আঙ্গোলার আটলান্টিক উপকূল থেকে মধ্য আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত লোবিটো করিডর এখন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ খনিজের জন্য নতুন প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে—এবং এটি একটি পরীক্ষা, পশ্চিমা শক্তি এই মহাদেশে চীনের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারে কি না।
আঙ্গোলা ও ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর (ডিআরসি) সীমান্তবর্তী ধুলোবালির শহর লুয়াউয়ের ট্রেন স্টেশনে যাত্রীরা আতঙ্কে ঠেলাঠেলি করছে, মেঘে ঢাকা আকাশে ঝড়ের পূর্বাভাস স্পষ্ট। কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে। মাত্র দুটি ছোট কামরা বিশিষ্ট ট্রেনটি শত শত যাত্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যারা উঠতে পারবে না, তাদের কয়েক দিন পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পুলিশ ও রেলকর্মীরা নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঝড় নামার সঙ্গে সঙ্গেই বড় বড় উষ্ণ বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করলে সব শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।
ভিড় তীব্র হয়ে ওঠে। সবাই নিজের ব্যাগ আঁকড়ে ধরে দরজার দিকে ধাক্কা দেয়। কিছু আসন দ্রুত পূর্ণ হয়ে যায়, তারপর যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকার প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা দখল করে ফেলে। প্রায় ছয় বছরের এক ছেলেকে খুব ছোট জানালা দিয়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ভেতরে থাকা অপরিচিতরা তাকে নামিয়ে নেন। মায়েরা কোলে বাচ্চাদের প্যাড বদলায়। মুরগি ডাকাডাকি করে, আর স্ন্যাকস-ড্রিঙ্কস বিক্রেতারা মানুষের গাদাগাদির মধ্যে দিয়ে গলে যায়। গরমে দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা।
এটাই লোবিটো আটলান্টিক রেলওয়ে। যদিও এটা তেমন মনে না হতে পারে, এই পুরনো কিন্তু বিপর্যস্ত রেললাইনই এখন বিশ্বের সবুজ শক্তি রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ খনিজের নতুন প্রধান ক্ষেত্র। ১৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ আঙ্গোলার আটলান্টিক বন্দর লোবিটোকে মধ্য আফ্রিকার কপারবেল্ট—ডিআরসি এবং জাম্বিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে।
গত এক দশক ধরে এটি একটি চীনা কোম্পানি সীমিত ক্ষমতায় চালিয়েছে। এখন একটি মার্কিন-সমর্থিত কনসোর্টিয়াম এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং বিপুল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি আফ্রিকায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সফল হলে এই লোবিটো করিডর শুধু পশ্চিমের জন্য কোবাল্ট ও কপারসহ নানা খনিজ সহজে সরবরাহই করবে না, বরং সাধারণ আঙ্গোলাবাসীর জীবনও পাল্টে দিতে পারে এবং আফ্রিকায় পশ্চিমা বিনিয়োগের নতুন নকশা তৈরি করবে।
“এটি বাকি বিশ্বের জন্য একটি মানদণ্ড স্থাপন করবে,” ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের লোবিটো সফরে বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন—প্রায় এক দশকে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের আফ্রিকা সফরের ঘটনা। “আমরা এমন এক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে আছি, যেখানে আগামী কয়েক বছরের কর্মকাণ্ড আগামী ছয়-সাত-আট দশককে প্রভাবিত করবে—এবং আমি মনে করি এটি সেই ধরনের একটি মাইলফলক।”
