদনশীলতা বাড়বে।