নতুন “লিবারেশন ডে” ট্যারিফ কার্যকরের পর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি বিপদের মুখে পড়েছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ট্রাম্প প্রশাসন ৩৭ শতাংশ রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ ঘোষণা করে, যা বাংলাদেশের মতো প্রায় ৬০টি দেশের ওপর প্রযোজ্য হয়েছে। বাংলাদেশের প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষেত্রে এই শুল্কহার পূর্বের গড় শুল্ক (প্রায় ১৫ শতাংশ) থেকে দ্বিগুণেরও বেশি, ফলে শিল্পটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
মূল্যবৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা হ্রাস
৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক যুক্ত হওয়ায় পণ্যের এফওবি (FOB) মূল্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাড়তি খরচ যোগ হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের প্লাস্টিক পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারাচ্ছে। ভিয়েতনাম ও ভারত মাত্র ২০–২৬ শতাংশ হারে শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে পারায় তারা এখন তুলনামূলকভাবে বেশি প্রতিযোগিতামূলক।
অর্ডার হ্রাস ও মার্কিন বাজারে অনিশ্চয়তা
যেভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে অর্ডার বাতিল ও চাকরি হারানোর মতো ঘটনা ঘটেছে, ঠিক তেমনি প্লাস্টিক খাতেও মার্কিন ক্রেতারা অর্ডার দিচ্ছে না অথবা সিদ্ধান্ত মুলতুবি রাখছে। ফলে উৎপাদন পরিকল্পনায় অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
শ্রমিক ও উৎপাদন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব
যদিও প্লাস্টিক শিল্পে তৈরি পোশাক খাতের মতো বিপুলসংখ্যক শ্রমিক যুক্ত নয়, তবে সরবরাহ চেইনের মাধ্যমে হাজারো কর্মজীবী এতে সম্পৃক্ত। উৎপাদন হ্রাস পেলে কারখানার পাশাপাশি প্যাকেজিং, পরিবহন ও কুরিয়ার পরিষেবাসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সামাজিক প্রভাব
প্লাস্টিক শিল্পে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম হলেও, শিল্পের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি পরিবারিক আয়ে ভূমিকা রাখে। কাজ হারালে অনেক পরিবারে আয় সংকোচন ঘটবে, যা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গার্মেন্টস শিল্পের মতো এখানে ধ্বংসাত্মক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে।
রপ্তানি পুনর্বিন্যাস ও বাজার হারানোর শঙ্কা
বহুজাতিক ব্র্যান্ডগুলো এখন কম শুল্কপ্রাপ্ত দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ভারত বা পেরুর দিকে অর্ডার সরিয়ে নিতে পারে। এতে বাংলাদেশের মার্কিন বাজারে রপ্তানির অংশীদারিত্ব হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কৌশলগত কূটনীতি ও বাজার বৈচিত্র্য
গার্মেন্টস খাতের ওপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে প্লাস্টিকসহ অন্যান্য শিল্প খাতে রপ্তানির বৈচিত্র্য এবং মানোন্নয়ন এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের উচিত এই শিল্পে উৎপাদন ও রপ্তানিতে সহায়তা বাড়ানো। মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ট্যারিফ ইস্যুর কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে।
যেমন বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিমান কেনা, কৃষিপণ্য আমদানিতে ছাড় এবং বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেছে—ঠিক তেমনিভাবে কৌশলগত বাণিজ্যকূটনীতি প্রয়োগ করে প্লাস্টিকসহ অন্যান্য শিল্পের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা দেওয়া যেতে পারে।
বিকল্প বাজারে প্রবেশ ও আন্তর্জাতিক জোটে সম্পৃক্ততা
WTO, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের মতো বিকল্প বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে। এলডিসি সুবিধা হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি মোকাবিলায় নতুন সহযোগিতার কাঠামো তৈরি করতে হবে, যেন রপ্তানি চলমান থাকে এবং ক্ষতি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হয়।
প্লাস্টিক রপ্তানির ওপর ৩৭ শতাংশ রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সংকেত। এটি শুধু মূল্য প্রতিযোগিতা নয়, বরং শ্রমিক নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন—সব কিছুর ওপরই চাপ সৃষ্টি করছে। এই অবস্থায় সরকারি উদ্যোগ, ব্যবসায়ীদের অভিযোজন ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সক্রিয়তা ছাড়া বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না।