গত তিন দশকের অধিক সময় ধরে এশিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তা টিকেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রসারিত প্রতিরোধ-ছত্রছায়ার ওপর ভর করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি—যা বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা কমিয়ে আনার এবং মিত্রদের নিজেদের প্রতিরক্ষায় বেশি খরচ ও অবদান রাখার আহ্বান জানায়—সে ছত্রছায়াকে ধরে টান দিচ্ছে।
এ ইঙ্গিতগুলো স্পষ্ট। বছরের শুরুতেই সংবাদ বেরোয় যে পেন্টাগন প্রায় ৪,০০০ মার্কিন সেনাকে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে গুয়ামে স্থানান্তরের বিষয়টি বিবেচনা করছে, যেন তারা চীন মোকাবিলায় বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। এতে সিউলে আশঙ্কা জাগে যে ওয়াশিংটন আর তাদের নিরাপত্তায় আগের মতো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। এর ঠিক আগের সপ্তাহে পেন্টাগন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আলোচিত অকাস (AUKUS) চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন শুরু করেছে, যার আওতায় অস্ট্রেলিয়ার জন্য মার্কিন প্রযুক্তি দিয়ে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি হওয়ার কথা।
যদিও কোনোটিই এখনো কার্যকর পরিবর্তনে রূপ নেয়নি, সিঙ্গাপুরের শাংরি-লা সংলাপে গত মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ জোর দিয়েই বলেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিকই আমেরিকার অগ্রাধিকারের মঞ্চ। কিন্তু প্রকাশ্য বলিষ্ঠ বক্তব্যের আড়ালে “আমেরিকা ফার্স্ট” কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় সংকল্পের চিন্হও চোখে পড়ছে।
ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি ইতোমধ্যেই সেই পথে। সৌদি আরবে গত মাসে প্রদত্ত এক অত্যন্ত গোছানো ও সুসংহত ভাষণে ট্রাম্প অতীত মার্কিন নীতি—যা অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শ ও মূল্যবোধ ছড়াতে ও রক্ষা করতে চেয়েছিল—সমালোচনায় ভরিয়ে দেন। তিনি বলেন, “শেষ পর্যন্ত তথাকথিত জাতি-গড়ারেরা যত দেশ গড়ার কথা বলেছিল, ধ্বংস করেছে তার চেয়েও বেশি; আর হস্তক্ষেপকারীরা এমন জটিল সমাজে হস্তক্ষেপ করছিল, যেগুলোকে তারা নিজেরাও বুঝত না।”
ইসরায়েল ইরানকে আক্রমণ করলে পাল্টা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলও আক্রান্ত হয়; এমন পরিস্থিতিতেও ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী মহল যুক্তরাষ্ট্রকে সংঘাতে জড়াতে না করার আহ্বান জানায়। রিপাবলিকান মূলধারাও এ ক্ষেত্রে ভেঙে পড়ে; ট্রাম্পঘনিষ্ঠ টাকার কার্লসন ও স্টিভ ব্যানন একে “ইসরায়েলের সৃষ্টি করা যুদ্ধ” আখ্যা দেন। মনে হচ্ছে, ইসরায়েল রক্ষাও এখন “আমেরিকা ফার্স্ট” দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় পড়ছে।
এশিয়া ও অন্যত্র মিত্র-সঙ্গীদের চ্যালেঞ্জ হলো—যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা যদি আর অটুট না থাকে, তবে ঝুঁকি সামলাবে কীভাবে। এক সাবেক জ্যেষ্ঠ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা বলেন, “নিজ দেশের ভেতরেই প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বদানের সামর্থ্যে আমার আস্থা কমছে। মিত্র-সঙ্গীরা নিজেদের জাতীয় ঝুঁকি মেনে নিয়ে এখন নিজেদের পথেই হাঁটছে—এ মুহূর্তে এটাই তাদের ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শ্রেয়।”
ইতোমধ্যে ইউরোপ দ্রুত এগোচ্ছে; কানাডাও প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বদলে ইউরোপের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
