“১৯৭৭-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমরা বুঝতেই পারিনি যে জনসমর্থন আমাদের দিকে রয়েছে। পরে যখন জগজীবন রাম, হেমবতী নন্দন বহুগুণা ও আবদুল্লাহ বুখারি আমাদের প্রচারে নামলেন, তারপর থেকে জোয়ার শুধু বাড়তেই থাকল।”
— কে. এন. গোবিন্দাচার্য, সাবেক আরএসএস বুদ্ধিজীবী
১৯৭০-এর দশকের গোড়ায় কে. এন. গোবিন্দাচার্য ছিলেন আরএসএস-এর পাটনা বিভাগ প্রচারক। ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে থেকে তিনি দেখেছিলেন কীভাবে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধি সরকার-বিরোধী ছাত্র বিক্ষোভ ধীরে ধীরে গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং শেষমেশ দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ৮২-বছর বয়সি এই সাবেক বিজেপি সাধারণ সম্পাদক এখন মূলত সামাজিক-পরিবেশগত কাজ করেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জরুরি অবস্থার দিনগুলো এবং জয়প্রকাশ নারায়ণের (জেপি) সঙ্গে তাঁর ওঠাবসার স্মৃতি তুলে ধরলেন।
প্রশ্ন : আপনি তখন বিহারে আরএসএস প্রচারক ছিলেন, যখন এবিভিপি ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ‘ছাত্র সংগ্রাম সমিতি’ রাজ্য-সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। সেই সময়ের কী স্মৃতি আছে?
উত্তর : ১৮ মার্চ ১৯৭৪-এ পাটনা বিধানসভার সামনে ছাত্ররা প্রবেশের চেষ্টা করলে গুলি চলে, আর প্রদেশ ও সার্চলাইট—আন্দোলনপন্থী দু’টি পত্রিকার কার্যালয়ে আগুন লাগে। সেদিনই আমার আর রামবাহাদুর রাই-এর নামে মিসা ওয়ারেন্ট জারি হয়। ১৯ মার্চ গোপনে জেপি-র সঙ্গে দেখা করি; ১৯৬৬-র খরার সময় তাঁর সঙ্গে ত্রাণকাজ করেছি। প্রথমে তিনি বললেন, ‘তোমরা তো উচ্ছৃঙ্খল, পত্রিকা পুড়িয়েছ।’ আমি জানালাম, ওই দুটি পত্রিকা-ই ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে লেখে… পরে স্থির হয় ২৭ মার্চ এক ছোট মিছিল হবে। সেদিন শিবানন্দ তেওয়ারি গ্রেফতার হন। জেপি ঘোষণা দিলেন, ২৯ মার্চের মধ্যে কারফিউ না উঠলে তিনি রাস্তায় নামবেন। একদিন আগেই কারফিউ উঠল। ৮ এপ্রিল গান্ধী ময়দানে জেপি বড় সমাবেশ করেন, সেখানে ‘ব্যবস্থা-পরিবর্তন’-এর ডাক দেন। এরপর চিকিৎসার জন্য ভেলোর চলে যান।
প্রশ্ন : জেপি-র অনুপস্থিতি কি আন্দোলনে প্রভাব ফেলেছিল? তিনি আবার কবে নেতৃত্বে ফেরেন?
উত্তর : ছাত্র আন্দোলন কিছু সংগঠনের সহায়তা পেলেও ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছিল। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই, বিরোধী বিধায়কদের পদত্যাগ করাতে হবে… এর মাঝে গয়া-র একটি বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে পুলিশ লাঠিচার্জ হয়। জেপি ঘোষণা করলেন, এই সরকার থাকতে পারে না, বিধানসভা ভেঙে দিতে হবে। ৮-৯ মে থেকে বিরোধী বিধায়কদের পদত্যাগ শুরু। জুনের শুরুতে চিকিৎসা শেষে জেপি ফেরেন। ৫ জুন ছাত্র সংগ্রাম সমিতির মিছিল ইন্দিরা ব্রিগেডের হামলায় পড়ে… সেই সমাবেশে জেপি স্লোগান দেন, “সম্পূর্ণ বিপ্লব এখনই শ্লোগান, ভবিষ্যতের ইতিহাস আমাদেরই।”
প্রশ্ন : কীভাবে এই আন্দোলন জাতীয় রূপ নিল?
