দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে প্রেমের গল্প নিয়ে তৈরি একটি নতুন টেলিভিশন নাটক তীব্র বিতর্কের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে। নাটকটি নির্মাণের ঘোষণা আসার পরপরই দেশজুড়ে শিশু সুরক্ষা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।
প্রথমে এই সিরিজের নাম ঠিক করা হয়েছিল “দ্য এলিমেন্টারি স্কুল স্টুডেন্ট আই লাভ”, যা একই নামের একটি ওয়েবটুন অবলম্বনে তৈরি হওয়ার কথা ছিল। জুনের শেষ দিকে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষক সমাজ, নাগরিক সংগঠন এবং সাধারণ দর্শক এক হয়ে এর বিরোধিতা করে। তারা এটিকে শিশুদের যৌন শোষণকে রোমান্টিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করে এবং বাতিলের দাবি তোলে।
চাপে পড়ে অবশেষে ৪ জুলাই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মেটা নিউ লাইন এক বিবৃতিতে নাটকটির পরিকল্পনা ও প্রযোজনা স্থগিত করার কথা জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়, “পরিবর্তিত সামাজিক সংবেদনশীলতা” বিবেচনায় রেখে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গল্পের কেন্দ্রে ছিল বিশের কোঠার এক শিক্ষিকার ১২ বছর বয়সী ছাত্রের প্রতি রোমান্টিক আকর্ষণ। সমালোচকরা বলছেন, এটি শিশুদের যৌন প্রলুব্ধকরণকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা হিসেবে দেখা যায়।
শুধু একটি বিতর্কিত গল্প নয়, এই ঘটনা দক্ষিণ কোরিয়ার সমৃদ্ধ ওয়েবটুন ও টিভি শিল্পে নৈতিকতার সীমারেখা নিয়েও বড় প্রশ্ন তুলেছে। কোরিয়ান বিনোদন আজ বৈশ্বিক বাজারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে, ফলে এই ধরনের বিষয়বস্তু সমাজে কী প্রভাব ফেলছে, তা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া এসেছে দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম শিক্ষক সংগঠন কোরিয়ান ফেডারেশন অব টিচার্স’ অ্যাসোসিয়েশন (KFTA)-এর কাছ থেকে। ১ জুলাই এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, “একজন শিক্ষক নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ছাত্রের সঙ্গে ব্যক্তিগত অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া এবং সেটিকে রোমান্টিক সম্পর্কে রূপ দেওয়া কোনো কল্পনা নয়—এটি যৌন প্রলুব্ধকরণের স্পষ্ট রূপ।”
তারা সতর্ক করে দিয়েছে, এমন গল্প শিশু সুরক্ষার মানকে ক্ষুণ্ন করবে, শিক্ষকদের ওপর আস্থা নষ্ট করবে এবং শিশু-কিশোরদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।
সিউলের এক ২৫ বছর বয়সী শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক পার্ক বিয়ং-হা বলেন, “এ ধরনের গল্প সম্প্রচারের কথাই অবিশ্বাস্য। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক কখনো যত্ন ও দায়িত্বের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। এই ধরনের কনটেন্ট বিপজ্জনক, কারণ এটি সমাজে অগ্রহণযোগ্য সম্পর্ককে স্বাভাবিক করে তুলতে পারে।”
তবে শিল্পের কিছু অংশ বলছে, প্রাপ্তবয়স্ক ও কিশোরদের সম্পর্কের গল্প আগে থেকেই সীমিত পরিসরে ওয়েবটুনে থাকলেও টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হওয়া একেবারে আলাদা বিষয়। ওয়েবটুন শিল্পী ওয়েন্ডি কিম বলেন, “ওয়েবটুনে পাঠক নিজের পছন্দমতো গল্প বেছে নেয়। কিন্তু টিভি ড্রামা সবার ঘরে সম্প্রচারিত হয়।”
কমিক সমালোচক সিও চ্যান-হোয়ে বলেন, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের ট্রপ নতুন কিছু নয়। কোরিয়ান এবং জাপানি কমিকে এটি বহু দশক ধরে রয়েছে। তবে আজকের সমাজ ক্ষমতাভিত্তিক সম্পর্কের ঝুঁকি আরও ভালোভাবে বোঝে। তার ভাষায়, “আগে অনেকে চোখ বুজে থাকত। এখন সবাই জানে যে এটি প্রকৃত অর্থে যৌন প্রলুব্ধকরণ। লিঙ্গ উল্টে দিলেও সমস্যার সমাধান হয় না। এটি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই থাকে এবং বাস্তবে প্রায় সবক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের হাতে অল্পবয়সী মেয়েরা শিকার হয়।”
তিনি আরও বলেন, “মূল বিষয় হলো শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের ক্ষমতার অসমতা। এটি বিশ্বাস, ক্ষমতা এবং শিশুর প্রকৃত সম্মতির অক্ষমতা নিয়ে।”
এই বিতর্ক দক্ষিণ কোরিয়ার বিস্তৃত মিডিয়া শিল্পে আরও কড়া নজরদারির দাবি তুলেছে। দেশটিতে প্রতিবছর হাজার হাজার শো এবং ওয়েবটুন তৈরি হয়, যার অনেকটাই কোনো সম্পাদকীয় নীতিমালা বা নৈতিক মানদণ্ড ছাড়া চলে। ওয়েন্ডি কিম বলেন, “অনেক সাইটে প্রায় ৮০ শতাংশ কনটেন্টই স্পষ্টভাবে যৌন বিষয়ক। কোনো নীতিমালা বা নৈতিক মূল্যায়ন থাকে না।”
২০২০ সালে অনৈতিক আচরণ নিয়ে একটি কমিকের বিরুদ্ধে করা পিটিশনে এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি সই পড়েছিল। এবারও এমন দাবি জোরালো হয়েছে। কোরিয়ান টিচার অ্যান্ড এডুকেশন ওয়ার্কার্স’ ইউনিয়ন ওয়েবকমিক খাতে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ দাবি করছে।
তবে সমালোচক সিও চ্যান-হোয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “সব ধরনের প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা উচিত। তবে নির্মাতা ও প্রযোজকদের জনসমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে।” তিনি বলেন, “আমাদের দরকার একটি স্বাস্থ্যকর বিতর্কের ক্ষেত্র, যেখানে শিল্পের স্বাধীনতা ও সামাজিক দায় নিয়ে আলাপ হবে। মানুষ যদি মনে করে কোনো বিষয় উপযুক্ত নয়, তারা দেখবে না বা পড়বে না, এতে স্বাভাবিকভাবেই বিরোধ কমবে।”
মেটা নিউ লাইনের নাটক বন্ধের সিদ্ধান্তকে শিক্ষক ইউনিয়ন স্বাগত জানিয়েছে। KFTA এক বিবৃতিতে বলেছে, “এটি শিক্ষাক্ষেত্রে পাঁচ লাখ কর্মীর দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার এবং শিক্ষকদের সম্মান ও আস্থা পুনঃস্থাপনের জন্য যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত।”
শিক্ষক পার্ক বিয়ং-হা বলেন, “এটি শুধু একটি নাটকের গল্প নয়। এটি নিয়ে আমাদের সমাজে প্রশ্ন—আমরা কি শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তার পক্ষে দাঁড়াতে পারি, এমনকি বিনোদনের ক্ষেত্রেও?”