কঠিন চ্যালেঞ্জের নাম আলঝেইমার
মেডিকেল বিজ্ঞানের বহু চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে জটিলগুলোর একটি হলো আলঝেইমার রোগ, যা ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে সাধারণ রূপ। ১৯৯৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আলঝেইমার গবেষণায় বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২.৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এই বিপুল ব্যয়ে চালানো ১৪০টির বেশি ওষুধের ট্রায়াল থেকে একটিও কার্যকর ওষুধ পাওয়া যায়নি, যা রোগটির গতি কমাতে পারে। তবে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এখন বাজারে দু’টি কার্যকর ওষুধ আছে এবং আরও কিছু আসার সম্ভাবনার কথা বলছে একটি সাম্প্রতিক গবেষণা।
২০২৫ সালে আলঝেইমারের চিকিৎসায় ১৮২টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে—গত বছরের তুলনায় ১১% বেশি। এতে পরীক্ষা করা হচ্ছে ১৩৮টি ভিন্ন ওষুধ, যার মধ্যে ১২টি চলতি বছরই চূড়ান্ত ‘ফেজ-থ্রি’ ট্রায়াল শেষ করতে পারে। গবেষণাগুলো এখন আলঝেইমারের জৈব-রসায়নগত বিভিন্ন স্তরের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে, যা এই রোগ বোঝার ক্ষেত্রে আরও সূক্ষ্ম ও আধুনিক জ্ঞানকে প্রতিফলিত করছে।
অ্যামিলয়েড হাইপোথেসিসের সীমাবদ্ধতা
দীর্ঘদিন ধরে আলঝেইমার গবেষণার মূল ভিত্তি ছিল অ্যামিলয়েড তত্ত্ব—যেখানে বলা হয়, মস্তিষ্কে বিটা-অ্যামিলয়েড প্রোটিনের জমে থাকা প্ল্যাকই এই রোগের মূল কারণ। এটি নিউরন বিকলতা, কোষমৃত্যু এবং নিউরোইনফ্ল্যামেশন ঘটায়। এই তত্ত্ব জেনেটিক প্রমাণে সমর্থিত ছিল এবং বাজারে থাকা লেকানেম্যাব ও ডোনানেম্যাব নামের দুটি ওষুধ এই প্রোটিন সরিয়ে রোগপ্রবাহ এক-তৃতীয়াংশ ধীর করে। তবে, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শুধুমাত্র অ্যামিলয়েডের উপর নির্ভর করাটা ভুল ছিল।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি অধ্যাপক জেমস রো বলেন, অ্যামিলয়েড হয়তো প্রাথমিক ট্রিগার, কিন্তু রোগীর মস্তিষ্কে তখন অন্য প্রোটিন যেমন ‘টাও’, বিপর্যস্ত কোষ বিপাকক্রিয়া, রক্ত সঞ্চালনের ক্ষয় ও প্রদাহসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়।
নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও বিনিয়োগের গতি
এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জ্ঞানের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ওষুধ উন্নয়নে। ইউনিভার্সিটি অফ নেভাডা, লাস ভেগাসের গবেষক জেফরি কামিংসের নেতৃত্বে প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন ওষুধগুলো নানা লক্ষ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরাও এই পরিবর্তনে আশাবাদী।
লন্ডনভিত্তিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম এসভি হেলথ ইনভেস্টরসের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ডেম কেট বিংহ্যাম জানান, ২০১৫ সালে যখন তারা ডিমেনশিয়ার জন্য প্রথম বিনিয়োগ তহবিল গড়েন, তখন প্রায় সব ওষুধই অ্যামিলয়েড নিয়েই ছিল। এখন লক্ষ্যবস্তু বেড়েছে, যা ভবিষ্যৎ নিয়ে তাকে আশাবাদী করেছে।
