“যতদূর মনে পড়ে, আমরা বোধ হয় সব সুদ্ধ তিরিশ- পঁয়তিরিশ জন ছেলে ওই তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলাম। প্রায় অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান।
আরমানীটোলা হাইস্কুল
ঢাকার পুরনো স্কুলগুলির একটি আরমানীটোলা হাইস্কুল বা আরমানীটোলা স্কুল যা এখন পরিচিত আরমানীটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় নামে। পুরনো ঢাকার প্রায় কেন্দ্রে আরমানীটোলায় এ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, আজ থেকে ১২০ বছর আগে।
ঢাকায় ঐ সময় ছিল শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ। ঐ কলেজে প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে কলমে কাজ শেখার জন্য এক্সপেরিমেন্টাল স্কুল হিসেবে ১৯০৪ সালে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর বৈশিষ্ট্য হলো ২.৫ একর জমির ওপর স্থাপিত হয়েছিল। ঢাকার কোনো স্কুল এতোটা জমি নিয়ে স্থাপিত হয় নি। এর মাঝখানে বৃটিশ স্থাপত্য অনুসরণ করে স্কুল ইমারতটি গড়া হয়েছিল। স্কুলের সামনে ও পিছে বিরাট মাঠ। মাঠের সীমান্তে দীঘল গাছের সারি যা অনেকদিন টিকেছিল। এতো ভেবেচিন্তে ঢাকায় এর আগে কোনো স্কুল গড়ে তোলা হয় নি। তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা হয়েছিল স্কুলটিতে।
এর প্রথম হেডমাস্টার খুব সম্ভবত ছিলেন ইংরেজ যার নাম পাওয়া যায় নি।দ্বিতীয় হেডমাস্টার ছিলেন জন ই হাইটেকার [১৯০৭-১৯১০)। প্রথম বাঙালি হেডমাস্টার অবিনাশচন্দ্র ঘোষ (১৯১০-১৯১১)। সবচেয়ে বেশিদিন হেডমাস্টার হিসেবে ছিলেন টি.জি কলিন্স [১৯১২-১৯৩৯)। ১৯ বছর। স্বাভাবিকভাবেই এখানে অনেক ছাত্র ভর্তি হয়েছিলেন যাঁরা পরবর্তীকালে যশস্বী হয়েছিলেন। এরকম একজন ছিলেন অশোক মিত্র। লেখক, অর্থনীতিবিদ পরবর্তীকালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী। গত শতকের ত্রিশ দশকের অশোক মিত্র (১৯৩০-৩১) ছিলেন এ স্কুলের ছাত্র। তিনি লিখেছেন- “যতদূর মনে পড়ে, আমরা বোধ হয় সব সুদ্ধ তিরিশ- পঁয়তিরিশ জন ছেলে ওই তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলাম। প্রায় অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান।
সরকারি স্কুল বলেই বোধহয় মুসলমান ছাত্ররা একটু বেশি পরিমাণে এখানে পড়তে আসতো। হিন্দু ছাত্রদের শ্রেণীবিন্যাস উচ্চবিত্ত থেকে বড় জোর নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যন্ত। কিন্তু মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই আশে পাশের মহল্লার বস্তি থেকে এসেছে। তাদের বাড়িতে শিক্ষার আদৌ কোনও ঐতিহ্য ছিল না, পরিবার থেকে তারাই প্রথম যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। শিশুরা খুব সম্ভবত নিস্পাপ হয়। অমুকরা হিন্দু। তমুকরা মুসলমান; এই বোধ হয় তো ছিল, তবে তা থেকে কোনও বিকৃত সিদ্ধান্তে পৌঁছুবার উৎসাহ কারও মধ্যে চোখে পড়েনি। স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে সবাই সবাইর সমান। সবাই সবাইকে বন্ধুভাবে মেনে নিয়েছে। কখনও কখনও ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু সেই কলহ সাম্প্রদায়িক বিষে জর্জরিত হয়নি।”
প্রায় সমসাময়িক সময়ে স্কুলের ছাত্র ছিলেন প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান। তিনি লিখেছিলেন, “একজন শিক্ষাব্রতীর জীবনের মধ্যে স্কুলের সময়কালটি দীর্ঘতমকাল। আমি আরমানীটোলা স্কুলে ৭টি বৎসর পড়েছি। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে দু’বৎসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বৎসর। আমার বিবিধ প্রকার বিবেচনাবোধ ক্রমান্বয়ে জাগ্রত হয়েছে আমার স্কুল জীবনে এবং মধ্যেপরি আমি যথার্থ নিষ্কলুষ আনন্দের স্বাদ স্কুল জীবনেই পেয়েছিলাম। এ জবিনটি আমর কাছে সর্বাপেক্ষা মহার্ঘ মনে হয়ে। সে সময় শব্দ ছিল, কোলাহল ছিল, আনন্দের উন্মুখরতা ছিল কিন্তু ঈর্ষার আভিজাত্য ছিল না। আমি সে সময় একটি পবিত্র পরিছন্ন জীবনের স্বাদ পেয়েছিলেন।”
(চলবে)