০৭:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
শিক্ষার বাতিঘর প্রয়াত প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকীর ৫৮তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন ‘জেন জি’ তরুণরা অধিকাংশ ডানপন্থী রাজনীতি করে: সমস্যা প্রেমে ও ডেটে যুক্তরাষ্ট্র-হামাস আলোচনায় অচলাবস্থা, গাজা ও ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে কূটনৈতিক ব্যস্ততা নদীতে ভাসমান হাট: বরিশাল ও ঝালকাঠির নৌপথে কৃষিপণ্যের জীবন্ত সংস্কৃতি চিতা বাঘ — ছায়ায় লুকিয়ে থাকা বনবাসী যুক্তরাজ্যের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেল ভারত : বাংলাদেশের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও সংকট: ছয় মাসেও কেন থামছে না এই মরণব্যাধি? আধুনিক জীবন ও উদারচিন্তা ভয়ের পরিবেশে: বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি: গমজাত পণ্যের দামের ওপর প্রভাব শয়ে শয়ে মুসলমানকে বেআইনিভাবে বাংলাদেশে তাড়াচ্ছে ভারত, বলছে হিউমান রাইটস ওয়াচ

সৃষ্টি ও ধ্বংসের যুগলবন্দি

২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি। শত শত বিমান প্রতিদিন আকাশে ওড়ে, সেটা নিয়ে কোনো চাঞ্চল্য নেই, কোনো খবরও নয় ওই বিমান চলাচল নয়। কারণ ওটা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক বিষয় সচরাচর খবর হয় না। কিন্তু মাইলস্টোনে একটি যুদ্ধবিমান, যেটা প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল, সেটি আছড়ে পড়ে অসংখ্য মৃত্যুর কারণ হওয়ায় ওটা খবর হয়েছে। মর্মান্তিক এবং দুঃখ ও বেদনার খবর। আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি। আমরা অনেক কিছুই দ্রুত ভুলে যাই। এই বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনাও খুব দীর্ঘস্থায়ী হবে না আমাদের জীবনে। কিন্তু এখন যেহেতু এটা আলোচনায় আছে, তাই আমিই বা কেন এ নিয়ে দুই কথা বলা থেকে বিরত থাকবো?

তবে আমি আলোচনাটা একটু ভিন্নভাবে করতে চাই। বিমান ও যুদ্ধবিমান—দুইটি শব্দ, কিন্তু ভিন্ন অর্থ, ভিন্ন অভিপ্রায়। একটির জন্ম মানুষের দ্রুত গমনাগমনের প্রয়োজনে, অপরটির সৃষ্টি ধ্বংস ও কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। অথচ এরা দুজনই বিজ্ঞানেরই সন্তান। এ এক অদ্ভুত সহাবস্থান—যেখানে একই প্রযুক্তি আমাদের স্বপ্নকে ডানামেলে উড়তে দেয়, আবার একই প্রযুক্তি আমাদের কফিনেও পেরেক ঠুকে দেয়। মানব সভ্যতার এই বিপরীতমুখী অভিযাত্রা একদিকে আমাদের অভিভূত করে, আবার অন্যদিকে প্রশ্ন জাগায়—আমরা কোথায় চলেছি? ঠিক পথে না চলে ভুল পথে চলায় কে বা কারা আমাদের প্ররোচিত করে? যে মানুষ উড়তে চেয়েছিল শুধুই আকাশ স্পর্শ করার জন্য, সেই মানুষই আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে ভয় পায়, কখন বোমা পড়ে, কখন ড্রোন হামলা হয়।

একশ বছর আগে রাইট ব্রাদার্স উড়ান দিয়েছিলেন এক উদ্দীপনাময় চেষ্টায়। আজ, সেই পথেই ছুটে চলে স্টিলের ভয়ংকর পাখি, যা মুহূর্তেই মুছে দিতে পারে একটি নগরী, একটি ভবিষ্যৎ, এমনকি একটি সভ্যতাও। তাহলে আমরা কি প্রযুক্তিকে দোষ দেব? না, প্রযুক্তি কখনোই দোষী নয়। দোষ আমাদের প্রয়োগে, উদ্দেশ্যে এবং মানবিক বিবেচনায়। বিজ্ঞান তার পথ অনুসরণ করে। সে সৃষ্টি করে, কিন্তু কী সৃষ্টি করবে—সেটা ঠিক করে মানুষ। আমরা চাইলে আকাশে ফুল ফোটাতে পারি, আবার চাইলে আকাশ থেকে ফেলে দিতে পারি আগুনের গোলা অনেক সুন্দর কিছু ভস্মীভূত করার জন্য। বিষয়টা তাই সদিচ্ছার, মূল্যবোধের এবং নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু আমরা কি আসলে নিয়ন্ত্রণে আছি?

