উত্তর কোরিয়ায় টিভি দেখা মানেই বিপদ
বেশির ভাগ দেশে ভালো টিভি শো দেখা সস্তা — মাসিক নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রিপশন এক বেলার পিজ্জার চেয়েও কম দামে হয়ে যায়। কিন্তু উত্তর কোরিয়ায় একটিমাত্র রোমাঞ্চকর টিভি নাটক দেখা জীবন বিপন্ন করতে পারে।
২০২০ সালের ‘অ্যান্টি-রিঅ্যাকশনারি থট ল’ অনুসারে, উত্তর কোরিয়ায় কেউ শত্রু শক্তির ‘‘পচা সংস্কৃতি ও মতাদর্শ’’ ভোগ, রাখা বা ছড়াতে পারবে না। এর মধ্যে কে-পপ, কে-ড্রামা, এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ার বই, ছবি, আঁকাও নিষিদ্ধ। শাস্তির মাত্রা বৈচিত্র্যময় — শ্রম শিবির থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। মানবাধিকার সংগঠনগুলো একাধিক মৃত্যুদণ্ডের খবর জানিয়েছে। ২০২২ সালে ২২ বছর বয়সী এক কৃষক ৭০টি দক্ষিণ কোরিয়ান গান শোনা ও তিনটি সিনেমা দেখে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন।
ঝুঁকি নিয়েও কেন দেখে মানুষ
সব বিপদের পরও উত্তর কোরিয়ানরা কে-ড্রামা দেখতে খুবই আগ্রহী। দক্ষিণ কোরিয়ার একত্রীকরণ মন্ত্রণালয়ের ২০১৬-২০২০ সালের এক জরিপে দেখা যায়, যেসব ব্যক্তি পালিয়ে এসেছে, তাদের ৮৩% অন্তত একবার কে-ড্রামা দেখেছিল।
২০২৩ সালে পালিয়ে আসা কাং গিউ-রি বলেন, ‘‘ওরা মুখে বলবে না ঠিকই, কিন্তু আমি এমন কাউকে চিনতাম না যে বিদেশি ভিডিও দেখেনি।’’
উত্তর কোরিয়ার সরকারি বিনোদন বনাম কে-ড্রামা
উত্তর কোরিয়ানরা সরকারি অনুমোদিত যে সিনেমা-নাটক দেখতে পায়, তা সাধারণত কাঠখোট্টা আর নীতিকথামূলক। যেমন ২০১১ সালের সিনেমা ‘আ ফ্লাওয়ার ইন দ্য স্নো’—এ এক নারী প্রেমিকের জুতা পলিশ করে স্টেশনে, তারপর সম্পর্ক ভেঙে পুরনো কম্বল কারখানা চালু ও এতিমদের লালন-পালনে নিজেকে উত্সর্গ করে। শেষ পর্যন্ত সে সফল হয়, কিন্তু সাবেক প্রেমিক কারখানার যন্ত্রপাতি আনতে গিয়ে মারা যায়।
এর বিপরীতে দক্ষিণ কোরিয়ার নাটকগুলো প্রেমকে একনায়কতন্ত্রহীন ও মানবিক করে তোলে। পিয়ংইয়ংয়ের সাবেক সাঁতারু রিউ হি-জিন বলেছিলেন, ‘‘দক্ষিণ কোরিয়ার নাটকে মানুষ অবলীলায় ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলে। উত্তর কোরিয়ায় একমাত্র ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা ছিল নেতা কিম জং উন ও তার বাবার জন্য।’’
একজন পলাতক নারীর অভিজ্ঞতা
কাং গিউ-রির প্রিয় নাটক ছিল ২০১২ সালের ‘মে কুইন’। রাতে চুপিচুপি চোরাই মেমোরি কার্ডে প্রথমবার দেখে ২০ বার পর্যন্ত রিপ্লে করেছিলেন। প্রায় ৪০ পর্বজুড়ে প্রধান চরিত্র চুন হেজু দারিদ্র্য ও পারিবারিক ষড়যন্ত্র পেরিয়ে জাহাজ ডিজাইনার হয়ে ওঠে। পুরনো কারখানায় চাকরি না করে নিজের ব্যবসার প্রধান হয়।
কাং বলেন, ‘‘ওকে দেখে সাহস পেয়েছিলাম। আমিও জাহাজ ব্যবসায় কাজ করেছি। দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা আর বয়স্ক অভদ্র ক্রেতাদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। ওর মতই আমি লড়াই করে টিকে ছিলাম।’’
কে-ড্রামা শুধু বিনোদন নয়, তথ্যও
