আশা আর আস্থার সংকটে ঢাকার শেয়ারবাজার
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হওয়ার কথা থাকলেও দেশের শেয়ারবাজার বা পুঁজিবাজার বছরের পর বছর ধরে আস্থার সংকটে ভুগছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানো, নিয়মনীতির দুর্বল প্রয়োগ, অপারদর্শী লেনদেন এবং কাঠামোগত দুর্বলতা পুঁজিবাজারকে বারবার সংকটে ফেলেছে। ২০১০-১১ সালের ধসের ক্ষত এখনও সম্পূর্ণ শুকায়নি; এর মাঝে ছোট-বড় বহু ধস আর পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা দেখা গেছে, কিন্তু মূল সমস্যাগুলো থেকে যায় বহাল তবিয়তে।
কোথায় রয়েছে সংকটের শেকড়?
নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) বহু সংস্কার প্রক্রিয়া নিলেও বাস্তবায়নে পিছিয়ে আছে। প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, জনবল এবং আইনি কাঠামোতে সীমাবদ্ধতা থাকার ফলে তারা বাজার কারসাজি ও তথ্য গোপনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে না।
তথ্যপ্রবাহে অসামঞ্জস্য ও কারসাজি
তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানিই সময়মতো নির্ভরযোগ্য আর্থিক প্রতিবেদন দেয় না। শেয়ারপ্রদানে অস্বচ্ছতা, গুজব নির্ভর লেনদেন এবং অভ্যন্তরীণ তথ্য ফাঁস করে কারসাজি চালানোর ঘটনা বিনিয়োগকারীদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে।
বাজারের গভীরতা ও তরলতার অভাব
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। প্রতিদিনের লেনদেনেও পরিমাণগত ঘাটতি থাকে, যা বাজারকে অস্থির করে তোলে। আর্থিক সংকটে অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে যান, ফলে তরলতা আরও কমে যায়।
মার্জিন লোনে ঝুঁকি বৃদ্ধি
অনেক ব্রোকার হাউজ মার্জিন ঋণের অপব্যবহার করে বিনিয়োগকারীদের অতিরিক্ত ঝুঁকিতে ফেলেছে। এর ফলে বাজারে মাত্রাতিরিক্ত লিভারেজ সৃষ্টি হয়, যা পতনের সময় ক্ষতির মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অনুপস্থিতি
বিদেশি ও দেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। পেনশন ফান্ড, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নীতিগত সহায়তা কম থাকায় বাজারে স্থায়িত্ব আসছে না।
ধসের পরিণতি: আস্থাহীনতা ও আর্থিক ক্ষতি
২০১০-১১ সালের ধসের সময় লক্ষাধিক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সবকিছু হারিয়েছেন। সে সময় শেয়ারমূল্য ৬০–৭০ শতাংশ পর্যন্ত পড়ে যায়। সেই ক্ষতির প্রতিকার এখনও পুরোপুরি হয়নি। এর বাইরে প্রায় প্রতিবারই বড় পতনের সময় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাকবচ না থাকায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
উত্তরণের পথ: কী করা দরকার?
নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর আধুনিকীকরণ
BSEC-এর মনিটরিং সিস্টেমকে স্বয়ংক্রিয় করতে হবে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর নজরদারি সিস্টেম ও রিয়েল টাইম অ্যানালিটিক্স প্ল্যাটফর্ম চালু করা দরকার।
তথ্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে। একইসাথে ফাঁস হওয়া তথ্যের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
মার্জিন ঋণের কড়াকড়ি
মার্জিন লোনের সীমা নির্ধারণ করে লিভারেজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নির্দিষ্ট ঝুঁকির বাইরে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্ক সংকেত বা লেনদেন স্থগিত হওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে উৎসাহ
পেনশন, ইনস্যুরেন্স এবং সরকারি বন্ডধারী প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে নীতিগত প্রণোদনা দিতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে তথ্যসেবা ও নিরাপত্তা কাঠামো জোরদার করা জরুরি।
নতুন IPO সংস্কার
IPO অনুমোদনের ক্ষেত্রে বাস্তব অর্থে কার্যকর ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, ট্যাক্স ফাইল, এবং কোম্পানির সুশাসন প্রমাণে কড়া যাচাই-বাছাই চালু করা প্রয়োজন।
CMSF-এর কার্যকর ব্যবহার
Capital Market Stabilization Fund (CMSF) নামে যে তহবিল তৈরি করা হয়েছে, তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা যেতে পারে। এ তহবিল হতে বিপর্যয়কালে বাজারে তরলতা জোগানো সম্ভব।
একটি শক্তিশালী বাজারের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি
বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই বড় হচ্ছে, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে পুঁজিবাজার গড়ে ওঠেনি। ব্যাংকনির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হয়ে শেয়ারবাজারনির্ভর মূলধন সংগ্রহের দিকে যেতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নিয়ন্ত্রকের দৃঢ়তা, এবং বিনিয়োগকারীর আস্থা—এই তিনটি স্তম্ভকে শক্তিশালী করতে হবে। নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়োগে পরিবর্তন আনলেই, পুঁজিবাজার দেশের মূলধন বাজারের প্রকৃত চালিকা শক্তিতে রূপ নিতে পারে।
শেয়ারবাজার শুধু জুয়া নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতিচ্ছবি। সঠিক নীতি, নিয়ন্ত্রণ এবং পেশাদার ব্যবস্থাপনা থাকলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারও হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান বাজার।