০৮:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশে কাঁঠালের উৎপাদন বেশি হলেও রপ্তানি কেন নয়?

বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কাঁঠাল। এটি শুধু জাতীয় ফলই নয়, বরং নরসিংদী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদিত হয়। কৃষি তথ্য সার্ভিস ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়, যা বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ উৎপাদন মাত্রা।

উৎপাদনের বিপরীতে রপ্তানির চিত্র হতাশাজনক

প্রতিবছর কাঁঠালের উৎপাদন লক্ষণীয় হারে বাড়লেও রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। ২০২৪ সালের কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ কেবল ৪০০ থেকে ৬০০ টন কাঁঠাল বিদেশে রপ্তানি করেছে, যা মোট উৎপাদনের শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশেরও কম। এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সম্ভাবনাময় একটি রপ্তানি খাত দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকার উদাহরণ।

রপ্তানিতে ব্যর্থতার প্রধান কারণ

১. পর্যাপ্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধার অভাব: দেশে মানসম্মত কোল্ড চেইন ও আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়; ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাঁঠাল নষ্ট হয়।

২. অব্যবস্থাপনা ও লজিস্টিক দুর্বলতা: দ্রুত সংগ্রহ, বাছাই, প্যাকেজিং ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থার ঘাটতি গ্রামীণ এলাকায় তীব্র।

৩. বৈদেশিক বাজারে প্রচারণার অভাব: দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে কাঁঠালের ক্রমবর্ধমান চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ সে বাজারে নিজস্ব ব্র্যান্ড উপস্থিতি গড়ে তুলতে পারেনি।

৪. জাত, মান ও আকৃতির বৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি: রপ্তানির জন্য সমমানের, রোগমুক্ত,আকারে তুলনামূলক একরূপ ও দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণযোগ্য ফল প্রয়োজন;পর্যাপ্ত বাছাই ও গ্রেডিং অবকাঠামো নেই।

৫. প্রক্রিয়াজাত রপ্তানিতে উদ্যোগের ঘাটতি: কাঁঠাল চিপস, জ্যাম, শুকনো ক্যান্ডি, কাঁঠাল নির্ভর মাংস বিকল্প (জ্যাকফ্রুট মিট) ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় পণ্যের শিল্পভিত্তি এখনো সীমিত।

প্রতি বছর নষ্ট হয় বিপুল পরিমাণ কাঁঠাল

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, উৎপাদিত কাঁঠালের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সংরক্ষণ ঘাটতি, সময়মতো বাজারজাত না করতে পারা ও আংশিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতিবছর আনুমানিক ৩ থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল অপচয় হয়, যার বাজারমূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। এটি কৃষকের সরাসরি লোকসানের পাশাপাশি সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন কমিয়ে দেয়।

কাঁঠালের রপ্তানি সম্ভাবনা

বিশ্ববাজারে কাঁঠালের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে—বিশেষত ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালি ও দক্ষিণ এশীয় ভোক্তাদের মধ্যে। পাশাপাশি উদীয়মান ভেগান ও প্ল্যান্ট-বেসড খাদ্য বাজারে “জ্যাকফ্রুট মিট” বা কাঁঠালভিত্তিক মাংস বিকল্পের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়ে এই বাজার ধরতে পারলে কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।

করণীয় ও সুপারিশ

  • • প্রক্রিয়াজাত শিল্পে আর্থিক প্রণোদনা, স্বল্পসুদ ঋণ ও কর-সুবিধা প্রদান।
  • • রপ্তানিযোগ্য উচ্চফলনশীল ও দীর্ঘস্থায়ী জাত উদ্ভাবনে গবেষণা জোরদার।
  • • কোল্ড চেইন অবকাঠামো (প্রি-কুলিং, কোল্ড স্টোরেজ, রেফ্রিজারেটেড পরিবহন) দ্রুত সম্প্রসারণ।

  • • আন্তর্জাতিক মানদণ্ডভিত্তিক বাছাই, গ্রেডিং, প্যাকহাউস স্থাপন ও ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম চালু।
  • • বৈদেশিক বাজারে লক্ষ্যভিত্তিক ব্র্যান্ডিং, ডিজিটাল প্রচারণা ও ট্রেড ফেয়ার অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।
  • • প্রক্রিয়াজাত পণ্যের (চিপস, পিউরি, জ্যাম, ক্যানড আরিল, ফ্রোজেন ও রেডি-টু-কুক “জ্যাকফ্রুট মিট”) মান নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য সংযোজিত রপ্তানি সম্প্রসারণ।
  • • কৃষক সমবায় ও চুক্তিভিত্তিক কৃষির মাধ্যমে মানসম্মত কাঁচামাল সরবরাহ শৃঙ্খল গড়ে তোলা।
  • • খাদ্য নিরাপত্তা ও ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেশন অর্জনে প্রশিক্ষণ ও ল্যাব সক্ষমতা বৃদ্ধি।

সম্ভাবনাময় রপ্তানি সম্পদ

কাঁঠাল শুধুই জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক নয়; এটি একটি উচ্চমূল্য সম্ভাবনাময় রপ্তানি সম্পদ। উৎপাদনের তুলনায় অপ্রতুল রপ্তানি ও বিপুল অপচয় আমাদের কাঠামোগত দুর্বলতা ও নীতিগত শূন্যতার প্রতিফলন। পরিকল্পিত বিনিয়োগ, প্রযুক্তি প্রয়োগ, মান নিয়ন্ত্রণ, বাজারমুখী গবেষণা ও সক্রিয় বৈদেশিক বিপণনের সমন্বয়ে বাংলাদেশ কাঁঠাল রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে পারে। এখন প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়াস ও সময়োপযোগী বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশে কাঁঠালের উৎপাদন বেশি হলেও রপ্তানি কেন নয়?

