২০২৫ সালের মাঝপথ অতিক্রমের সঙ্গে সঙ্গে প্রবল প্রতিকূলতা বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতি কমিয়ে দিচ্ছে। গত এক দশকে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য বিধি–নিষেধ সম্প্রতি বড় অর্থনীতিগুলোর শুল্ক বৃদ্ধির ধাক্কায় আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। গত তিন মাসে শুল্ক দ্রুত বাড়ানো ও পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যদিও এর কিছু সিদ্ধান্ত পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং নতুন করে আলোচনা চলছে, ব্যবসায়ীরা এখনো লড়ছে নীতিগত অনিশ্চয়তা, টানাপোড়েনপূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খলে ও যেকোনো সময় নতুন বাধার আশঙ্কার সঙ্গেই। এই প্রেক্ষাপটে আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি—চলতি বছর ও আগামী বছরে এসব প্রতিকূলতা বাণিজ্য প্রবৃদ্ধিকে কীভাবে রূপ দেবে, সামনে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিগুলো কী এবং কোন ইতিবাচক দিকগুলো নৌকাকে স্থির রাখতে সহায়তা করতে পারে।
আসছে দুর্বল বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি
আমাদের পূর্বাভাস, এ বছর বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে মন্থর হবে, যার প্রধান কারণ বাড়তি শুল্ক ও দীর্ঘস্থায়ী নীতিগত অনিশ্চয়তার সম্মিলিত প্রভাব। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ঘোষণার পর এপ্রিলে বাণিজ্য–নীতিগত অনিশ্চয়তা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল, যদিও আংশিক শুল্ক প্রত্যাহার ও বহুমুখী আলোচনার ফলে তা কিছুটা কমে গেছে (চিত্র ১ক)। বছরের শুরুতে শুল্ক বৃদ্ধি ধার্য হওয়ার আগে আমদানি আগাম সম্পন্ন করার প্রবণতায় বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক শক্তিশালী ছিল; কিন্তু সামগ্রিকভাবে ২০২৪-এর ৩.৪ শতাংশ থেকে ২০২৫-এ তা কমে প্রায় ১.৮ শতাংশে নামবে বলে ধারণা (চিত্র ১খ)। জানুয়ারি পূর্বাভাসের তুলনায় ২০২৫-এর প্রবৃদ্ধি প্রায় ১.৩ শতাংশ পয়েন্ট নিচে সরা হয়েছে। এ গতি বজায় থাকলে মহামারি-পূর্ব দুই দশকের গড় ৪.৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অর্ধেকেরও কম হবে বাণিজ্য বিস্তার।
জানুয়ারি থেকে সংশোধনের ঢেউ সবচেয়ে বড় আঘাত করেছে উন্নত অর্থনীতিগুলোয়—২০২৫ সালে তাদের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি আগের পূর্বাভাসের প্রায় অর্ধেকে নেমেছে; ইএমডিই-র ক্ষেত্রে কাটছাঁট প্রায় এক-চতুর্থাংশ। সাম্প্রতিক তথ্য এই ধীরগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে: এপ্রিলে বৈশ্বিক পণ্য আমদানি বছর–ওভার-বছর ভিত্তিতে তীব্রভাবে কমে ২.৯ শতাংশ হয়েছে (মার্চের ৬.৭ শতাংশ থেকে), আর যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি মাস–ওভার-মাস প্রায় ২০ শতাংশ পড়ে গেছে।
উচ্চ-ঘনত্বের সূচকও বিস্তৃত দুর্বলতা দেখায়। উৎপাদন খাতের ক্রয়-ব্যবস্থাপক সূচকে (পিএমআই) অংশগ্রহণকারী দুই-তৃতীয়াংশ দেশে নতুন রপ্তানি আদেশ সংকুচিত। সূচক দেখায় এপ্রিলের আদেশ ২০ মাসের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে এবং মে-তেও চাপা অবস্থায় ছিল। নীতিগত উত্তেজনা প্রশমিত হলে ও সরবরাহ শৃঙ্খল উঁচু শুল্কের নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিলে ২০২৬-এ বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি হালকা ঘুরে দাঁড়িয়ে ২.৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যদিও তা জানুয়ারির তুলনায় ০.৮ শতাংশ পয়েন্ট কম।
দেশভেদে বিভিন্ন সম্ভাবনা
বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস দেশভেদে ব্যাপক পার্থক্য দেখাচ্ছে। ২০২২ থেকে নতুন বাণিজ্য বিধি–নিষেধের প্রায় ৭০ শতাংশই এসেছে উন্নত অর্থনীতিগুলো থেকে, যদিও তাদের গড় শুল্ক হার এখনো উন্নয়নশীল অর্থনীতির গড়ের চেয়ে কম। বাড়তি বিধি–নিষেধ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে সেসব ইএমডিইকে, যারা এই বাজারগুলোর ওপর নির্ভরশীল (চিত্র ২ক)। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত বাজার-নির্ভর অর্থনীতির—যেমন ইউরোপীয় মুদ্রা অঞ্চল, লাতিন আমেরিকা-ক্যারিবীয় এলাকা এবং ইউরোপ-মধ্য এশিয়ার ইএমডিই—বাণিজ্য প্রবৃদ্ধিতে বেশি চাপ অনুভব করবে।
উচ্চ-ঘনত্বের সূচকও এই বিচ্ছিন্নতা দেখায়। উন্নত বাজার-নির্ভর অর্থনীতিগুলোর পিএমআই-তে নতুন রপ্তানি আদেশ সংকুচিত আর অত্যন্ত খোলা ইএমডিইগুলোর পিএমআই-র রপ্তানি উপসূচক সাম্প্রতিক মাসগুলোয় তীব্রভাবে নেমেছে। বিপরীতে, যাদের বাণিজ্যিক সম্পৃক্ততা মূলত ইএমডিই-ভিত্তিক, তারা তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকবে ও দ্রুত পুনরুদ্ধার করবে । তেলের উৎপাদন হ্রাস শিথিল হলে কিছু তেল-রপ্তানিকারক দেশের রপ্তানি বিশ্ব চাহিদা কম থাকলেও বাড়তে পারে। ফলে অঞ্চলভেদে ভিন্ন ফলাফল দেখা যাবে, যদিও সার্বিকভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্তই থাকবে।
প্রধান ঝুঁকি কী?
