শিল্পের এক নিরলস সাধক
বাংলা নাটক ও টেলিভিশনের ইতিহাসে আবুল খায়ের ছিলেন এমন একজন অভিনয়শিল্পী, যিনি কেবল সংলাপ বা চরিত্রে থেমে থাকেননি—তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের এক প্রতীক। কণ্ঠের গাম্ভীর্য, মুখভঙ্গিমার সংযম, সংলাপ বলার সুষম ছন্দ—এসবের সম্মিলন ঘটেছিল তাঁর অভিনয়শৈলীতে। তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, অভিনেতা, আবৃত্তিকার ও একজন মননশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
জন্ম, শৈশব ও সাংস্কৃতিক বীজবপন
আবুল খায়ের ১৯৩২ সালে কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর বই পড়ার প্রতি আকর্ষণ ছিল। বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা ছিলেন সাহিত্যানুরাগী—এই সাংস্কৃতিক পরিবেশেই গড়ে ওঠে আবুল খায়েরের শিল্পবোধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই নাট্যচর্চা ও আবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
মঞ্চে আত্মপ্রকাশ ও নাট্যআন্দোলনের অংশগ্রহণ
ছাত্রজীবনেই তাঁর প্রথম অভিনয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যশালায়। এরপর তিনি যুক্ত হন মঞ্চনাটকে—বিশেষ করে ‘নগর নাট্যম’ এবং ‘বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ’-এর মতো সাংগঠনিক প্ল্যাটফর্মে। তিনি অভিনয় করেন ‘বরফ গলা নদী’, ‘রক্তকরবী’, ‘কবর’ ও ‘সূর্যসন্তান’ নাটকে। তাঁর মঞ্চে হাঁটার ভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি বদল এবং সংলাপ দেওয়ার ধীরতা যেন প্রতিটি চরিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করত।
অভিনয়শৈলীর বিশ্লেষণ: সংযম, অনুভব ও গভীরতা
আবুল খায়েরের অভিনয় ছিল সংযত, চিন্তাশীল ও অন্তর্মুখী। তিনি চিৎকার করে নয়, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা ও সংলাপের ভারসাম্যের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করতেন। কেউ কেউ বলেন, “তিনি এমনভাবে সংলাপ দিতেন, যেন শব্দ নয়—চিন্তা কথা বলছে।” তাঁর চরিত্ররা সবসময় বহুস্তরপূর্ণ থাকত—চোখের চাহনি, ঠোঁটের হালকা কাঁপুনি বা দীর্ঘ নিঃশ্বাসে তিনি প্রকাশ করতেন চরিত্রের ভেতরের যন্ত্রণা। বিশেষ করে রাজনৈতিক নাটকে তাঁর ভূমিকা ছিল দর্শকের বিবেক জাগিয়ে তোলার মতো।
টেলিভিশনে বিস্তার: জনমানসে জায়গা করে নেওয়া
১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে আবুল খায়ের বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) একটি পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য মুখ হয়ে উঠেন। ‘সংশপ্তক’-এ তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করেন, তা ছিল এক সংগ্রামী পুরুষের প্রতিচ্ছবি—সমাজের জটিলতা ও রাজনৈতিক সংকটের চাপে যিনি ক্ষুব্ধ, কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে আপসহীন। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘আলোর মিছিল’-এর মতো নাটকে তিনি কখনো পিতা, কখনো শিক্ষক, কখনো প্রতিবাদী নাগরিক—প্রত্যেক চরিত্রে সমানভাবে দাগ কাটেন।
চলচ্চিত্রে যাত্রা: পরিমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ
চলচ্চিত্রে তাঁর উপস্থিতি ছিল সীমিত, কিন্তু প্রতিটি কাজেই গভীর ছাপ রেখেছেন। ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রে তাঁর পার্শ্বচরিত্রটি রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে দর্শকমনে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ এবং ‘শ্যামল ছায়া’ তেও তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেন। তাঁর চরিত্রগুলি বাস্তবতা ও মানবিক বোধে পরিপূর্ণ।
একটি অদ্ভুত স্মৃতি: নাটকে ভুল সংলাপেই সৃষ্টি হয় নতুন আবেগ
একবার মঞ্চে ‘রক্তকরবী’ নাটকের অভিনয়কালে তিনি ভুল করে রবীন্দ্রনাথের একটি সংলাপ বদলে ফেলেন। সংলাপটি হওয়ার কথা ছিল—”বাঁধ ভেঙে জল আসুক।” তিনি বলে ফেলেন—”জল ভেঙে বাঁধ আসুক!” দর্শক প্রথমে বিভ্রান্ত হলেও, মুহূর্তেই তা দাঁড়িয়ে যায় নাট্য-পরিবেশনার নতুন উপমা হিসেবে। পরবর্তীতে অনেক তরুণ নাট্যকর্মী তাঁর এই ভুলকে ব্যাখ্যা করেন “নতুন ব্যাকরণিক মুক্তি” হিসেবে।
সহশিল্পী ও নাট্যবন্ধুরা যা বলেন
আতাউর রহমান বলেন, “আবুল খায়ের ছিলেন মঞ্চের বুদ্ধিজীবী।”
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “তিনি যে কোনো চরিত্রে প্রবেশ করতেন ধ্যানস্থ হয়ে—কেবল আবেগ নয়, যুক্তির মধ্য দিয়ে।”
সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, “তিনি ছিলেন আমাদের নাট্যবিশ্বের পথপ্রদর্শক, নিরব অথচ দৃঢ়।”
পুরস্কার, সম্মান ও অবদান
তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন:
- একুশে পদক (২০১৪)
- শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার
- মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পদক
- বিটিভি আজীবন সম্মাননা
চিরবিদায় ও উত্তরাধিকার
২০১৭ সালের ১৯ আগস্ট আবুল খায়ের পরপারে চলে যান। বাংলাদেশের অভিনয় ও নাট্যজগতে তাঁর অবদান অবিচ্ছেদ্য। এমন শিল্পী আমাদের সময়ের মানস আয়না হয়ে ছিলেন—যিনি আমাদের দেখিয়েছেন, শিল্প কেবল বিনোদন নয়, এটি চিন্তার সংবেদনও।
আবুল খায়ের ছিলেন সেই বিরল নাট্যব্যক্তিত্ব, যাঁর অভিনয় দর্শকের চোখে জল এনে দিত, আবার চিন্তার তীরেও বিঁধে দিত হৃদয়। তিনি শিখিয়েছেন—শিল্প যদি নিঃশব্দে কথা না বলে, তবে তা প্রকৃত শিল্প নয়। বাংলা নাটক ও অভিনয়ের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।