এশিয়ার সমস্যা হলো—যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক মিত্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ফিলিপাইন যা-ই করুক, তা চীনের সঙ্গে কৌশলগত অবস্থানের ওপর প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে কোরীয় উপদ্বীপ, তাইওয়ান প্রণালী ও দক্ষিণ চীন সাগরকে ঘিরে সম্ভাব্য সংঘর্ষবিন্দুগুলোতে।
এখানেই বিষয়টি জটিল হয়। কারণ স্পষ্ট নয় যে চীন আদৌ যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পশ্চাদপসারণকে বিশ্বাস করে বা স্বাগত জানায় কিনা। স্থিতাবস্থার পক্ষে থাকা চীনা ধারণা হলো—মার্কিন প্রতিরোধ-ছত্রছায়া দুর্বল হলে এশিয়ায় নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে, আর দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান পারমাণবিক হামলা-ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এতে নিরাপত্তা পরিবেশ অনিশ্চিত ও কঠিন হবে—চীনা যুক্তি এমনই।
এটি প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে যায়—যার মূল হলো, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতি চীনের অর্ধ-মনোযোগী বিরোধিতাকে ধরে ধরে যে যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্যুতি চীনের জন্য বড় ভূমিকা নিতে সুযোগ তৈরি করে।
ট্রাম্পের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের ‘অ্যালার্জি’র সুবিধা নেওয়া থেকে বিরত থাকার এক কারণ—চীন ব্যাপারটিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। আসলে তাইওয়ান রক্ষায় মার্কিন ভাষ্যই এখনো তুঙ্গে।
সিঙ্গাপুরে হেগসেথ তাঁর প্রধানত এশীয় শ্রোতাদের জানান, বেইজিং ইন্দো-প্যাসিফিকে শক্তির ভারসাম্য বদলাতে সামরিক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বলেন, “স্পষ্ট করে দিই: কমিউনিস্ট চীন যদি তাইওয়ান জয় করতে এগোয়, তবে ইন্দো-প্যাসিফিক ও বিশ্বে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। হালকা করে বলব না—চীনের হুমকি বাস্তব, এবং তা অবিলম্বে ঘটতেও পারে।”
চীন এখনো ইউরোপের স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা-চেষ্টাকেও তেমন গুরত্ব দিচ্ছে না। ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি আনতে ব্যর্থ হওয়ায় ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের তিক্ত বাকযুদ্ধে বোঝা যায়—যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এখনই ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সহায়তা দেওয়া বাতিল ধরে নেওয়া যায় না।
স্থিতাবস্থাপ্রবণ চীনের এই সতর্কতা মিত্র-সঙ্গীদের জন্য আপাতত এক ধরনের বাফার তৈরি করছে, যারা নিজেদের প্রতিরক্ষায় প্রস্তুতি বাড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করছে।
তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে সাব-রিজিয়ন বা ‘মিনিল্যাটারাল’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রাসঙ্গিকতায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উপনিবেশোত্তর ফাইভ পাওয়ার ডিফেন্স অ্যারেঞ্জমেন্টস—যে চুক্তিতে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য রয়েছে—এর সদস্যরা সদ্য যৌথ মহড়া উন্নীত করা, উন্নত সামরিক সম্পদ মোতায়েন এবং উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ বাড়াতে সম্মত হয়েছে।
তবে চীন বেশি দিন নিষ্ক্রিয় থাকবে না বলেই মনে হয়। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে এক জ্যেষ্ঠ চীনা কর্মকর্তা ইসরায়েলে এক অনুষ্ঠানে জানান, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বেইজিং-বহাল চুক্তি চীনের বৃহত্তর “অঞ্চলের জন্য নতুন নিরাপত্তা কাঠামো ডিজাইন”-এর অংশ।
লেখক: মাইকেল ভাতিকিওটিস একজন লেখক ও আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ-মধ্যস্থতাকারী। এশীয় রাজনীতি নিয়ে তাঁর একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। এখানে প্রকাশিত মতামত তাঁর নিজস্ব।