দ্রুত বদলে যাওয়া নীতি ও স্থায়ী অনিশ্চয়তার ভেতর বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি বড় নিম্নমুখী ঝুঁকির মুখে। দেশগুলো যদি পূর্বঘোষিত উচ্চ শুল্কে ফিরে যায় বা পাল্টা ব্যবস্থা বিস্তৃত করে, তবে সহজেই আড়াআড়ি প্রভাব ছড়াবে। তৃতীয় বাজারগুলোও নিজের শিল্প রক্ষায় নতুন নিষেধাজ্ঞা নিতে পারে, ফলে বাণিজ্য প্রবাহ ও বৈশ্বিক চাহিদায় আরও চাপ পড়বে। দীর্ঘমেয়াদে সরবরাহ শৃঙ্খল পুনর্গঠনের অনিশ্চয়তাও ঝুঁকি বাড়ায়। নীতিমালা অস্পষ্ট থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন উৎস গঠনে বিনিয়োগ বিলম্বিত করতে পারে। বড় অর্থনীতিগুলো যদি অন্তর্মুখী নীতি চালিয়ে যায়, তবে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা, কম বিনিয়োগ ও মন্থর উৎপাদনশীলতার চাপ দিতে পারে।
আঞ্চলিক চুক্তিতে গতি ফিরছে
বিধি–নিষেধ বাড়লেও অনেক দেশ আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির (আরটিএ) দিকে ঝুঁকছে। ইএমডিইদের মাঝে আঞ্চলিক সংহতি বিশ্বায়নের বিভাজন কমাতে বাফার হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্যমতে ২০২৪-এ সাতটি নতুন চুক্তি কার্যকর হয়েছে—২০২৩-এ ছিল চারটি। এর বেশিরভাগই পণ্য ও সেবা উভয় ক্ষেত্রেই শুল্ক হ্রাস; যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন-চিলি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-নিউজিল্যান্ড, চীন-নিকারাগুয়া, ইউরোপীয় মুক্ত বাণিজ্য সংঘ-মলদোভা এবং কানাডা-ইউক্রেন। পণ্য-কেন্দ্রিক চুক্তি হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-কেনিয়া, চীন-সার্বিয়া ও চীন-ইকুয়েডরের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য একটি চুক্তি সই করেছে, যাতে নানা শুল্ক ও অ-শুল্ক বাধা হ্রাস পাবে। আফ্রিকান মহাদেশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকার বাস্তবায়ন গতিও বেড়েছে—গাইডেড ট্রেড ইনিশিয়েটিভে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়া যোগ দিয়ে বাণিজ্য দ্রুততর করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
বাণিজ্য আলোচনাও নতুন গতি পেয়েছে। বিস্তৃত ও প্রগতিশীল প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিপিটিপিপি) ২০২৪-এর ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, আর চীন, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ একাধিক দেশ যোগদানের আগ্রহ দেখিয়েছে। এ জোট বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, মেরকোসুর, ফিলিপাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে নতুন ও পুনরুজ্জীবিত চুক্তিতে ব্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনও ডজনখানেক অতিরিক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় নিয়োজিত।
প্রবৃদ্ধির বাণিজ্য ইঞ্জিন রক্ষা
এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক বাণিজ্য স্থিতিশীল থাকলেও মন্থরতা শুরু হয়ে গেছে। বাড়তি বাধা ও নীতিগত অনিশ্চয়তা ইতোমধ্যেই অর্থনীতিকে আঘাত করছে এবং গুরুতর নিম্নমুখী ঝুঁকি তৈরি করছে। তবে এই প্রতিকূলতা সব দেশের জন্য সমান নয়—নতুন ও সম্প্রসারিত চুক্তির গতি দেখাচ্ছে, লক্ষ্যভিত্তিক নীতি-উদ্যোগে নৌকাকে স্থির রাখা, ধাক্কা সামাল দেওয়া এবং ধীরে পুনরুদ্ধারের ভিত্তি গড়ে তোলা যায়।
বাণিজ্য বহু দশক ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন। নীতিনির্ধারকদের এখন দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে—উত্তেজনা প্রশমিত করা, আলোচনা এগিয়ে নেওয়া, বিধি–নিষেধ কমানো, সরবরাহ শৃঙ্খল বহু-পথে বিস্তৃত করা এবং নতুন বাজার উন্মুক্ত করাই অপরিহার্য। তবেই এই ইঞ্জিন সচল থাকবে এবং মন্থর বাণিজ্য সম্প্রসারণের সময় পেরিয়ে যেতে সহায়তা করবে।