তবুও সবাই এতে আস্থা রাখছে না। সমালোচকরা বলছেন, এই উদ্যোগ এসেছে এক দশক দেরিতে, যখন আফ্রিকার বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রিজার্ভ ইতিমধ্যে চীনের নিয়ন্ত্রণে। আর এই প্রকল্পের কেন্দ্রে থাকা সুইস কোম্পানিটি আগেও আঙ্গোলাসহ বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের কতটুকু পৌঁছাবে করিডরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে।
বিশ শতকের শুরুতে নির্মিত এই রেলপথ একসময় আঙ্গোলার সবচেয়ে বড় নিয়োগকারী ছিল। প্রতিবছর লাখ লাখ টন কার্গো অভ্যন্তর থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু কয়েক দশকের গৃহযুদ্ধের সময়—যা আংশিকভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর দ্বারা উসকে দেওয়া—রেলপথ ধ্বংস হয়ে যায়। ২০০২ সালে শান্তি ঘোষণার সময় রুটজুড়ে ছিল হাজার হাজার ল্যান্ডমাইন, চালু ছিল মাত্র ৩৪ কিলোমিটার।
যুদ্ধের পর চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ২ বিলিয়ন ডলারের তেল-বিনিময়-পরিকাঠামো চুক্তিতে রেলপথটি পুনর্নির্মাণ করে। ২০১৫ সালে এটি পুনরায় চালু হলে বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বলা হয়, বছরে দুই কোটি টন কার্গো ও ৪০ লাখ যাত্রী বহন করবে। কিন্তু এক দশক পরও বাস্তবতা সেই লক্ষ্যের ধারে-কাছেও নেই।
অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর হেইতর কার্ভালো বলেন, “দুটি জিনিস এটিকে আটকে রেখেছে: অবকাঠামো আর নিরাপত্তা।” যথেষ্ট কামরা, ওয়াগন বা লোকোমোটিভ নেই। যেখানে ট্রেন বিপরীত দিকের ট্রেনকে পার হতে দেয়, সেই ক্রসিংগুলো খুব ছোট। কিছু সেতু নিরাপদ কি না, তা নিয়েও শঙ্কা। ৬৭টি স্টেশনের অনেকগুলোই প্রায় ফাঁকা খোলস মাত্র। নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে ট্রেন চালকরা খুব ধীরে চলেন, কারণ লাইন থেকে লোহার অংশ চুরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। (গত আগস্টে মক্সিকো প্রদেশে সালফারবোঝাই ট্রেন লাইনচ্যুত হয়।)
বর্তমানে সপ্তাহে এক-দুটি খনিজবাহী ট্রেন লোবিটো বন্দরে পৌঁছায়।
লুয়াউ থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন পশ্চিমে ধীরে ধীরে এগোয়। প্রতিটি স্টেশনে স্থানীয় বাজার গজিয়ে ওঠে, বিক্রেতারা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ক্রেতাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়। ৫০ কোয়ানজা-য় একটি তাজা ডোনাট, ১০০ কোয়ানজা-য় চারটি বড় ভাজা শুঁয়োপোকার কাঠি বিক্রি হয়।
ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা মাটির কুঁড়েঘরের গ্রামগুলো দারিদ্র্যে ডুবে আছে, দেশের বিপুল তেলসম্পদ সত্ত্বেও তারা উপেক্ষিত। সর্বত্র যুদ্ধের চিহ্ন: ছাদহীন বাড়ি, বুলেটের ছিদ্রে ভরা দেয়াল, বেঁকে যাওয়া রেললাইন, উল্টে পড়া লোকোমোটিভ, মরিচা ধরা ট্যাংক। যুদ্ধের সময় এরা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিছুদিন আগেও লুয়াউ থেকে রাজধানী পর্যন্ত রাস্তায় যেতে এক সপ্তাহ লেগে যেত, বিধ্বস্ত সড়কে ল্যান্ডমাইনের ঝুঁকি নিয়েই।
২০২৩ সালে সরকার একটি মার্কিন ও ইইউ-সমর্থিত কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি এসেছে, যা ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। রেললাইন উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন শাখা লাইন, জাম্বিয়ায় সংযোগ—সবই অন্তর্ভুক্ত।