পুরনো ওষুধের নতুন ব্যবহার
নতুন ওষুধগুলোর এক-তৃতীয়াংশ পুরনো ওষুধের পুনঃব্যবহার। এর মানে, এই ওষুধগুলো অন্য রোগে ব্যবহৃত হয়েছে এবং নিরাপত্তা প্রোফাইল জানা। উদাহরণ হিসেবে, সেমাগলুটাইড—ডায়াবেটিস ও ওজন কমানোর ওষুধ—যা প্রদাহ কমানো ও বিপাক নিয়ন্ত্রণের জন্য আলঝেইমারে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
আরেকটি ওষুধ পিরোমেলাটিন কাজ করে মেলাটোনিন ও সেরোটোনিন রিসেপ্টরের ওপর, যা ঘুম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ঘুম ভালো হলে অ্যামিলয়েড দ্রুত নিষ্কাশিত হয়। আরও একটি আকর্ষণীয় ওষুধ হলো AR1001 (মিরোডেনাফিল), যা মূলত পুরুষত্বহীনতার চিকিৎসায় তৈরি হলেও এখন নিউরোপ্রটেকটিভ বৈশিষ্ট্যের কারণে আলঝেইমারে পরীক্ষা চলছে।
ডেম কেট মনে করেন, পুনঃব্যবহারের চেয়ে নতুন লক্ষ্যবস্তু নিয়ে উদ্ভাবনই আলঝেইমারের চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
প্রদাহ ও মাইক্রোগ্লিয়া নিয়ে গবেষণা
নতুন গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো মস্তিষ্কের প্রদাহ কমানো। এতে গুরুত্ব পাচ্ছে মাইক্রোগ্লিয়া নামের কোষ, যা মস্তিষ্কের ইমিউন প্রতিক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা রাখে। এই কোষগুলোকে মস্তিষ্কের ‘ফায়ার সার্ভিস’, ‘পুলিশ’ এবং ‘পরিষ্কারক’ বলা হয়। কিছু ওষুধ চেষ্টা করছে TREM2 নামের একটি প্রোটিনকে সক্রিয় করতে, যাতে মাইক্রোগ্লিয়ার কাজ আরও কার্যকর হয়।
আরও চলছে ওষুধের সংমিশ্রণ পরীক্ষাও। যেমন ক্যানসারের ওষুধ ডাসাটিনিব ও উদ্ভিজ্জ উপাদান কোয়ারসেটিন একত্রে ব্যবহার করে কোষ পরিস্কার ও পুনর্জীবিত করার সম্ভাবনা দেখা হচ্ছে।
পুরনো ভুল থেকে শিক্ষা
অতীতের ভুলগুলো থেকে শিখে এখন গবেষণাগুলো আরও সতর্ক। ড. রো বলেন, আগে অ্যামিলয়েড দূর করার চেষ্টা যথেষ্ট ছিল না এবং ভুল রোগীদের পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অনেকে আসলে আলঝেইমারে ভোগেননি।
নারীদের জন্য আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি দরকার
নারীরা পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ হারে আলঝেইমারে আক্রান্ত হন, কেবল দীর্ঘজীবন এর কারণ নয়। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ‘উইমেনস ব্রেইন ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ড. আন্তোনেলা চাদ্দা বলেন, নারীদের মস্তিষ্কে ‘টাও’ প্রোটিন আরও বিস্তৃতভাবে ছড়ায়। তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ট্রায়াল এখনো নারী-পুরুষ পার্থক্য বিবেচনা করে না।
আরও একটি জরুরি বিষয় হলো, আলঝেইমারের প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ শনাক্ত করে রোগীদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা। একটি জাতীয় নিবন্ধন তালিকা থাকলে ওষুধ প্রস্তুতকারক ও রোগীরা সহজে সংযুক্ত হতে পারে।
আশা এখনও আছে
এখনো অনেক পথ বাকি। কিন্তু এই কঠিন ও মস্তিষ্ক ধ্বংসকারী রোগে যারা ভুগছেন, তাদের জন্য অবশেষে একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এটি একেবারেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।