১১:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

ডলারের দাম ধরে রাখতে গিয়ে শিল্প থেমে না যায়

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির বড় ধাক্কা: অর্থনীতির বিপদ সংকেত

গত ১০ মাসে বাংলাদেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি (capital machinery) আমদানি নজিরবিহীনভাবে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ২০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস হয়েছে। শিল্প ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগে সরাসরি ব্যবহার হয় এমন যন্ত্রপাতি হলো মূলধনী যন্ত্র। এর আমদানি কমে যাওয়া মানে—দেশে নতুন শিল্প প্রকল্প স্থাপন বা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ কমে যাচ্ছে। এটি স্বল্পমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করলেও দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ডলার সংকট ও এলসি সীমাবদ্ধতা: আমদানি হ্রাসের প্রধান কারণ

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাসের একটি বড় কারণ গত বছরের তীব্র ডলার সংকট। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে কঠোরভাবে এলসি (Letter of Credit) খোলার শর্ত আরোপ করে। ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ডলার বরাদ্দ দিতে রাজি হয়নি বা শর্ত কঠিন করেছে। ফলে শিল্প উদ্যোক্তারা নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি স্থগিত রেখেছেন বা বাতিল করেছেন। সরকার এলসি খোলার অনুমতি সীমিত করে “অপ্রয়োজনীয় বা বিলাসী পণ্য” কমানোর চেষ্টা করলেও মূলধনী যন্ত্রপাতিও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন থেকে সাম্প্রতিক উল্টো প্রবণতা

বাংলাদেশে গত দুই বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ক্রমশ কমছিল। ২০২৪ সালের প্রথম ভাগে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার অবমূল্যায়ন করেছে, যাতে রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়ানো যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন করা যায়। কিন্তু ডলার সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি কড়াকড়ি করে আমদানি হ্রাস করে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করে। এর ফলে ২০২৫ সালের শুরু থেকে ডলারের চাহিদা কিছুটা কমে যায়।

গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে এবং আমদানি ব্যয় কমেছে, ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ টাকার তুলনায় কিছুটা বেশি হয়েছে। এতে ডলারের দাম কিছুটা কমে এসেছে। অর্থাৎ, টাকার মান সামান্য শক্ত হয়েছে।

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির হ্রাস এবং ডলার দরপতনের যোগসূত্র

এই প্রক্রিয়ায় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া এক অর্থে সরকারের কৃত্রিমভাবে ডলার সাশ্রয় নীতির অংশ। যেহেতু ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি আনতে ব্যাংকগুলো ডলার দিচ্ছে না বা সীমিত দিচ্ছে, তাই মোট আমদানি বিল কমে যাচ্ছে। এর সরাসরি ফল হচ্ছে—ডলারের বাজারে চাপ কমেছে। এই চাপ কমলে ডলারের দর কিছুটা পড়ে।

কিন্তু এটি একটি স্বস্তির বিষয় হলেও তা অর্থনীতির জন্য বিপদ সংকেত। কারণ, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমা মানে দেশে নতুন শিল্প কারখানা গড়ার গতি শ্লথ। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ কমলে কয়েক মাস বা কয়েক বছরের মধ্যে উৎপাদন ও রপ্তানি আয় কমবে। তখন ডলারের সরবরাহ আবার সংকুচিত হবে এবং তখন আবার টাকার মান পড়তে পারে। অর্থাৎ, স্বল্পমেয়াদী ডলার দরপতনের আড়ালে লুকিয়ে আছে দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি।

শিল্পখাতের শঙ্কা ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প সংগঠনগুলো যেমন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) বলছে—মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া হলে শিল্প সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান থমকে যাবে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, নির্মাণ, ইলেকট্রনিক্সসহ বিভিন্ন খাতে নতুন মেশিন, প্রযুক্তি ও কারখানা ছাড়া উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। বিনিয়োগ কমলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে।

ছয় মাসে রেমিটেন্স বেড়েছে ৩৭.৫৯ শতাংশ - banglanews24.com

নীতি-পরামর্শ ও বিশ্লেষণ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলার সংকট সমাধানের জন্য শুধু আমদানি কেটে ফেলা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। প্রয়োজন রপ্তানি আয় বাড়ানো, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আনা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিকে “অপ্রয়োজনীয় বিলাসী পণ্য” হিসেবে না দেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় শিল্প খাতের আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দে সমন্বিত নীতি নিতে হবে।

ডলার ও শিল্প

সারসংক্ষেপে বলা যায়, গত ১০ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির বড় ধরনের হ্রাস স্বল্পমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রক্ষায় কিছুটা সহায়ক হয়েছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান সামান্য শক্ত হয়েছে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নীতিনির্ধারকদের এখনই এই দ্বন্দ্বের সমাধান করতে হবে—ডলার সংকট সামলাতে গিয়ে যেন দেশের শিল্প ও বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে না যায়।