আধুনিক সভ্যতার পরিহাস হলো—যে দেশগুলো সভ্যতার বুলি কপচায়, গণতন্ত্রের প্রতীক সাজে, মানবাধিকারের বুলি ছড়ায়, তারাই অস্ত্র তৈরিতে সবচেয়ে ব্যস্ত, তারাই সামরিক খরচে শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরায়েল, এমনকি ইউরোপের শান্তির মুখোশ পরা দেশগুলোও যুদ্ধের ব্যস্ত বাজারে নিজেদের অস্তিত্ব টিকে রাখে।

কোথাও না কোথাও যুদ্ধ থাকতেই হবে, যেন অস্ত্রের ব্যবসা চলে। যুদ্ধের এই অনিবার্যতা যেন আধুনিক সভ্যতার স্থায়ী উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যে বৈপরীত্য—মানবতা বনাম মুনাফা—এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট। যাঁরা মানবাধিকার নিয়ে চিৎকার করেন, তাঁরাই আবার অস্ত্র রপ্তানি করে, শরণার্থী সৃষ্টির মূলে থাকেন। এক হাতে খাদ্য সহায়তা, অন্য হাতে ট্যাংকের চাবি। একদিকে শান্তির সংলাপ, অন্যদিকে গোপন অস্ত্রচুক্তি। যেন ‘সভ্যতা’ একটি দ্বিমুখী মুখোশ, যেখানে একপাশে সহানুভূতি, অন্যপাশে স্বার্থান্ধতা।

তাহলে আমরা কি অসহায়? না, একদমই না। কারণ ইতিহাস বলে, মানবতাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। হিটলার পারেনি, মুসোলিনি পারেনি, পারমাণবিক ছায়ার ভয় থেকেও মানুষ বেরিয়ে এসেছে। যখনই ধ্বংস বেশি হয়েছে, তখনই মানুষ নতুন করে সৃষ্টি করতে শিখেছে। হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন প্রজন্ম উঠে এসেছে; যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম আবার গেয়ে উঠেছে জীবনের গান। আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত শিশুরা আজ বিশ্বসংগীতের প্রতিভা হয়ে উঠছে।

তাহলে করণীয় কী? প্রথমত, আমাদের ভাবতে হবে—কী শেখাচ্ছি আমরা আমাদের সন্তানদের? শুধু পেশাগত দক্ষতা নয়, মূল্যবোধ, সহমর্মিতা, ইতিহাসবোধ—এই বিষয়গুলো না শিখালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেবল দক্ষ হানাদার হবে, মানুষ নয়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষানীতিতে শান্তি, সহাবস্থান, পরিবেশ ও প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার নিয়ে পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিজ্ঞান যদি নৈতিকতার শিক্ষার সঙ্গে না আসে, তাহলে সে ডক্টর জেকিলের হাতের অস্ত্র হয়ে উঠবে।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রগুলোর সামরিক খরচের এক অংশ বাধ্যতামূলকভাবে মানব উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ও দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যয় করতে হবে—জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে নয়, বরং স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। চতুর্থত, আমরা নাগরিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের করের টাকা কোথায় যায়, তা নিয়ে জবাবদিহি চাইতে হবে। যুদ্ধবিমানের নামে বিলিয়ন ডলার খরচ, অথচ হাসপাতালের ওষুধ নেই—এই অসমতা মেনে নেওয়া মানে নিজেদের মৃত্যুর গর্তে নিজেরাই পা রাখা।

সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের চিন্তার পথ বদলাতে হবে। বিমানে চড়ার মানে শুধু বিলাস নয়, সেটি যেন যোগাযোগ, সহানুভূতি, সংস্কৃতি বিনিময়ের মাধ্যম হয়। আর যুদ্ধবিমান যেন জাদুঘরের এক নিদর্শন হয়ে পড়ে থাকে—প্রযুক্তির সেই অধ্যায়, যেটা আমরা অতিক্রম করে এসেছি।

