০৩:০১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

১৯৭৫ এ জরুরি অবস্থার আগেই দুর্বল হয়ে পড়ে ছিল প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন

১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পেরিয়ে ভারতীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে ঘিরে ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া এখনো প্রকট। ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবনের মতে, জরুরি অবস্থার আগে-পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই দীর্ঘমেয়াদে ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোকে রূপ দিয়েছে। দিল্লিতে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর এক আলোচনাসভায় তিনি এসব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন।

একদলীয় আধিপত্য থেকে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতিতে রূপান্তর

১৯৬৭-এর চতুর্থ লোকসভা নির্বাচনের পর কংগ্রেস অপরিহার্য শক্তি থাকলেও বিরোধীরা উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়। এই প্রতিযোগিতামূলক আবহে নির্বাচনী গণতন্ত্রের লিখিত-অলিখিত নিয়ম ভাঙার প্রবণতা বাড়ে, যার চূড়ান্ত প্রকাশ ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা।

কার্যকরীর প্রাধান্য ও দলীয় কাঠামোর বদল

ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে সংসদ ও বিচার বিভাগের তুলনায় নির্বাহী শাখা স্পষ্টতই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। নির্বাহী একক নেতৃত্বের বদৌলতে দলীয় সংগঠন মানুষ-ইচ্ছার ধারক না হয়ে নেতার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে জোরদার করার যন্ত্রে পরিণত হয়। এই ‘সিজারসুলভ’ নেতৃত্বের প্যাটার্ন জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি বহু রাজ্যেও দেখা যায়।

অর্থনৈতিক নীতিতে দ্বৈত ছাপ

১৯৭০-এর দশকে ব্যাংক জাতীয়করণসহ কল্যাণমুখী পদক্ষেপ ইন্দিরা বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তবে ১৯৭৪-এর পর থেকেই ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ শিথিল ও বাজারমুখী সংস্কারের ঢেউ লাগে, যা ১৯৮০-এর দশকের মুক্তবাজারমুখী ধারা প্রস্তুত করে। দারিদ্র্যরেখা ভিত্তিক লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা কর্মসূচির ধারণাও এ সময় পাকাপোক্ত হয়।

পরিবারতন্ত্রের শিকড়

দল ভেঙে ১৯৬৯-এ নতুন করে সংগঠিত করার পরও কংগ্রেসের জেলা-বৃক্ষ পুনর্গঠনে ইন্দিরা সাফল্য পাননি। সংগঠন টিকিয়ে রাখতে প্রথমে সঞ্জয়, পরে রাজীব গান্ধীর ওপর নির্ভরতা জন্ম নেয়। এরই মাধ্যমে ভারতে পরিবারতন্ত্র চর্চার পথ প্রশস্ত হয় এবং আজও কংগ্রেসে বিকল্প নেতৃত্বের উত্থান কঠিন হয়ে আছে।

জরুরি অবস্থার পথ প্রস্তুত হল কীভাবে

আলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় (১২ জুন ১৯৭৫) ইন্দিরাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করলে জে-পি আন্দোলন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে। ততদিনে সংসদীয় দলের নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নির্বাচনী বিধির ভারসাম্য নির্বাহীর দিকে ঢলে পড়েছিল। নিয়মকানুন দুর্বল হয়ে পড়ায় ২৫ জুন ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারি করা সহজ হয়ে যায়।

শক্তিশালী নেতা’ ধারণার স্থায়ী ছাপ

জরুরি অবস্থার পর ইন্দিরা ২০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে নির্বাচক-গোষ্ঠীগুলোর কাছে সরাসরি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রশাসনের চেয়ে শক্তিশালী নেতার ওপর নির্ভরতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা আজও ভারতীয় রাজনীতিতে বিদ্যমান।

জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের যুক্তি

১৯৭৬-এর মাঝামাঝি জরুরি অবস্থার সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নানা মূল্যায়ন পৌঁছায়। শ্রমিক সংগঠনে দমন, বিতর্কিত জন্মনিয়ন্ত্রণ অভিযান, ভূমি বণ্টনের সীমিত অগ্রগতি এবং জনঅসন্তোষ বাড়ায় অবস্থা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলত ১৯৭৭-এ নির্বাচন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ইন্দিরা, যাকে তিনি ‘স্বল্পস্থায়ী পর্যায়’ বলে দেখেছিলেন।

কংগ্রেসের সামনে কী শিক্ষা

ইন্দিরার সাহসী কিন্তু জুয়ার স্বভাব কংগ্রেসকে একসময় শক্তি দিয়েছিল, আবার একই সঙ্গে দলীয় গণতন্ত্র ক্ষয় করেছে। আজ কংগ্রেস যদি তার কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে নতুন ধারণা ও নেতৃত্ব তুলে আনতে পারে, তবেই ইন্দিরার দৃঢ়তার ইতিবাচক দিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।

ইতিহাসের সতর্কবার্তা

ইন্দিরা একাই জরুরি অবস্থা আনেননি; সমগ্র রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির নিয়ম-উপেক্ষা ও ক্ষমতালোভ এতে ভূমিকা রেখেছিল। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর জন্য মূল পাঠ হলো—গণতান্ত্রিক নিয়ম ও সংযম উপেক্ষা করলে বড় বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।

জরুরি অবস্থার পঞ্চাশ বছর পরও ইন্দিরা গান্ধীর সময়ের সিদ্ধান্ত ও অভিজ্ঞতা ভারতীয় রাজনীতির পথচলায় দাগ কেটে আছে। প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য, দলীয় গণতন্ত্র ও শক্তিশালী-নেতা সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার উপযুক্ত সময় এটাই—যাতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যায়।