‘ইউনিফিকেশন মিডিয়া গ্রুপ’-এর লি কুয়াং-বেক বলেন, উত্তর কোরিয়ার মানুষের জন্য মিডিয়া শুধু বিনোদন নয়, তথ্যও। দক্ষিণ কোরিয়ার নাটকগুলো এমন এক দুনিয়ার জানালা খোলে যা তাদের জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
উত্তর কোরিয়ার প্রোপাগান্ডা দাবি করে দক্ষিণ নাকি দারিদ্র্যপীড়িত, অপরাধপ্রবণ নরক। কিন্তু নাটকে দেখা যায় গাড়ি ভর্তি রাস্তা, মাংসের খাবার, ঝাঁ চকচকে অ্যাপার্টমেন্ট।
কাং বলেন, এমনকি ছোটখাটো বিষয়ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীন জীবনযাত্রা বোঝাত — যেমন নানারকম চুলের স্টাইল। তিনি ২০০৯ সালের ‘বয়েজ ওভার ফ্লাওয়ার্স’ নায়কের নাম মনে নেই, কিন্তু ওর ‘‘পাইনঅ্যাপল কাট’’ মনে আছে।
দুই কোরিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ
২০১৯ সালের জনপ্রিয় নাটক ‘ক্র্যাশ ল্যান্ডিং অন ইউ’ দুই কোরিয়ার জীবনের কিছু বাস্তব ছবি তুলে ধরে। গল্পে দক্ষিণ কোরিয়ার এক ধনী উত্তর কোরিয়ায় দুর্ঘটনায় চলে যায়। এক সৈনিক তাকে বাড়ি ফেরাতে সাহায্য করে। প্রেমের গল্পের আড়ালে দুই কোরিয়ার বৈপরীত্যও স্পষ্ট হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার নাটকগুলো উত্তর কোরিয়ার কাছে একসঙ্গে পরিচিত ও অচেনা। অভিনেতারা কোরিয়ান ভাষায় কথা বলেন, কিন্তু বিশাল বাজেট ও ঝকঝকে প্রোডাকশন উত্তর কোরিয়ানদের চোখে ওগুলো খুবই আকর্ষণীয় করে তোলে।
উত্তর কোরিয়ায় সেলুনগুলো দক্ষিণের হেয়ারস্টাইল নকল করে। তরুণরা দক্ষিণ কোরিয়ার উচ্চারণও অনুকরণ করে।
একে ঠেকাতে ২০২৩ সালে ‘‘পিয়ংইয়ং কালচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোটেকশন অ্যাক্ট’’ পাস হয়, যা নারীদের তাদের স্বামী বা প্রেমিককে ‘‘ওপ্পা’’ বলে ডাকতে নিষিদ্ধ করে।
বিপজ্জনক পথে নাটক দেখা
উত্তর কোরিয়ানরা নাটক দেখার জন্য বিপজ্জনক উপায়ে ব্যবস্থা নেয়। সীমান্তের কাছে বসে চ্যানেল আনলক করে চীনা বা দক্ষিণ কোরিয়ার সম্প্রচার ধরে। কাং নিজেও এভাবে দেখেছেন।
অনেকে চীন থেকে আসা ফ্ল্যাশ ড্রাইভ বা মেমোরি কার্ডে নাটক দেখে। কেউ বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে, আবার কেউ কালোবাজারে কিনে।
শাসকের ভয়
কে-ড্রামাগুলো মূলত রাজনৈতিক নয়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর কাছে এগুলো বিপজ্জনক — তাই শাস্তি ক্রমেই কঠোর হয়েছে। একসময় শুধু বিতরণকারীরা মৃত্যুদণ্ড পেত। এখন শুধু রাখার অপরাধেই মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
কিম জং উন সঠিকভাবেই বোঝেন যে রঙিন, আবেগপ্রবণ এই নাটকগুলো তার কঠিন শাসনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্যকে নষ্ট করে। উত্তর কোরিয়ার মানুষকে বারবার বলা হয় যে কিম পরিবারের জন্যই তারা স্বর্গে থাকে। দক্ষিণের সুখী জীবনের ছবি সেই মিথ ভেঙে দেয়।
কাং বলেন, এসব নাটকেই দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়েছিল যা তাকে দেশ ছাড়ার সাহস জোগায়। তার পরিবার ছোট এক মাছধরার নৌকায় করে উত্তর কোরিয়া ছেড়ে যায়, কোস্টগার্ডকে ফাঁকি দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার জলে পৌঁছে এক জেলের সাহায্যে বেঁচে যায়। যেন বাস্তব জীবনের ‘মে কুইন’।