সৃষ্টি ও ধ্বংস—এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। কিন্তু আমরা কোন দিকে যাব, সেটা নির্ভর করে আমাদের বেছে নেওয়ার ক্ষমতার ওপর। আমরা যদি মানবতার দিকে দাঁড়াই, তবে বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কার আশীর্বাদ হবে। আর যদি ক্ষমতার লালসা আমাদের চালিত করে, তবে বিজ্ঞানই আমাদের সমাধির ফলক হয়ে উঠবে। আজকের পৃথিবীতে তাই সবচেয়ে প্রয়োজন—প্রযুক্তি নয়, মনুষ্যত্ব। সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নয়, বরং সবচেয়ে বড় সহানুভূতির ক্ষমতা। বিমান তখনই মানুষকে সত্যিকারভাবে উড়তে শেখাবে, যখন তার ডানায় থাকবে দয়া, শান্তি ও সম্ভাবনার ছাপ।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিকবিশিষ্ট রাজনীতিক বিশ্লেষক।

শিক্ষার বাতিঘর প্রয়াত প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকীর ৫৮তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন

সৃষ্টি ও ধ্বংসের যুগলবন্দি

০৮:০০:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি। শত শত বিমান প্রতিদিন আকাশে ওড়ে, সেটা নিয়ে কোনো চাঞ্চল্য নেই, কোনো খবরও নয় ওই বিমান চলাচল নয়। কারণ ওটা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক বিষয় সচরাচর খবর হয় না। কিন্তু মাইলস্টোনে একটি যুদ্ধবিমান, যেটা প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল, সেটি আছড়ে পড়ে অসংখ্য মৃত্যুর কারণ হওয়ায় ওটা খবর হয়েছে। মর্মান্তিক এবং দুঃখ ও বেদনার খবর। আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি। আমরা অনেক কিছুই দ্রুত ভুলে যাই। এই বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনাও খুব দীর্ঘস্থায়ী হবে না আমাদের জীবনে। কিন্তু এখন যেহেতু এটা আলোচনায় আছে, তাই আমিই বা কেন এ নিয়ে দুই কথা বলা থেকে বিরত থাকবো?

তবে আমি আলোচনাটা একটু ভিন্নভাবে করতে চাই। বিমান ও যুদ্ধবিমান—দুইটি শব্দ, কিন্তু ভিন্ন অর্থ, ভিন্ন অভিপ্রায়। একটির জন্ম মানুষের দ্রুত গমনাগমনের প্রয়োজনে, অপরটির সৃষ্টি ধ্বংস ও কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। অথচ এরা দুজনই বিজ্ঞানেরই সন্তান। এ এক অদ্ভুত সহাবস্থান—যেখানে একই প্রযুক্তি আমাদের স্বপ্নকে ডানামেলে উড়তে দেয়, আবার একই প্রযুক্তি আমাদের কফিনেও পেরেক ঠুকে দেয়। মানব সভ্যতার এই বিপরীতমুখী অভিযাত্রা একদিকে আমাদের অভিভূত করে, আবার অন্যদিকে প্রশ্ন জাগায়—আমরা কোথায় চলেছি? ঠিক পথে না চলে ভুল পথে চলায় কে বা কারা আমাদের প্ররোচিত করে? যে মানুষ উড়তে চেয়েছিল শুধুই আকাশ স্পর্শ করার জন্য, সেই মানুষই আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে ভয় পায়, কখন বোমা পড়ে, কখন ড্রোন হামলা হয়।

একশ বছর আগে রাইট ব্রাদার্স উড়ান দিয়েছিলেন এক উদ্দীপনাময় চেষ্টায়। আজ, সেই পথেই ছুটে চলে স্টিলের ভয়ংকর পাখি, যা মুহূর্তেই মুছে দিতে পারে একটি নগরী, একটি ভবিষ্যৎ, এমনকি একটি সভ্যতাও। তাহলে আমরা কি প্রযুক্তিকে দোষ দেব? না, প্রযুক্তি কখনোই দোষী নয়। দোষ আমাদের প্রয়োগে, উদ্দেশ্যে এবং মানবিক বিবেচনায়। বিজ্ঞান তার পথ অনুসরণ করে। সে সৃষ্টি করে, কিন্তু কী সৃষ্টি করবে—সেটা ঠিক করে মানুষ। আমরা চাইলে আকাশে ফুল ফোটাতে পারি, আবার চাইলে আকাশ থেকে ফেলে দিতে পারি আগুনের গোলা অনেক সুন্দর কিছু ভস্মীভূত করার জন্য। বিষয়টা তাই সদিচ্ছার, মূল্যবোধের এবং নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু আমরা কি আসলে নিয়ন্ত্রণে আছি?

