ইরান সংঘাত বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে কি প্রভাব ফেলবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন বেশ কঠিন, বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। পরিস্থিতি এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে, অনেক কিছু নির্ভর করছে ইরান পাল্টা হামলা চালাবে কি না, না কি শান্তির জন্য উদ্যোগ নেবে তার ওপর।
তবুও কিছু বিষয় আছে যা এই যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের শক্তি বাড়বে না কমবে তা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থেমে যাবে কি না, যুদ্ধ তাদের শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করবে কি না, নতুন সরকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কম বৈরী হবে কি না, কিংবা দেশটি বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হবে কি না—এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসছে।
আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—যুক্তরাষ্ট্র কি এই সংঘাতে তার ভূমিকা সীমিত রাখতে পারবে, না কি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে, এবং বিশ্ব কি এই যুদ্ধকে একটি উগ্র সিদ্ধান্ত বলে মনে করবে। পাশাপাশি, যদি ইসরায়েল গাজায় আরও অনেক মানুষ হত্যা করে এবং বিশ্ব তখন ইরানে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখে, তবে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে এই সহিংসতার জন্য দায়ী করতে পারে।
তেল মূল্যের বিষয়টিও গুরুতর। ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানে প্রথম হামলা চালানোর পর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম প্রায় ১১ শতাংশ বেড়েছে। যদি শিপিং বা পাইপলাইনের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, দাম আরও বাড়তে পারে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাইরের কোন পক্ষ যদি এই সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখে, তাহলে তারা রাজনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হতে পারে।
ট্রাম্পের ভারসাম্যের খেলা
যুক্তরাষ্ট্রের লাভ কিংবা ক্ষতি অনেকটাই নির্ভর করছে ইরান পরিস্থিতির ওপর। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক বড় সাফল্য হবে এবং তাদের বিশ্বশক্তির ভাবমূর্তি দৃঢ় করবে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের পারমাণবিক হুমকি এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি।
ট্রাম্পের অনেক রিপাবলিকান সমর্থক, উপসাগরীয় মিত্র এবং ইউরোপের কিছু নেতা উদ্বিগ্ন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। কিন্তু যদি ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক হুমকি দূর করতে পারেন এবং দীর্ঘ যুদ্ধ এড়াতে পারেন, তাহলে এই সংশয়গুলো মুছে যাবে।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তার মনোযোগ মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের দিকে ফিরিয়ে নিতে পারবে, যা তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। Center for a New American Security-এর রিচার্ড ফন্টেইন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তখন তার সামরিক স্ট্রাইক গ্রুপগুলো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করতে পারবে।
যদি এই সংঘাতের মাধ্যমে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই’র নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়, তাহলে তার পরিণতি অনিশ্চিত। নতুন সরকার ওয়াশিংটনের প্রতি কম বৈরী হতে পারে, আবার একই রকম শত্রুভাবাপন্নও হতে পারে। আর যদি ইরান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও বিরোধী উভয় পক্ষই দায় চাপাবে তাদের ওপর, যে তারা এই অঞ্চলে আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি ‘চিরস্থায়ী’ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাদের অবস্থান আরও দুর্বল হবে। চ্যাথাম হাউজ-এর রবিন নিবলেট বলেন, “ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করেছিল, কিন্তু এতে তাদের ক্ষমতা বাড়েনি, বরং কমেছে।”
তেলের দাম যদি হঠাৎ বেড়ে যায়, বিশেষ করে যদি ইরান হরমুজ প্রণালী দিয়ে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্ষতি হতে পারে। যদিও উচ্চতর তেলের দামে আমেরিকান কোম্পানিগুলো লাভবান হবে, কিন্তু সাধারণ ভোটাররা পেট্রলের উচ্চ মূল্যে ক্ষুব্ধ হবেন।
উপদ্রবের অক্ষরেখা
ইরান এমন একটি গোষ্ঠীর অংশ যাকে রিচার্ড ফন্টেইন “উপদ্রবের অক্ষরেখা” বলেছেন। এই গোষ্ঠীতে রয়েছে রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া। যদিও এরা কোনও আনুষ্ঠানিক জোট নয়, তবুও তেহরান, বেইজিং ও পিয়ংইয়ং মস্কোকে ইউক্রেন যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