“আমরা শুধু রেললাইন তৈরি করছি না—আমরা সাধারণ মানুষের জন্য ভালো ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন করছি,” বলেন বাইডেন। “কৃষক আরও খাবার টেবিলে তুলতে পারবে, শ্রমিক নিরাপদ কাজ পাবে, উদ্যোক্তা নেতৃত্ব দিতে পারবে।”
তবে আফ্রিকায় বহিরাগতরা বহুবার রেললাইন বানিয়েছে, যা স্থানীয়দের উপকারের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ ও শোষণের হাতিয়ার হয়েছে। চীনা প্রকল্পগুলোর সমালোচনা হয়েছে বিদেশি শ্রমিক ব্যবহার, মানবাধিকার ও পরিবেশ উপেক্ষার জন্য। ঋণের ফাঁদে ফেলে সরকারগুলোকে বেকায়দায় ফেলেছে। আঙ্গোলারই চীনের কাছে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে।
ওয়াশিংটন বলছে, এবার সব হবে ভিন্নভাবে। রেললাইন উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সবুজ প্রযুক্তি, মোবাইল নেটওয়ার্ক, কৃষি মান-শৃঙ্খলায় বিনিয়োগ হবে। খাদ্য নিরাপত্তা বাড়বে। “তারা বলেছে জনগণকে গুরুত্ব দেবে, আমরা তা মনিটর করবো,” বলেন মার্সেলিনো কিয়েনজে মাকোলে, আঙ্গোলা–ডিআরসি বাণিজ্য চেম্বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট। “জনগণের দারিদ্র্য দেখতে হবে, কিছু করতে হবে।”
মাকোলে হুয়াম্বোতে ট্রেনের যাত্রাবিরতিতে এ কথা বলেন। তিনি লুবুম্বাশি থেকে লোবিটো পর্যন্ত ট্রেনে গিয়েছিলেন সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য। তিনি বলেন, “প্রথমেই অবকাঠামো দরকার। কোনো রাস্তা নেই—বিশেষ করে কৃষি সেবা রাস্তা।”
যদি প্রকল্প সফল হয়, কয়েক বিলিয়ন ডলারের খনিজ পণ্য যাবে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলগুলো পেরিয়ে। কিন্তু সেসব অঞ্চলের কৃষক যদি পণ্য স্টেশনে না পৌঁছাতে পারে, তারা উপকার পাবে না।
প্রফেসর কার্ভালো বলেন, “এই জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে, কিন্তু সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাজারে পণ্য পাঠানোর মতো রাস্তা নেই। বড় স্টেশনে বিনিয়োগ না করে ছোট স্টেশন ও কৃষি সংযোগ রাস্তা দরকার।” তিনি বলেন, “এ বিনিয়োগ স্থানীয় অর্থনীতি বদলাতে পারে। কিন্তু যা হচ্ছে, তা যথেষ্ট নয় এবং সঠিক উপায়ে হচ্ছে না।”
এছাড়া সুইস কোম্পানি ট্রাফিগুরার ভূমিকাও বিতর্কিত। ২০২৪ সালে দুর্নীতির দায়ে তাদের এক শীর্ষ কর্মকর্তা শাস্তি পেয়েছেন। আঙ্গোলার তেল আমদানি একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করে কয়েক মিলিয়ন ডলার ক্ষতি করেছিল তারা। আরেক মধ্যস্থতাকারী বর্তমানে ব্রাজিলে দুর্নীতির দায়ে ১০ বছরের জেল খাটছে।
“যখন ট্রাফিগুরা তেলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছিল, সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়নি,” বলেন সুইস সংস্থা পাবলিক আই-এর গবেষক আড্রিয়া বুদ্রি কারবো। “এখনও মনে হয় না কঙ্গোর খনিজ আঙ্গোলা দিয়ে গেলে আঙ্গোলার জনগণ উপকৃত হবে—বিশেষ করে ট্রাফিগুরা থাকলে। এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের শোষণ।”
লোবিটো রেলওয়েতে যাত্রা আঙ্গোলার বৈপরীত্যের জানালা। বনাঞ্চল থেকে তৃণভূমি, পাহাড়, মরুভূমি—দারিদ্র্য আর সম্পদের মিশ্র চিত্র। দশক ধরে তেল উৎপাদন সত্ত্বেও রাজধানী লুয়ান্ডাতেও চরম দারিদ্র্য।
যাত্রার শেষে লুয়েনায় ট্রেন থামলে অন্ধকার নামে। ক্লান্ত যাত্রীরা নামার সময় ডাকাত দলের হামলা হয়। চিৎকার-চেঁচামেচি। নিরাপত্তারক্ষীরা নির্লিপ্ত। শেষে সবাই ট্রেন ছেড়ে যায়—কেউ হোটেলে, কেউ স্টেশনের সিঁড়িতে শুয়ে পড়ে। সকালে আবার যাত্রা শুরু—এক প্রতিশ্রুতি আর অনিশ্চয়তায় ভরা দেশে।