রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা হামলা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বৈশ্বিক ভূরাজনীতি এবং ভারতের তাৎক্ষণিক ও মধ্যমেয়াদী স্বার্থের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে। তবে আপাতত, এটি মনে হচ্ছে না যে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের এই ইরান আক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে। এর ফলে ইরান পুরোপুরি পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে বাধ্য হবে বা তেহরানে ইসলামি শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়বে—এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
বরং, একটি গুরুতরভাবে দুর্বল হয়ে পড়া ইরানি শাসনব্যবস্থা সামরিক ও ‘গ্রে-জোন’ কৌশল অবলম্বন করতে পারে, যা এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। উপরন্তু, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই এই যুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো শেষ লক্ষ্য বা পরিণতির কৌশল রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
এই চলমান যুদ্ধের কমপক্ষে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে।
প্রথমত, পশ্চিম এশিয়া সম্ভবত আবারও এক বিশৃঙ্খলা, সংঘাত ও অনিশ্চয়তার যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে—অন্তত কিছু সময়ের জন্য। ইরানের সঙ্গে যদিও বহু প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত, তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত—ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ এবং ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে অংশ নেওয়া—এখন তেল আবিবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আঞ্চলিক প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলবে।
ইরান ও তার শাসনব্যবস্থা পশ্চিম এশিয়ার সুন্নি প্রধান দেশগুলোতে জনপ্রিয় না হলেও, ইসরায়েলও খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়—বিশেষত গাজায় তাদের কার্যক্রম এবং সেখানে চলমান মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়া ও চীন অঞ্চলে নিজেদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব আরও জোরদার করতে চাইবে। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে একটুও দেরি করবে না। এর ফলে এই অঞ্চলের শক্তির ভারসাম্য আরও জটিল ও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে।
দ্বিতীয়ত, এই হামলা বিশ্ব রাজনীতির বিদ্যমান বিভাজনকে আরও গভীর করবে এবং ভূরাজনৈতিক ফাটলরেখাগুলোকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল হয়তো সঙ্গে সঙ্গে কিছু সামরিক সাফল্য অর্জন করবে, কিন্তু বহু দেশ এতে অসন্তুষ্ট হবে। নিজেদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান হুমকির মুখে পড়ে তারা এই অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল প্রভাবকে হ্রাস করার প্রচেষ্টা নিতে পারে।
বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধভুক্ত বহু দেশ (গ্লোবাল সাউথ) যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এই একতরফা পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে।
এদিকে, চীন এই উদ্ভূত আঞ্চলিক বিভাজনকে কাজে লাগাতে চাইবে। মস্কো—যে পশ্চিম এশিয়ায় সিরিয়ার আসাদ সরকারের পতনের ফলে আগের প্রভাব হারিয়েছে—এই নতুন যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আবার তার হারানো প্রভাব ফিরে পেতে চাইবে। এটি তাদের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ হতে পারে।
বিষয়টি লক্ষ্য করার মতো যে, ইউরোপ এখন পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে নীরব থেকেছে। কিন্তু তারা অবশ্যই এই প্রশ্ন তুলবে—যুক্তরাষ্ট্র, যারা ন্যাটো সহযোগীদেরকে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বহনের কথা বলেছিল এবং ইউক্রেনকে কার্যত পরিত্যাগ করেছিল, যার ফলে ইউরোপ আরও অনিরাপদ হয়ে পড়ে, তারা কিভাবে এত দূরের একটি দেশে আবার সামরিক অভিযান চালাতে পারে?
স্পষ্টতই, ট্রাম্প ইসরায়েলকে ন্যাটোর ওপর অগ্রাধিকার দিচ্ছেন—এই কঠিন বাস্তবতা ইউরোপের কাছ থেকে অদৃষ্টির মতো হারিয়ে যাবে না।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এই হামলা কোনোভাবেই বৈধ নয়। ফলে এর ফলে জাতিসংঘের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক আইনের প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্রদের জন্য এটি একটি গুরুতর কূটনৈতিক বিপাকে পরিণত হবে। তারা একদিকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চায়, অন্যদিকে হামলাটি নিন্দা করলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও অবনতি ঘটতে পারে। আর নিন্দা না করলে এ অবৈধ আগ্রাসনের প্রতি মৌন সমর্থন দেওয়া হয়েছে—এমন ভাবমূর্তি তৈরি হতে পারে।
এছাড়া, যদি তারা যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের বিরোধিতা না করে, তবে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের নৈতিক সমালোচনা করার ন্যায্যতা অনেকটাই হারাবে। এই পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে যদি মনে রাখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র অনেক পশ্চিমা দেশ জেনেভায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে শান্তি আলোচনায় যুক্ত ছিলেন। অথচ, ট্রাম্প এই কূটনৈতিক উদ্যোগকে উপেক্ষা করে সরাসরি হামলা চালিয়েছেন—ফলে পশ্চিমা জোট তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে।
চতুর্থত, পশ্চিম এশিয়ার এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে।
এই পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখনো রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার সাফল্য ক্রমশ বাড়ছে, এবং মস্কো কিয়েভের সঙ্গে কোনো যুদ্ধবিরতির আলোচনায় উৎসাহী নয়। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের ফোকাস সরিয়ে নেওয়া ইউক্রেনকে আরও দুর্বল করে তুলবে।
পঞ্চমত, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখার এই সামরিক প্রচেষ্টা উল্টো ফল দিতে পারে।
বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু দেশ এই উদাহরণ দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে যে, পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনই দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তার একমাত্র গ্যারান্টি। কারণ পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো অন্যদের তুলনায় অনেক কম ঝুঁকির মুখে পড়ে।
ইউক্রেন তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছিল—ফলাফল অত্যন্ত নেতিবাচক। ইরান চেষ্টা করেও পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারেনি—এখন যুদ্ধের শিকার। অন্যদিকে, ইসরায়েল গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি গড়ে তুলেছে, উত্তর কোরিয়া অভ্যন্তরীণ ভোগান্তি সত্ত্বেও পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে, আর ভারত ও পাকিস্তান মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও চাপ সত্ত্বেও পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
এই বার্তাগুলো বিশ্বের যে কোনও পারমাণবিক অস্ত্রপ্রত্যাশী রাষ্ট্রের কাছে খুবই স্পষ্ট—আত্মরক্ষার জন্য পারমাণবিক অস্ত্রই চূড়ান্ত হাতিয়ার।
অবশেষে, ভারতের জন্য এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দীর্ঘমেয়াদী কৌশল বাস্তবায়নে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।
জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ অঞ্চলে কৌশলগত বিভাজন তীব্রতর হবে, যা ভারতের জন্য ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন করে তুলবে।
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বা দীর্ঘস্থায়ী হলে, ওই অঞ্চলে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। একই সঙ্গে প্রবাসী আয়ের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে, যা ভারতের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো—ইরান কেন্দ্রিক ভারতের বহু প্রতীক্ষিত প্রকল্প, যেমন ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডোর (IMEC) এবং চাবাহার বন্দর প্রকল্প, তা অন্তত এখনই থেমে যেতে পারে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যে সংযোগ স্থাপনের কৌশল নিয়েছিল, তা এই যুদ্ধের ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।
হ্যাপিমন জ্যাকব জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পড়ান এবং ‘ইন্ডিয়াস ওয়ার্ল্ড’ সাময়িকীর সম্পাদক।