০৩:০৯:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কাঁঠাল। এটি শুধু জাতীয় ফলই নয়, বরং নরসিংদী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদিত হয়। কৃষি তথ্য সার্ভিস ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়, যা বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ উৎপাদন মাত্রা।

উৎপাদনের বিপরীতে রপ্তানির চিত্র হতাশাজনক

প্রতিবছর কাঁঠালের উৎপাদন লক্ষণীয় হারে বাড়লেও রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। ২০২৪ সালের কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ কেবল ৪০০ থেকে ৬০০ টন কাঁঠাল বিদেশে রপ্তানি করেছে, যা মোট উৎপাদনের শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশেরও কম। এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সম্ভাবনাময় একটি রপ্তানি খাত দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকার উদাহরণ।

রপ্তানিতে ব্যর্থতার প্রধান কারণ

১. পর্যাপ্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধার অভাব: দেশে মানসম্মত কোল্ড চেইন ও আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়; ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাঁঠাল নষ্ট হয়।

২. অব্যবস্থাপনা ও লজিস্টিক দুর্বলতা: দ্রুত সংগ্রহ, বাছাই, প্যাকেজিং ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থার ঘাটতি গ্রামীণ এলাকায় তীব্র।

৩. বৈদেশিক বাজারে প্রচারণার অভাব: দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে কাঁঠালের ক্রমবর্ধমান চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ সে বাজারে নিজস্ব ব্র্যান্ড উপস্থিতি গড়ে তুলতে পারেনি।

৪. জাত, মান ও আকৃতির বৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি: রপ্তানির জন্য সমমানের, রোগমুক্ত,আকারে তুলনামূলক একরূপ ও দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণযোগ্য ফল প্রয়োজন;পর্যাপ্ত বাছাই ও গ্রেডিং অবকাঠামো নেই।

৫. প্রক্রিয়াজাত রপ্তানিতে উদ্যোগের ঘাটতি: কাঁঠাল চিপস, জ্যাম, শুকনো ক্যান্ডি, কাঁঠাল নির্ভর মাংস বিকল্প (জ্যাকফ্রুট মিট) ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় পণ্যের শিল্পভিত্তি এখনো সীমিত।

প্রতি বছর নষ্ট হয় বিপুল পরিমাণ কাঁঠাল

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, উৎপাদিত কাঁঠালের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সংরক্ষণ ঘাটতি, সময়মতো বাজারজাত না করতে পারা ও আংশিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতিবছর আনুমানিক ৩ থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল অপচয় হয়, যার বাজারমূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। এটি কৃষকের সরাসরি লোকসানের পাশাপাশি সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন কমিয়ে দেয়।

কাঁঠালের রপ্তানি সম্ভাবনা

বিশ্ববাজারে কাঁঠালের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে—বিশেষত ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালি ও দক্ষিণ এশীয় ভোক্তাদের মধ্যে। পাশাপাশি উদীয়মান ভেগান ও প্ল্যান্ট-বেসড খাদ্য বাজারে “জ্যাকফ্রুট মিট” বা কাঁঠালভিত্তিক মাংস বিকল্পের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়ে এই বাজার ধরতে পারলে কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।

করণীয় ও সুপারিশ

  • • প্রক্রিয়াজাত শিল্পে আর্থিক প্রণোদনা, স্বল্পসুদ ঋণ ও কর-সুবিধা প্রদান।
  • • রপ্তানিযোগ্য উচ্চফলনশীল ও দীর্ঘস্থায়ী জাত উদ্ভাবনে গবেষণা জোরদার।
  • • কোল্ড চেইন অবকাঠামো (প্রি-কুলিং, কোল্ড স্টোরেজ, রেফ্রিজারেটেড পরিবহন) দ্রুত সম্প্রসারণ।

  • • আন্তর্জাতিক মানদণ্ডভিত্তিক বাছাই, গ্রেডিং, প্যাকহাউস স্থাপন ও ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম চালু।
  • • বৈদেশিক বাজারে লক্ষ্যভিত্তিক ব্র্যান্ডিং, ডিজিটাল প্রচারণা ও ট্রেড ফেয়ার অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।
  • • প্রক্রিয়াজাত পণ্যের (চিপস, পিউরি, জ্যাম, ক্যানড আরিল, ফ্রোজেন ও রেডি-টু-কুক “জ্যাকফ্রুট মিট”) মান নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য সংযোজিত রপ্তানি সম্প্রসারণ।
  • • কৃষক সমবায় ও চুক্তিভিত্তিক কৃষির মাধ্যমে মানসম্মত কাঁচামাল সরবরাহ শৃঙ্খল গড়ে তোলা।
  • • খাদ্য নিরাপত্তা ও ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেশন অর্জনে প্রশিক্ষণ ও ল্যাব সক্ষমতা বৃদ্ধি।

সম্ভাবনাময় রপ্তানি সম্পদ

কাঁঠাল শুধুই জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক নয়; এটি একটি উচ্চমূল্য সম্ভাবনাময় রপ্তানি সম্পদ। উৎপাদনের তুলনায় অপ্রতুল রপ্তানি ও বিপুল অপচয় আমাদের কাঠামোগত দুর্বলতা ও নীতিগত শূন্যতার প্রতিফলন। পরিকল্পিত বিনিয়োগ, প্রযুক্তি প্রয়োগ, মান নিয়ন্ত্রণ, বাজারমুখী গবেষণা ও সক্রিয় বৈদেশিক বিপণনের সমন্বয়ে বাংলাদেশ কাঁঠাল রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে পারে। এখন প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়াস ও সময়োপযোগী বাস্তবায়ন।