১৯৭৫ এ জরুরি অবস্থার আগেই দুর্বল হয়ে পড়ে ছিল প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন

০৮:০০:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পেরিয়ে ভারতীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে ঘিরে ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া এখনো প্রকট। ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবনের মতে, জরুরি অবস্থার আগে-পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই দীর্ঘমেয়াদে ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোকে রূপ দিয়েছে। দিল্লিতে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর এক আলোচনাসভায় তিনি এসব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন।

একদলীয় আধিপত্য থেকে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতিতে রূপান্তর

১৯৬৭-এর চতুর্থ লোকসভা নির্বাচনের পর কংগ্রেস অপরিহার্য শক্তি থাকলেও বিরোধীরা উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়। এই প্রতিযোগিতামূলক আবহে নির্বাচনী গণতন্ত্রের লিখিত-অলিখিত নিয়ম ভাঙার প্রবণতা বাড়ে, যার চূড়ান্ত প্রকাশ ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা।

কার্যকরীর প্রাধান্য ও দলীয় কাঠামোর বদল

ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে সংসদ ও বিচার বিভাগের তুলনায় নির্বাহী শাখা স্পষ্টতই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। নির্বাহী একক নেতৃত্বের বদৌলতে দলীয় সংগঠন মানুষ-ইচ্ছার ধারক না হয়ে নেতার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে জোরদার করার যন্ত্রে পরিণত হয়। এই ‘সিজারসুলভ’ নেতৃত্বের প্যাটার্ন জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি বহু রাজ্যেও দেখা যায়।

অর্থনৈতিক নীতিতে দ্বৈত ছাপ

১৯৭০-এর দশকে ব্যাংক জাতীয়করণসহ কল্যাণমুখী পদক্ষেপ ইন্দিরা বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তবে ১৯৭৪-এর পর থেকেই ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ শিথিল ও বাজারমুখী সংস্কারের ঢেউ লাগে, যা ১৯৮০-এর দশকের মুক্তবাজারমুখী ধারা প্রস্তুত করে। দারিদ্র্যরেখা ভিত্তিক লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা কর্মসূচির ধারণাও এ সময় পাকাপোক্ত হয়।

পরিবারতন্ত্রের শিকড়

দল ভেঙে ১৯৬৯-এ নতুন করে সংগঠিত করার পরও কংগ্রেসের জেলা-বৃক্ষ পুনর্গঠনে ইন্দিরা সাফল্য পাননি। সংগঠন টিকিয়ে রাখতে প্রথমে সঞ্জয়, পরে রাজীব গান্ধীর ওপর নির্ভরতা জন্ম নেয়। এরই মাধ্যমে ভারতে পরিবারতন্ত্র চর্চার পথ প্রশস্ত হয় এবং আজও কংগ্রেসে বিকল্প নেতৃত্বের উত্থান কঠিন হয়ে আছে।

জরুরি অবস্থার পথ প্রস্তুত হল কীভাবে

আলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় (১২ জুন ১৯৭৫) ইন্দিরাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করলে জে-পি আন্দোলন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে। ততদিনে সংসদীয় দলের নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নির্বাচনী বিধির ভারসাম্য নির্বাহীর দিকে ঢলে পড়েছিল। নিয়মকানুন দুর্বল হয়ে পড়ায় ২৫ জুন ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারি করা সহজ হয়ে যায়।

শক্তিশালী নেতা’ ধারণার স্থায়ী ছাপ

জরুরি অবস্থার পর ইন্দিরা ২০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে নির্বাচক-গোষ্ঠীগুলোর কাছে সরাসরি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রশাসনের চেয়ে শক্তিশালী নেতার ওপর নির্ভরতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা আজও ভারতীয় রাজনীতিতে বিদ্যমান।

জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের যুক্তি

১৯৭৬-এর মাঝামাঝি জরুরি অবস্থার সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নানা মূল্যায়ন পৌঁছায়। শ্রমিক সংগঠনে দমন, বিতর্কিত জন্মনিয়ন্ত্রণ অভিযান, ভূমি বণ্টনের সীমিত অগ্রগতি এবং জনঅসন্তোষ বাড়ায় অবস্থা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলত ১৯৭৭-এ নির্বাচন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ইন্দিরা, যাকে তিনি ‘স্বল্পস্থায়ী পর্যায়’ বলে দেখেছিলেন।

কংগ্রেসের সামনে কী শিক্ষা

ইন্দিরার সাহসী কিন্তু জুয়ার স্বভাব কংগ্রেসকে একসময় শক্তি দিয়েছিল, আবার একই সঙ্গে দলীয় গণতন্ত্র ক্ষয় করেছে। আজ কংগ্রেস যদি তার কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে নতুন ধারণা ও নেতৃত্ব তুলে আনতে পারে, তবেই ইন্দিরার দৃঢ়তার ইতিবাচক দিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।

ইতিহাসের সতর্কবার্তা

ইন্দিরা একাই জরুরি অবস্থা আনেননি; সমগ্র রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির নিয়ম-উপেক্ষা ও ক্ষমতালোভ এতে ভূমিকা রেখেছিল। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর জন্য মূল পাঠ হলো—গণতান্ত্রিক নিয়ম ও সংযম উপেক্ষা করলে বড় বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।

জরুরি অবস্থার পঞ্চাশ বছর পরও ইন্দিরা গান্ধীর সময়ের সিদ্ধান্ত ও অভিজ্ঞতা ভারতীয় রাজনীতির পথচলায় দাগ কেটে আছে। প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য, দলীয় গণতন্ত্র ও শক্তিশালী-নেতা সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার উপযুক্ত সময় এটাই—যাতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যায়।