যুক্তরাজ্যের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার: বাংলাদেশসহ তিন দেশের সুবিধা
বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং কম্বোডিয়া দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাজ্যের বাজারে তাদের তৈরি পোশাক (RMG) পণ্যের রপ্তানিতে জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (GSP) সুবিধার আওতায় শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছে। এই ব্যবস্থার ফলে এসব দেশ যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পোশাক রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার, যেখানে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়।
ভারত-যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি: নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব
২০২৫ সালের জুলাই মাসে ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (Free Trade Agreement – FTA) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির আওতায় ভারত এখন থেকে যুক্তরাজ্যে তৈরি পোশাকসহ একাধিক পণ্য শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি করতে পারবে। আগে ভারতের তৈরি পোশাক যুক্তরাজ্যের বাজারে ১০-১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করত, ফলে দাম বেশি হওয়ায় তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিল। এখন সে বাধা দূর হওয়ায় ভারতীয় পোশাক রপ্তানিকারকেরা বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সম্ভাব্য প্রভাব
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। ভারতের নতুন শুল্কমুক্ত সুবিধার ফলে একই বাজারে মূল্য-প্রতিযোগিতা তীব্রতর হবে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কম থাকলেও অবকাঠামোগত দুর্বলতা, বন্দরের বিলম্ব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় কোম্পানিগুলো যেহেতু তুলনামূলকভাবে বড়, প্রযুক্তি ও দক্ষতা বেশি এবং উৎপাদনে বৈচিত্র্য রয়েছে, তাই তারা দ্রুত এই সুবিধার সদ্ব্যবহার করতে পারবে। এতে করে যুক্তরাজ্যের বড় বড় ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা ভারতীয় পোশাকের দিকে ঝুঁকতে পারে।
প্রস্তুতিমূলক উদ্যোগ ও সরকারি কৌশলের অভাব
বাংলাদেশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘Everything But Arms’ (EBA) সুবিধার আওতায় রয়েছে, কিন্তু যুক্তরাজ্য ব্রেক্সিটের পর নতুন সুবিধা কাঠামো চালু করায় আলাদা প্রস্তুতির দরকার ছিল। কিন্তু সরকার বা ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এই নতুন FTA পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখনও কোনো কার্যকর কৌশল নেওয়া হয়নি। ফলে প্রস্তুতিপর্বেই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে।
করণীয় ও ভবিষ্যতের জন্য সুপারিশ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের টিকে থাকার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো জরুরি:
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ: ভারতের মতো বাংলাদেশকেও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে FTA বা অনুরূপ একটি সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দ্রুত আলোচনা শুরু করতে হবে।
মূল্য সংযোজন ও বৈচিত্র্য আনা: পোশাক পণ্যে উচ্চমূল্যের ডিজাইন, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া যুক্ত করে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
লজিস্টিকস ও পোর্ট ব্যবস্থার উন্নয়ন: বন্দরের জটিলতা ও পরিবহন ব্যয় কমাতে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার: দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি এবং টেকসই উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে হবে।
পণ্য বৈচিত্র্য ও বাজার সম্প্রসারণ: শুধু যুক্তরাজ্য নয়, নতুন বাজার খোঁজা এবং টেক্সটাইল পণ্যের পরিধি বাড়ানোর মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
প্রতিযোগিতার নতুন ধাপে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত হিসেবে RMG খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ, বেসরকারি খাতের কৌশলগত প্রস্তুতি এবং বৈদেশিক কূটনীতির মাধ্যমে নতুন সুবিধা আদায়ের দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান হুমকির মুখে পড়তে পারে।