রাশিয়া ও চীন চাইবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ হোক। তারা ২০১৫ সালের চুক্তির স্বাক্ষরকারী ছিল, যা ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমে সীমা টেনেছিল। তবে তারা খুশি হবে না যদি নতুন ইরানি সরকার তাদের থেকে দূরে সরে যায়।
এই পরিস্থিতি মস্কোর জন্য বিশেষভাবে খারাপ হবে, কারণ তারা জানুয়ারিতে ইরানের সঙ্গে ২০ বছরের কৌশলগত চুক্তি করেছিল। যদি রাশিয়া সিরিয়ার বাশার আল-আসাদকে রক্ষা করতে না পারার পর এবার যদি খামেনেই সরকারকেও রক্ষা করতে না পারে, তাহলে তাদের অবস্থান দুর্বল দেখাবে।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই ইরান সংঘাত ইউক্রেন যুদ্ধে কী প্রভাব ফেলবে। তারা ড্রোনের একটি উৎস হারাতে পারে, তবে যদি তেলের দাম বেশি থাকে, তাহলে মস্কো আরও অর্থ সংগ্রহ করে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। আর যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তারা ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে আরও অনীহা প্রকাশ করতে পারে।
একটি অজানা সম্ভাবনা হলো, মস্কো কি এই শেষ মুহূর্তে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে একটি চুক্তি করিয়ে দিতে পারে কি না। ট্রাম্প আক্রমণের আগে এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ইনস্টিট্যু মনটেইনের মিশেল ডুকলো বলেন, এর বিনিময়ে রাশিয়া ট্রাম্পকে ইউক্রেনকে দেওয়া মার্কিন সহায়তা আরও কমাতে রাজি করাতে পারে।
চীনের জন্য উচ্চ তেলের দাম খারাপ খবর, কারণ তারা তেল আমদানি করে। আবার তেহরানে সরকার পরিবর্তন হলে তারা এই অঞ্চলে একজন গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকে হারাবে। কিন্তু যদি যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে আটকে পড়ে, তাহলে চীন লাভবান হবে। ইরাক আক্রমণের পর বেইজিং তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি বাড়াতে পেরেছিল। চীন এই সুযোগে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে বোঝাতে চাইবে যে, তারা একটি দায়িত্বশীল দেশ, আর যুক্তরাষ্ট্র একটি আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি—ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধই সেই বিবরণকে আরও জোরদার করছে।
ইউরোপের ঝুঁকি
যদি এই সংঘাত আরও বেড়ে যায়, তাহলে ইউরোপের ক্ষতির আশঙ্কাও বাড়বে। তারা একটি বড় তেল আমদানিকারক অঞ্চল হওয়ায়, তেলের দামের ধাক্কা সরাসরি তাদের উপর পড়বে। আর যদি ইরান বিশৃঙ্খলায় পড়ে, তাহলে নতুন করে শরণার্থী স্রোত শুরু হতে পারে, যা ইউরোপে দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থান আরও বাড়িয়ে তুলবে। ইরানের জনসংখ্যা ৯২ মিলিয়ন, যা সিরিয়ার চার গুণ, অথচ সিরিয়ার শরণার্থী সংকট ২০১৫ সালে ইউরোপে বিশাল রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করেছিল।
ইউরোপের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, ইরান সংকট যদি রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা করে। তবে বিপরীতভাবে, যদি ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কোনও চুক্তি করিয়ে দিতে পারে, তাহলে তারা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। যদিও ট্রাম্প এই সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দেননি।
এতো গেলো ‘পরিচিত অজানা’ বিষয়গুলো। তবে রয়েছে আরও কিছু ‘অপরিচিত অজানা’ বিষয়—যেগুলো কারও নজরেই নেই এখনো। এই সবগুলো কিভাবে সামনে আসে তার উপর নির্ভর করছে, ইরান সংকট কি যুক্তরাষ্ট্রকে আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসবে, না কি বিশ্বভারসাম্য চীনের দিকে আরও ঝুঁকে পড়বে।
প্রাসঙ্গিক খবর
জুন ২১ তারিখ রাতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে এবং আরও ভয়াবহ হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যদি তেহরান শান্তিচুক্তিতে না আসে।
টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে ট্রাম্প বলেন, “এই হামলাগুলো সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত সফল ছিল। ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।”
তাসনিম সংবাদ সংস্থার বরাতে এক ইরানি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফোরদো স্থাপনাগুলোর একটি অংশে ‘শত্রু বিমান হামলা’ হয়েছে। তবে ক্বোমের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ মানান রাইসি বলেন, স্থাপনাটি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
ইরানের পারমাণবিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হামলার পর কোনো তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ মেলেনি এবং আশপাশের বাসিন্দাদের জন্য কোনও বিপদের আশঙ্কাও নেই।
লেখক পরিচিতি:
হিউগো ডিকসন রয়টার্স ব্রেকিংভিউজ-এর প্রধান বিশ্লেষক। তিনি ব্রেকিংভিউজ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর লেক্স কলামের সম্পাদক ছিলেন।