গমের বাজারে অস্থিরতা ও বাংলাদেশের আমদানি কৌশল
বর্তমানে বৈশ্বিক খাদ্যশস্য বাজার চরম অস্থির। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং সরবরাহ শৃঙ্খলার বিপর্যয়ে গমসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে—এই আমদানি সিদ্ধান্ত কি বাস্তবিক অর্থে মূল্যসাশ্রয়ী, নাকি বিদ্যমান বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলার সংকটের মধ্যে একটি খরচবর্ধক পদক্ষেপ?
যুক্তরাষ্ট্রের গম: ব্যয়ের বাস্তবতা
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের গমের দর তুলনামূলকভাবে বেশি। বাংলাদেশ অতীতে ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন বা কানাডা থেকে তুলনামূলক কম মূল্যে গম আমদানি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করলে প্রতি টন গমে বাংলাদেশকে ২০ থেকে ৩০ ডলার বেশি ব্যয় করতে হতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে পরিবহন খরচ, এলসি খোলার ডলার ঘাটতি এবং ব্যাংকিং জটিলতা। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকে ‘মূল্যসাশ্রয়ী’ বলা বাস্তবের সঙ্গে খাপ খায় না।

বাজারে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের গম বেশি দামে আমদানি করা হলে স্থানীয় বাজারে আটা, ময়দা, সেমাই, বিস্কুটসহ গমনির্ভর খাদ্যপণ্যের দামে নিম্নমুখী চাপ পড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং সরকারি গুদামে বেশি দামে গম সংগ্রহ করতে হলে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে বা বিক্রি মূল্য বাড়াতে হতে পারে—যা সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ, বিশেষত নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি আরও ভোগান্তিতে পড়তে পারে।
অর্থনীতিতে চাপ: ডলার সংকট ও বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি
বাংলাদেশ বর্তমানে মারাত্মক বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে ভুগছে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এলসি খোলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত দামী উৎস থেকে গম আমদানি করা মানে অতিরিক্ত ডলার খরচ ও রিজার্ভে চাপ বাড়ানো। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সস্তা ও সহজলভ্য উৎস বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রাধান্য দেওয়া হলে তা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণেই কি এই সিদ্ধান্ত?
এই সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করা একটি উদ্দেশ্য হতে পারে। বিভিন্ন সময় মার্কিন প্রশাসনের চাপে থাকা বাংলাদেশ সরকার হয়তো এই আমদানির মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়নের কৌশল নিচ্ছে। তবে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য অর্থনৈতিক বাস্তবতা উপেক্ষা করা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।
স্থানীয় উৎপাদনের ওপর প্রভাব ও কৃষকদের উদ্বেগ
অতিরিক্ত আমদানি নীতির কারণে দেশের গম চাষিরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। বাজারে যদি আমদানি করা গম কম দামে চলে আসে, তাহলে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠবে না। এতে দেশের কৃষিখাতে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং খাদ্য নিরাপত্তার মূলভিত্তি দুর্বল হবে।

মূল্যায়নহীন আমদানি নীতির ঝুঁকি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্ত একটি উচ্চ ব্যয়সাপেক্ষ ও রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল পদক্ষেপ। এটি সরাসরি মূল্যস্ফীতির চাপ, ডলার সংকট ও কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারের উচিত ছিল কম দামে গম সরবরাহকারী দেশগুলো থেকে আমদানির বিকল্প খুঁজে দেখা, কিংবা আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি সমাধান খোঁজা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বৈচিত্র্য থাকা জরুরি, তবে তা যেন অর্থনৈতিক আত্মঘাতী পথে না নিয়ে যায়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















