এই সপ্তাহে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রায় ৪০ শতাংশ তদারক করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকারেরা সুদের হার নির্ধারণের কৌশল আঁকছেন, যেন চোখ বেঁধেই।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে ওয়াশিংটন, টোকিও, লন্ডন, জাকার্তা, ব্রাসিলিয়া ও অন্য শহরের নীতিনির্ধারকরা ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ ঘিরে ঝাপসা দৃশ্যপটে ছিলেন। গত শুক্রবার থেকে ইসরায়েল ও ইরানের সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় ২০২৫-এর দ্বিতীয়ার্ধে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির গতি কী হবে, তা এখন আন্দাজ করা দুঃসাধ্য। মানচিত্রহীন উড়ানে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের কাছে এটাই নতুন স্বাভাবিক।
জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা ধরুন। অনিশ্চিত বিশ্বে সামান্য দৃশ্য নিয়ে পথ খুঁজতে গিয়ে গভর্নর কাজুও উয়েদা শীর্ষ সারির চ্যালেঞ্জের মুখে। মঙ্গলবার যে সিদ্ধান্তে সুদের হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা গরম সংঘাতে রূপ নেওয়ার আগে সেই সিদ্ধান্তের উপাত্তই ছিল অস্পষ্ট; এখন উয়েদার দুশ্চিন্তা আরও গভীর।
সম্ভবত বছরটির প্রথমার্ধে জাপান মৃদু মন্দায় ঢুকে পড়েছে। প্রথম প্রান্তিকে দেশটির জিডিপি ০.২ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়, ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আগুন ঝরানোর আগেই। এপ্রিল–জুন প্রান্তিক আরও খারাপ হতে পারে; প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয় কমাচ্ছে, ভোক্তারা ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর ঢেউ সামাল দিতে কোমর বাঁধছেন।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির ‘স্ট্যাগ’ অংশকে শক্তিশালী চাপ দিচ্ছে ট্রাম্পের ৩০ শতাংশ চীন-শুল্ক, যার বন্ধকি ক্ষতির কেন্দ্রেই জাপান। গাড়িতে ২৫ শতাংশ, ইস্পাত-অ্যালুমিনিয়ামে ৫০ শতাংশ, ‘পারস্পরিক’ ২৪ শতাংশ শুল্ক, আর ‘একতরফা’ শুল্কের আলোচনা টোকিওকে দিশেহারা করে তুলেছে।
প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এক দিকে আগামী মাসের সাধারণ নির্বাচন, অন্য দিকে ট্রাম্পশাসিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির দড়ি টানাটানিতে আটকে আছে। তবে ইশিবা নিজেকে ট্রাম্পের ভাবনার চেয়ে বেশি কৌশলী প্রমাণ করেছেন; ছয় বছরের মধ্যে দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র-জাপান বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে টোকিওর তাড়াহুড়ো নেই।
৭ মে, ওয়াশিংটনে সুদের হার নীতিনির্ধারণী বৈঠক–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল। © রয়টার্স
এদিকে এশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা তেলের দামের গন্তব্য—তার অর্থ, মার্কিন সুদের হারের ভবিষ্যত—নিয়ে সমান অন্ধকারে। ট্রাম্পের প্রথম ও দ্বিতীয় মেয়াদে একটি ধারাবাহিক বক্তব্যই ছিল, ফেডারেল রিজার্ভ হোয়াইট হাউসের ইচ্ছায় নতি স্বীকার করবে। এই সপ্তাহে জেরোম পাওয়েলের নেতৃত্বাধীন বোর্ড সুদ অপরিবর্তিত রাখবে বলে অভিন্ন ধারণা, ট্রাম্পের শিথিল নীতি চাওয়ার চাপ সত্ত্বেও।
কিন্তু ট্রাম্প কি আবারও পাওয়েলকে বরখাস্তের চেষ্টা করবেন—যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে সতর্ক করেছেন? নিশ্চিত নয়। এই ঝুঁকির তলোয়ার ঝুলছে জাকার্তা, ম্যানিলা, তাইপে এমনকি বেইজিংয়ের সুদ সিদ্ধান্তের ওপর।
শুক্রবার পিপলস ব্যাংক অব চায়না এক ও পাঁচ বছরের প্রাইম লোন রেট কাটা হবে কি না জানাবে। মূল্যস্ফীতির নিম্নচাপ আর সম্পত্তি সংকটে ভোক্তাদের আস্থা টলে যাচ্ছে, ফলে গভর্নর প্যান গংশেংয়ের সুদ কমানোর কারণ আছে।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা দ্রুত সব হিসাবকে জটিল করছে। ইঙ্গিত আছে, তেহরান ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলাপ শুরু করতে আগ্রহী। একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে, ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধের কথা ভাবছে—যা জ্বালানি সরবরাহের সমীকরণ ওলটপালট করবে। ট্রাম্পও সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘সবাই তেহরান থেকে অবিলম্বে সরে পড়ুন!’—এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকারের সঙ্গে জোট বাঁধার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ইউরেশিয়া গ্রুপের সিইও ইয়ান ব্রেমার সোমবার এক নোটে লিখেছেন, ‘ট্রাম্পকে সতর্ক পা ফেলতে হবে। হস্তক্ষেপ করলে বড় যুদ্ধের ঝুঁকি, আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও ইরান-ইসরায়েল উভয়েই উত্তেজনা বাড়াতে পারে। সিদ্ধান্ত আপনার, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’
সিদ্ধান্ত ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেইয়েরও—শোনা যাচ্ছে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্য হতে পারেন। লিপো অয়েল অ্যাসোসিয়েটসের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডি লিপো সিএনবিসিকে বলেন, ‘ইরান ভালো করেই জানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কম তেলের দাম চান। তাই তেল বাজার চিন্তিত যে ইরান ইসরায়েলি কিংবা মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে পাল্টা হামলা চালালে বড় ধরনের সামরিক সংঘাত আর জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে।’
সাবেক সিআইএ বিশ্লেষক হেলিমা ক্রফট বিস্ময় প্রকাশ করেন যে বৈশ্বিক বাজার আরও জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটসের বৈশ্বিক পণ্য কৌশলপ্রধান ক্রফট বলেন, ‘যুদ্ধ দীর্ঘ হলে গুরুতর সরবরাহ ঘাটতির ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে।’ ইতিমধ্যে খবর আছে, কিছু ট্যাংকার অপারেটর ঝুঁকি বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্য রুটে জাহাজ ভাড়া বন্ধ রেখেছে, ফলে ভাড়া হু হু করে বাড়ছে।
পাওয়েল, উয়েদা এবং তাঁদের বিশ্বজুড়ে সহকর্মীদের সামনে জটিলতা আরও বেড়েছে—ব্রেন্ট তেলের দাম এখন ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৭২ ডলার; অল্প সময়ে এটা ১০০ ডলার ছুঁতে পারে, আবার ৭০ ডলারেও নেমে আসতে পারে। এই দোদুল্যমানতার ভেতরেই উভয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অস্বস্তিতে—আগামী পদক্ষেপ হবে সুদ বাড়ানো, না কমানো?
পাওয়েলের দল দাম বাড়ার ঝুঁকি নিয়ে সরব হতে দ্বিধা করতে পারে—ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া ভেবে। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক ভোক্তা দামে গিয়ে লাগা আর তেলের দামের উত্থানের আশঙ্কা মিলিয়ে ফেডের যথেষ্ট কারণ আছে খরচ নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় করার।
মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি বার্ষিক হিসাবে ২.৪ শতাংশে নেমেছে; তবে বৈশ্বিক ঘটনার ঢেউ লেগে জি-৭ নেতারা (যারা এ সপ্তাহে কানাডার রকি পর্বতে মিলিত হয়েছিলেন) কার্যত নিয়ন্ত্রণ হারালে এটাই হয়তো নিম্নস্তর। ট্রাম্প অবশ্য তোয়াক্কা করেননি—সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই তিনি বেরিয়ে গেছেন। ব্রেমারই প্রশ্ন তুলেছেন, এখন কি জি-৭ আসলে ‘জি-৬ + ১’?
নিয়ন্ত্রণহীন ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপট এশিয়ার বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে তুলনামূলক কম পরিচিত ব্যাংকগুলোকে দিশেহারা করছে। ব্যাংক ইন্দোনেশিয়া ও ব্যাংকো সেন্ট্রাল ন্ গ পিলিপিনাস সপ্তাহের শুরুতে নতুন ‘ওয়াইল্ডকার্ড’-এর মুখোমুখি হয়েছে। চীন-জাপানের মতোই, যদি তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবৃদ্ধির চিত্র নাটকীয়ভাবে বদলে যেতে পারে।
ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষ শুরুর আগে থেকেই চীন, জাপান ও অন্য প্রধান এশীয় অর্থনীতি ২০২৫ সালে কঠিন সময় পার করছিল। এখন নীতিনির্ধারকেরা শুল্ক নিয়ে নয়, বরং ১৯৭০-এর দশকের তেল সংকট ফিরিয়ে আনার মতো সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ে আতঙ্কিত।
লেখক: উইলিয়াম পেসেক টোকিওভিত্তিক একাধিক পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক ও ‘জাপানাইজেশন: জাপানের হারানো দশক থেকে বিশ্ব কী শিখতে পারে’ গ্রন্থের লেখক।