উত্তর : ১৯৭৪-এর নভেম্বর-এ ইন্দিরা গান্ধি মন্তব্য করেন, ‘জেপি যদি এতই গণতন্ত্রী হন, আসন্ন নির্বাচনেই বোঝা যাবে কার পক্ষে জনসমর্থন।’ জেপি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ঘোষণা দিলেন, আন্দোলন সারাদেশে ছড়াবে।
প্রশ্ন : যেহেতু ইন্দিরা জি বলেছিলেন নির্বাচনেই জনপ্রিয়তা প্রমাণ হবে, তাহলে জরুরি অবস্থা জারি হল কেন? শুধু কি এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের প্রতিক্রিয়া?
উত্তর : না, তখন থেকেই তিনি সহনশীলতা হারাচ্ছিলেন। চন্দ্রশেখর-এর মতো ‘কংগ্রেস ইয়ং টার্ক’-রা চেয়েছিলেন ইন্দিরা জি ও জেপি আলাপ করুন, সমঝোতার পথ খুঁজুন… কিন্তু ওম মেহতা, আর. কে. ধাওয়ান, মাখনলাল ফোতেদের-এর মতো ঘনিষ্ঠ মহলের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। আদালতের ধাক্কার পর আচমকা বদল এল। শোনা গেল, কংগ্রেস সংসদীয় দলের বৈঠকে শক্তি প্রদর্শন হতে পারে—এই আশঙ্কায় তিনি দ্রুত অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারির পথে হাঁটেন।
প্রশ্ন : জরুরি অবস্থার প্রথম দিনটি আপনি কীভাবে দেখলেন?
উত্তর : ২৫ জুন ১৯৭৫, তখন বারাণসীতে ছিলাম; খবর পেলাম কিছু একটা হতে চলেছে। পাঞ্জাব মেল ধরে পাটনা ফিরি। ঠিক করি, আগে অবস্থা বুঝে নেব, আরএসএস কার্যালয়ে যাব না। এক ছাত্রকে পাঠিয়ে খবর নিই—পুলিশ ঘিরে রেখেছে, তল্লাশি চলছে… ১৯৭৪-এর বিহার আন্দোলন থেকে গোপনে কাজের কৌশল শিখেছিলাম। সেদিন রাতেই সিদ্ধান্ত হল, আমাদের শীর্ষ নেতারা কোথায় গা-ঢাকা দেবেন; গুরু-দক্ষিণায় সংগৃহীত অর্থ ব্যাংক ফ্রিজ হওয়ার আগে তুলে ফেলা আর দাতাদের তালিকা লুকিয়ে রাখা।
আমি পুরো জরুরি অবস্থা জুড়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকি; শেষ পর্যন্ত ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পর মাত্র এক দিন কারাবাস করি। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭-এ ভোট প্রচারে ভাগলপুর যাই। সভাস্থলে পুলিশ হানা দেয়—খবরে টিপ-অফ ছিল। গ্রেফতার হওয়ার কথা থাকলেও সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সংঘ খবর পায়, জামিনের আবেদন করে। পরদিন সকালে মুক্তি পাই।
প্রশ্ন : পুরো জরুরি অবস্থায় কীভাবে গ্রেফতার এড়ালেন?
উত্তর : কখনও এক জায়গায় এক সপ্তাহের বেশি থাকিনি। বিহার, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, মণিপুর সহ উত্তর-পূর্বের নানা জেলায় ঘুরেছি; সাধারণ কর্মীদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।
প্রশ্ন : ১৯৭৭-এর নির্বাচন ও জরুরি অবসানের অবসান নিয়ে আপনার স্মৃতি?
উত্তর : আমরা আরএসএস প্রান্ত প্রচারককে নিয়ে জেপি-র কাছে যাই। তিনি বলেন, ‘মিষ্টি আনো।’ বললাম, ‘আপনার ডায়াবেটিস, ডায়ালিসিস চলছে।’ উত্তর দিলেন, ‘সব ঠিক আছে।’ সেদিন তিনি মিষ্টি খেলেন।
অনেকে নির্বাচন লড়তে চাইছিলেন না, অনেকে তখনও জেলে। প্রার্থী হওয়ার ফলে কেউ মুক্তি পেলেন, তখন বন্দিরাও প্রার্থী হতে চাইলেন মুক্তির আশায়। জর্জ ফার্নান্ডেজ বের হননি; জেল থেকেই জেতেন।
১৯৭৭-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমরা বুঝিনি মানুষ আমাদের পক্ষে। তখন আসে মোড় ঘোরানো ঘটনা—জগজীবন রাম, হেমবতী নন্দন বহুগুণা, আবদুল্লাহ বুখারি প্রচারে নামেন। এতে পরিস্থিতি বদলে যায়। তারপর থেকে জনস্রোত শুধু বেড়েই চলেছিল।