ডলারের দাম ধরে রাখতে গিয়ে শিল্প থেমে না যায়

০৬:২৭:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির বড় ধাক্কা: অর্থনীতির বিপদ সংকেত

গত ১০ মাসে বাংলাদেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি (capital machinery) আমদানি নজিরবিহীনভাবে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ২০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস হয়েছে। শিল্প ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগে সরাসরি ব্যবহার হয় এমন যন্ত্রপাতি হলো মূলধনী যন্ত্র। এর আমদানি কমে যাওয়া মানে—দেশে নতুন শিল্প প্রকল্প স্থাপন বা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ কমে যাচ্ছে। এটি স্বল্পমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করলেও দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ডলার সংকট ও এলসি সীমাবদ্ধতা: আমদানি হ্রাসের প্রধান কারণ

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাসের একটি বড় কারণ গত বছরের তীব্র ডলার সংকট। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে কঠোরভাবে এলসি (Letter of Credit) খোলার শর্ত আরোপ করে। ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ডলার বরাদ্দ দিতে রাজি হয়নি বা শর্ত কঠিন করেছে। ফলে শিল্প উদ্যোক্তারা নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি স্থগিত রেখেছেন বা বাতিল করেছেন। সরকার এলসি খোলার অনুমতি সীমিত করে “অপ্রয়োজনীয় বা বিলাসী পণ্য” কমানোর চেষ্টা করলেও মূলধনী যন্ত্রপাতিও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন থেকে সাম্প্রতিক উল্টো প্রবণতা

বাংলাদেশে গত দুই বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ক্রমশ কমছিল। ২০২৪ সালের প্রথম ভাগে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার অবমূল্যায়ন করেছে, যাতে রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়ানো যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন করা যায়। কিন্তু ডলার সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি কড়াকড়ি করে আমদানি হ্রাস করে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করে। এর ফলে ২০২৫ সালের শুরু থেকে ডলারের চাহিদা কিছুটা কমে যায়।

গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে এবং আমদানি ব্যয় কমেছে, ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ টাকার তুলনায় কিছুটা বেশি হয়েছে। এতে ডলারের দাম কিছুটা কমে এসেছে। অর্থাৎ, টাকার মান সামান্য শক্ত হয়েছে।

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির হ্রাস এবং ডলার দরপতনের যোগসূত্র

এই প্রক্রিয়ায় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া এক অর্থে সরকারের কৃত্রিমভাবে ডলার সাশ্রয় নীতির অংশ। যেহেতু ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি আনতে ব্যাংকগুলো ডলার দিচ্ছে না বা সীমিত দিচ্ছে, তাই মোট আমদানি বিল কমে যাচ্ছে। এর সরাসরি ফল হচ্ছে—ডলারের বাজারে চাপ কমেছে। এই চাপ কমলে ডলারের দর কিছুটা পড়ে।

কিন্তু এটি একটি স্বস্তির বিষয় হলেও তা অর্থনীতির জন্য বিপদ সংকেত। কারণ, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমা মানে দেশে নতুন শিল্প কারখানা গড়ার গতি শ্লথ। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ কমলে কয়েক মাস বা কয়েক বছরের মধ্যে উৎপাদন ও রপ্তানি আয় কমবে। তখন ডলারের সরবরাহ আবার সংকুচিত হবে এবং তখন আবার টাকার মান পড়তে পারে। অর্থাৎ, স্বল্পমেয়াদী ডলার দরপতনের আড়ালে লুকিয়ে আছে দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি।

শিল্পখাতের শঙ্কা ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প সংগঠনগুলো যেমন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) বলছে—মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া হলে শিল্প সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান থমকে যাবে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, নির্মাণ, ইলেকট্রনিক্সসহ বিভিন্ন খাতে নতুন মেশিন, প্রযুক্তি ও কারখানা ছাড়া উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। বিনিয়োগ কমলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে।

ছয় মাসে রেমিটেন্স বেড়েছে ৩৭.৫৯ শতাংশ - banglanews24.com

নীতি-পরামর্শ ও বিশ্লেষণ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলার সংকট সমাধানের জন্য শুধু আমদানি কেটে ফেলা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। প্রয়োজন রপ্তানি আয় বাড়ানো, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আনা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিকে “অপ্রয়োজনীয় বিলাসী পণ্য” হিসেবে না দেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় শিল্প খাতের আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দে সমন্বিত নীতি নিতে হবে।

ডলার ও শিল্প

সারসংক্ষেপে বলা যায়, গত ১০ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির বড় ধরনের হ্রাস স্বল্পমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রক্ষায় কিছুটা সহায়ক হয়েছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান সামান্য শক্ত হয়েছে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নীতিনির্ধারকদের এখনই এই দ্বন্দ্বের সমাধান করতে হবে—ডলার সংকট সামলাতে গিয়ে যেন দেশের শিল্প ও বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে না যায়।