আধুনিক সভ্যতার পরিহাস হলো—যে দেশগুলো সভ্যতার বুলি কপচায়, গণতন্ত্রের প্রতীক সাজে, মানবাধিকারের বুলি ছড়ায়, তারাই অস্ত্র তৈরিতে সবচেয়ে ব্যস্ত, তারাই সামরিক খরচে শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরায়েল, এমনকি ইউরোপের শান্তির মুখোশ পরা দেশগুলোও যুদ্ধের ব্যস্ত বাজারে নিজেদের অস্তিত্ব টিকে রাখে।

কোথাও না কোথাও যুদ্ধ থাকতেই হবে, যেন অস্ত্রের ব্যবসা চলে। যুদ্ধের এই অনিবার্যতা যেন আধুনিক সভ্যতার স্থায়ী উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যে বৈপরীত্য—মানবতা বনাম মুনাফা—এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট। যাঁরা মানবাধিকার নিয়ে চিৎকার করেন, তাঁরাই আবার অস্ত্র রপ্তানি করে, শরণার্থী সৃষ্টির মূলে থাকেন। এক হাতে খাদ্য সহায়তা, অন্য হাতে ট্যাংকের চাবি। একদিকে শান্তির সংলাপ, অন্যদিকে গোপন অস্ত্রচুক্তি। যেন ‘সভ্যতা’ একটি দ্বিমুখী মুখোশ, যেখানে একপাশে সহানুভূতি, অন্যপাশে স্বার্থান্ধতা।

তাহলে আমরা কি অসহায়? না, একদমই না। কারণ ইতিহাস বলে, মানবতাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। হিটলার পারেনি, মুসোলিনি পারেনি, পারমাণবিক ছায়ার ভয় থেকেও মানুষ বেরিয়ে এসেছে। যখনই ধ্বংস বেশি হয়েছে, তখনই মানুষ নতুন করে সৃষ্টি করতে শিখেছে। হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন প্রজন্ম উঠে এসেছে; যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম আবার গেয়ে উঠেছে জীবনের গান। আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত শিশুরা আজ বিশ্বসংগীতের প্রতিভা হয়ে উঠছে।

তাহলে করণীয় কী? প্রথমত, আমাদের ভাবতে হবে—কী শেখাচ্ছি আমরা আমাদের সন্তানদের? শুধু পেশাগত দক্ষতা নয়, মূল্যবোধ, সহমর্মিতা, ইতিহাসবোধ—এই বিষয়গুলো না শিখালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেবল দক্ষ হানাদার হবে, মানুষ নয়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষানীতিতে শান্তি, সহাবস্থান, পরিবেশ ও প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার নিয়ে পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিজ্ঞান যদি নৈতিকতার শিক্ষার সঙ্গে না আসে, তাহলে সে ডক্টর জেকিলের হাতের অস্ত্র হয়ে উঠবে।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রগুলোর সামরিক খরচের এক অংশ বাধ্যতামূলকভাবে মানব উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ও দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যয় করতে হবে—জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে নয়, বরং স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। চতুর্থত, আমরা নাগরিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের করের টাকা কোথায় যায়, তা নিয়ে জবাবদিহি চাইতে হবে। যুদ্ধবিমানের নামে বিলিয়ন ডলার খরচ, অথচ হাসপাতালের ওষুধ নেই—এই অসমতা মেনে নেওয়া মানে নিজেদের মৃত্যুর গর্তে নিজেরাই পা রাখা।

সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের চিন্তার পথ বদলাতে হবে। বিমানে চড়ার মানে শুধু বিলাস নয়, সেটি যেন যোগাযোগ, সহানুভূতি, সংস্কৃতি বিনিময়ের মাধ্যম হয়। আর যুদ্ধবিমান যেন জাদুঘরের এক নিদর্শন হয়ে পড়ে থাকে—প্রযুক্তির সেই অধ্যায়, যেটা আমরা অতিক্রম করে এসেছি।

সৃষ্টি ও ধ্বংস—এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। কিন্তু আমরা কোন দিকে যাব, সেটা নির্ভর করে আমাদের বেছে নেওয়ার ক্ষমতার ওপর। আমরা যদি মানবতার দিকে দাঁড়াই, তবে বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কার আশীর্বাদ হবে। আর যদি ক্ষমতার লালসা আমাদের চালিত করে, তবে বিজ্ঞানই আমাদের সমাধির ফলক হয়ে উঠবে। আজকের পৃথিবীতে তাই সবচেয়ে প্রয়োজন—প্রযুক্তি নয়, মনুষ্যত্ব। সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নয়, বরং সবচেয়ে বড় সহানুভূতির ক্ষমতা। বিমান তখনই মানুষকে সত্যিকারভাবে উড়তে শেখাবে, যখন তার ডানায় থাকবে দয়া, শান্তি ও সম্ভাবনার ছাপ।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিকবিশিষ্ট রাজনীতিক বিশ্লেষক।