অলৌকিক রক্ষার ঘটনা: ফারাহ খাতরি
উত্তর মুম্বাইয়ে গাছ লাগানোর সময় একটি ‘এস’-আকৃতির আঁশযুক্ত ভাইপার সাপ ফারাহ খাতরিকে কামড়ায়। তিনি বেঁচে যান—এ যেন এক অলৌকিক ঘটনা। শহরের ভেতরে থাকার কারণে কাছেই ছিল সরকারি হাসপাতাল। সঙ্গে থাকা এক সঙ্গীর গাড়িতে দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারতেন, কিন্তু ভয়াবহ যানজটে পড়েন। এমন সময় ঠিক সেই হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়ে, যার পেছনে গাড়ি রেখে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু ভাগ্য আরও একবার বিপর্যয়ের মুখে পড়ে—হাসপাতালে ভেন্টিলেটর ছিল না, যা বিষাক্ত সাপের কামড়ের চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবশেষে একজন সাহসী অ্যাম্বুলেন্স চালক তাকে ২৪ কিমি দূরের একটি হাসপাতালে পৌঁছে দেন, যেখানে অ্যান্টিভেনম ও ভেন্টিলেটর দুটোই ছিল। “এটা এক অলৌকিক ঘটনা বলেই আমি বিশ্বাস করি,” বলেন ফারাহ।
বিশ্বে অবহেলিত একটি মৃত্যু কারণ
বিশ্বজুড়ে সাপের কামড়ে প্রতিবছর মারা যায় আনুমানিক ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ এবং স্থায়ীভাবে অক্ষম হয় প্রায় ৪ লাখ মানুষ। প্রায় ৫৪ লাখ মানুষ প্রতিবছর সাপের কামড়ের শিকার হন, যার এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক বিষাক্ত সাপের কামড়। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ—ভারত। যদিও সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা বছরে মাত্র ২ হাজার মৃত্যুর কথা বলে, ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেই স্বীকার করেছে সরকারি তথ্য ও বাস্তব জরিপে ‘বিরাট ফারাক’ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ সাপের কামড় এবং ৪০ শতাংশ মৃত্যু ঘটে ভারতে।
বর্ষাকালে পরিস্থিতির চরম অবনতি
ভারতে বর্ষাকাল (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) সাপের কামড়ের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। বৃষ্টিতে সাপেরা গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে, কারণ তারা ইঁদুরের খোঁজে থাকে—যারা আবার ধান, খাবার ও আবর্জনার কারণে মানুষ ঘিরেই থাকে। ফলে মানুষ ও সাপের সংঘর্ষ বাড়ে। ভারতের সবচেয়ে ভয়ংকর চার সাপ—কোবরা, কমন ক্রাইট, রাসেল ভাইপার এবং স-স্কেলড ভাইপার (যেটি ফারাহ খাতরিকে কামড়েছিল)। এই চারটিই ৯০ শতাংশ বিষাক্ত কামড়ের জন্য দায়ী।
কেন এই সমস্যা উপেক্ষিত?
এই সমস্যা অবহেলিত থাকার পেছনে দুটি প্রধান কারণ আছে। প্রথমত, এটি ম্যালেরিয়া বা এইচআইভি’র মতো ‘আকর্ষণীয়’ ট্রপিকাল রোগ নয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে মনোযোগ পায়। দ্বিতীয়ত, এটি মূলত দরিদ্র অঞ্চলের গরিব মানুষের সমস্যা। মধ্য ভারতের চিকিৎসক ও গ্লোবাল টাস্কফোর্সের সদস্য যোগেশ জৈন বলেন, “যদি এটা ডেঙ্গু বা এইচআইভি’র মতো কিছু হতো, তাহলে অনেক আগেই বিশ্বজুড়ে মনোযোগ পেত।”
প্রথাগত চিকিৎসার ফাঁদে গ্রামবাসী
অনেক গ্রামবাসী চিকিৎসার জন্য ঝাড়ফুঁক বা অশিক্ষিত ওঝাদের শরণাপন্ন হন, কারণ তারা সহজে পাওয়া যায় এবং ব্যয় কম। এই প্রবণতা প্রাণহানির হার বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও, সাপের কামড়ের জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনম এখনো ১৯শ শতকের পুরনো প্রযুক্তিতে তৈরি। যদিও গবেষকরা এখন আরও কার্যকর অ্যান্টিবডিভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি খুঁজছেন, সমস্যার মূলে রয়েছে—সঠিক চিকিৎসা মানুষের নাগালে না থাকা।
ব্যয়বহুল ও সীমিত উৎপাদন
অ্যান্টিভেনম তৈরি হয় নির্দিষ্ট প্রজাতির সাপ অনুযায়ী। তাই এতে বড় পরিসরে উৎপাদনের সুবিধা থাকে না। ডেভিড লাল্লু (লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন) জানিয়েছেন, অ্যান্টিভেনমের একটি শিশির দাম পড়ে ১২ থেকে ৩০০ ডলার পর্যন্ত, যেখানে অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ওষুধের দাম মাত্র ১ ডলার। ভারতের বড় শহরগুলোতেও সাপের কামড়ের চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবস্থা নেই, গ্রামাঞ্চলের কথা তো বলাই বাহুল্য।
সরকার সক্রিয় হচ্ছে
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এখন সাপের কামড়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। ২০২৪ সালে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। প্রথম পদক্ষেপ—নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ। রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সাপের কামড়কে ‘ঘোষণাযোগ্য রোগ’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে, যেন তা প্লেগ বা কলেরার মতো গুরুত্ব পায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে বাজেট বরাদ্দে সাহায্য হবে। সরকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগও নিয়েছে।
প্রতিরোধমূলক সহজ উদ্যোগেই বড় সাফল্য
সাপের কামড় এড়াতে কিছু ছোট পদক্ষেপ অনেক বড় উপকারে আসতে পারে—
- ধান বা খাদ্যদ্রব্য ঘরের বাইরে সংরক্ষণ করা
- কৃষিকাজের সময়সূচি এমনভাবে নির্ধারণ করা, যেন তা সাপের সক্রিয় সময়ের সঙ্গে মিলে না যায়
- গ্রামবাসীদের মেঝের পরিবর্তে উঁচু খাটে ঘুমানো
- সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর একটি সমাধান—জুতা পরা!
ড. লাল্লু বলেন, “যদি বিশ্বজুড়ে সব গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে শুধু জুতা পরা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সাপের কামড়ের হার ৯০ শতাংশ কমে যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখনো এমন সহজ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।”
ভারতে সাপের কামড়ে মৃত্যু একটি নীরব মহামারী, যা বর্ষা এলেই নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এটি মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যা হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত থেকেছে। এখন সময় হয়েছে, এই প্রাণঘাতী কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য সংকটের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার। মানুষকে সুরক্ষা দিতে হলে শুধু ওষুধ নয়, প্রয়োজন সচেতনতা, স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।